পাহাড়, নদী আর বরফের স্বর্গ! যে গন্তব্য আজও বাঙালি পর্যটকদের অজানা!
Bhaderwah Kashmir Offbeat Tour: মানুষের বিশ্বাস, ভাদরবা বাসুকী নাগের পীঠস্থান। প্রধান বাসুকী নাগ মন্দিরের উপাস্য দেবতা নীরজ বাসুকী আর রাজা জাম্বুবান।
কাশ্মীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে। সেনাবাহিনীর কর্মসূত্রে বাবা ছিলেন কাশ্মীরে। তখন আমি ৬-৭ বছরের, সেই ছোটবেলার ২বছরের স্মৃতি ম্লান হবার আগেই চলে এলাম উরিতে ১৯৯৮ সালে। আমিও বাবারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলাম। তারপর ২০১৪ সালে অবসর নেওয়ার আগে বহুবার এই ভূস্বর্গের আনাচে কানাচে গেছি। তারপর আবার যাতায়াত শুরু ট্রাভেল টুরিজমের সূত্রে। প্রতি বছরই একাধিকবার কাশ্মীরে আসি, চেষ্টা করি প্রচলিত কাশ্মীর সফরের বাইরে কোথাও যাওয়ার, সেই জায়গাটিকে আবিষ্কারের। এবার টিউলিপ উৎসবে ২ দিন সময় বার করে চলে গিয়েছিলাম ডোডা জেলার মুকুটের-মণি শহর ভাদরবায়।
ভূস্বর্গ কাশ্মীরের নাম এলেই মনে পড়ে অপার সৌন্দর্যে ভরা গুলমার্গের ঢেউখেলানো তৃণভূমি, সোনমার্গের বরফে মোড়া পাহাড়ের হাতছানি, পহেলগামের লিডার নদীর অপরূপ চঞ্চলতা। এই সবই মিলবে ডোডা জেলার ভাদরবায়। পিরপাঞ্জাল রেঞ্জের কৈলাশ পাহাড় আর সোনবাইন-আশাপতি হিমবাহের কোলে প্রায় ৫২০০ ফুট উচ্চতায় এই ভাদরবা কিন্তু খুব অচেনা বা ট্রাভেল টুরিজমের ভাষায় অফবিট নয়।
জম্মু থেকে শ্রীনগর জাতীয় সড়ক ধরে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় টানেল পার করে সোজা না গিয়ে, ডানদিকে চেনাবের ঊর্ধ্বমুখে যেতে হবে ডোডা জেলার এই ভাদরবার দিকে, বাটোত-কীশ্বতবার জাতীয় সড়ক ধরে, ডোডায় এসে ধরতে হবে ডোডা-ভাদরবা মডেল রোড। জম্মু থেকে গাড়িতে এলে ২৭০ কিমি পথ, মোটামুটি ৬ ঘণ্টার রাস্তা ভাদরবা।
আরও পড়ুন- দিঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, বাঙালির মনে জায়গা পাকা করছে চটকপুর
ভাদরবা থেকে ৪১ কিমি দূরে চাম্বা জাতীয় সড়কে গেলে আসবে পাদরি, প্রায় ১০,২০০ ফুট উচ্চতায়। এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে মহম্মদ শাহ বোগদাদির জাইরাত বলে পরিচিত। পাদরির অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ বাকরুদ্ধ করবে। অপার উত্তর দিগন্তসীমায় ধরা পড়বে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির তুষার ধবল সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি এবং নিকট দক্ষিণ-পূর্বে তুষারাবৃত কৈলাশ-কুণ্ড পাহাড়। পাদরিতে শীতে স্কি ও গরমে প্যারাগ্লাইডিং হয়।
ভাদরবা থেকে গাড়িতে মাত্র ২ ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় বরফের রাজ্য গুরডান্ডায় বা প্রচলিত গুলিডান্ডায়, বরফ নিয়ে খেলার সুযোগ এখানে মোটামুটি সারাবছর। বানি-ভাসোলি রাস্তা ধরে ৩১ কিমি দূরে এই গুলিডান্ডা আদতে সোবাইন হিমবাহের অংশবিশেষ। অন্যদিকে সেঁওজ ভ্যালি, জয় ভ্যালি, চিন্তা ভ্যালির মখমলের মতো ঢেউখেলানো সবুজ মাঠ, রূপে বৈচিত্র্যে আরু-চন্দবাড়ি বা গুলমার্গকে মনে করাবে। ভাদরবা শহর থেকে এই সব অঞ্চলগুলি মাত্র ১৫ থেকে ৪৫ কিমির ভিতর।
ভাদরবা থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে, ভাদরবার মাথার মুকুট এই সেঁওজ! বহুবিস্তৃত তৃণভূমি অগণন ফুলে ফুলে ছেয়ে দৃষ্টিসীমান্ত পার করে দিগন্তভূমিতে মিশবে। আর সঙ্গী হবে অসংখ্য প্রজাপতি, ফড়িং। এই সেঁওজের হিমবাহ থেকেই ত্বায়ী নদী জন্ম নিয়ে জম্মুর দিকে চলে গেছে। সেঁওজের বাঁ দিকে দেখা যায় দেবছত্র তৃণভূমির অসাধারণ দৃশ্য আর ডান দিকে কৈলাশ-কুণ্ড পাহাড়। ভাদরবার থেকে উত্তর-পূর্বে কমবেশি ২৫ কিমির মধ্যে চিন্তা ভ্যালি, গ্রীষ্ম-অবকাশের জন্য আদর্শ স্থান। উপত্যকার সবুজ অদিগন্ত মাঠে প্যারাগ্লাইডিং ও ঘোড়ায় চড়া মুখ্য আকর্ষণ। শীতকালে আবার এই সবুজ পুরোই ঢাকা পড়ে মোটা বরফের চাদরে, তখন এখানে আসর বসে স্কিয়িংয়ের।
চিন্তা ভ্যালি থেকে বেরিয়ে আবার জয়-চিন্তা রাস্তা ধরে উত্তরে প্রায় ৩২ কিমি দূরে, জয় ভ্যালি। রাস্তায় পড়বে নাকশ্রি, ভালারা, বালোট গ্রামের সারি সারি দেবদারু পাইনের বন। সবুজ ঘাসে মোড়া এই জয় ভ্যালি ইংরেজি V আকৃতির মতো, চারিদিক দিকে সুউচ্চ ঘন পাইনের জঙ্গল। উপত্যকার ওপরের পাহাড়ে বিখ্যাত রোশেরা-শীতলা মন্দির। মন্দিরের সঙ্গে একটি ধর্মশালাও আছে।
মিষ্টি চালের মিষ্টি ভাত খেতে হলে আসতেই হবে কেলার ভ্যালি। ডোডা-ভাদরবা মডেল রোড দিয়ে ভাল্লা তহশিলের মধ্যে ভাদরবা থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে এই কেলার ভ্যালি আকারে বাটির মতো। চারিদিকের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি- দেবশেত্রা, চান্দের ও থালিয়ান কেলার ভ্যালিকে যেন অতি যত্নে নিজের কোলে টেনে নিয়েছে। এই সব পর্বতশ্রেণি থেকে স্ফটিকের মতো জলধারা- সেঁওজ ধার, ভাইহাল ধার ও কেমেল ধার এসে মিলেছে বিনকুদ নালায়। এই বিনকুদ ভাল্লায় এসে মিলেছে নীরু নদীর সঙ্গে। উপত্যকার চারিদিকে ছোট বড় বেশ ক'টি গ্রাম পাহাড়ের উপর মালথি, দুজ্ঞা, রিশুপুরা, দুগালি এবং থালসালা মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে আছে। বর্ষায় চারিদিকের মেঘের আনাগোনায় স্বর্গসম সুন্দর হয়ে ওঠে এই সবুজ উপত্যকা। এই অঞ্চলটি চাষ আবাদের জন্য বিখ্যাত, এখানে উৎপন্ন মিষ্টি চাল বা তোমুল রাইসের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। তাছাড়া অ্যাপ্রিকট, আখরোট, আপেল, বাদামও প্রচুর পরিমাণে চাষ হয় এখানে।
শহর ভাদরবারও বেশ সুন্দর। শৈলশহরগুলোতে আমরা সাধারণত উত্তরে উঁচু পাহাড় দেখতে পাই, কিন্তু এখানে পুরো দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম জুড়ে বরফে ঢাকা পাহাড়। লিডার নয় নীরু নদী পুরো শহরটা জুড়ে বন্য হরিণীর মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে। শহরের মধ্যেই আছে গাথা লেক পার্ক যা কোনও অংশে শ্রীনগরের বাগগুলির চেয়ে কম নয়।
ভাদরবার কথা বহু প্রাচীন কাল থেকেই মেলে বিভিন্ন পুরাণ কাহিনিতে, লৌকিক গল্পকথায়। মানুষের বিশ্বাস, ভাদরবা বাসুকী নাগের পীঠস্থান। প্রধান বাসুকী নাগ মন্দিরের উপাস্য দেবতা নীরজ বাসুকী আর রাজা জাম্বুবান, মন্দিরে এর কালো কষ্টিপাথরের মূর্তি ও এই মন্দিরের অসাধারণ স্থাপত্য দেখার মতো। পাণ্ডবদের জতুগৃহ পর্বের পর তাঁরা নাকি নীরু নদীর লাগোয়া সুন্দর শীতল ঝর্নার পাশে গুপ্ত গঙ্গায় অবস্থান করেন পাহাড়ের গুহায় বা আজকের পাণ্ডব কেভ-এ। ভাদরবা থেকে ৯ কিমি দূরে ঠানঠেরা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। এপ্রিল-মে মাস থেকে এখানে তাঁবু বসে, বিভিন্ন রকম অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের আয়োজন হয় প্রতি বছর, চলে প্রায় সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত।
আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে রাশিয়া অবধি সুড়ঙ্গ! যে সাতটি গুহার রহস্যভেদ হয়নি আজও…
এত কিছু সত্তেও কেন ভাদরবা বাঙালিদের কাশ্মীর ভ্রমণের সূচি থেকে বাদ পড়ে যায়, সেই ব্যাপারটা রহস্যজনক! এপ্রিল-মে মাস থেকে ভাদরবা জমজমাট থাকে সামার ক্যাম্পগুলোয়। ভাদরবার ঐতিহ্যবাহী অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঐতিহাসিক ভাদরবা ফোর্ট বা রত্নাগড় দূর্গ। ১৭৩৩ সালে রাজা মেথেনি পাল এই দূর্গ তৈরি করেছিলেন, তারপর থেকে বহু রাজার হাত বদল হয়ে ১৮২১ সালে তা আসে চম্বা রাজাদের হাতে। ১৮৫৪ সালে ভাদরবার সাগতু কোতোয়ালের নেতৃত্বে চম্বা রাজাদের থেকে দূর্গের দখল আসে ভাদরবাসীর কাছে। ফলে চম্বার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাদরবা কাশ্মীরের শাসক গুলাব সিংয়ের অন্তর্ভূক্ত হয়। ব্রিটিশরা ১৯১৯ সালে এই দূর্গকে জেলে রূপান্তরিত করে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী এই জেলে ছিলেন, তাদের মধ্যে সন্ত সিং, পণ্ডিত কাশ্যপ বান্দু ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মহম্মদ আব্দুল্লা অন্যতম। ২০০৭ সালে জম্মু-কাশ্মীরের সরকার এই স্থানকে হেরিটেজ তকমা দিয়ে সংরক্ষণ করে।
পরিষ্কার সুন্দর শান্ত শহর ভাদরবা রসনাতেও উচ্চমার্গের। এখানকার রাজমা-চাউল পৃথিবী বিখ্যাত। এছাড়া কাশ্মীরি ওয়াজেন, রোগান জোশের স্বাদ রন্ধনশিল্পীর উপর সম্ভ্রম জাগাবেই। আর অবশ্যই খেতে হবে, এখানকার কেল্লার ভ্যালির মিষ্টি চালের ভাত- তোমুল রাইস। ভাদরবায় থাকার হোটেলও সুলভ। শহর থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে পাহাড়ের ওপর রয়েছে ভাদরবা ট্যুরিজম অথরিটির বাংলো- তিলি গড়। এখান থেকে ভাদরবা শহরটাকে ছবির মতো দেখায়। বাংলোর চারিদিকে ফুলের বাগান, আপেল বাগান ও গোলাপ বাগান চোখের শান্তি, প্রাণের আরাম জোগায়। জম্মু, শ্রীনগর বা পহেলগাম যেখান থেকেই ভাদরবায় আসা যাক না কেন, ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগবে। ডোডা কিশ্বতবারের রাস্তায় ডোডা পর্যন্ত পুরো রাস্তাই চেনাব নদী সাহচর্য জোগাবে। প্রায় সারাবছর ধরেই ভাদরবায় পর্যটক আর পূণ্যার্থীদের সমাগম। তবে ঘুরতে এলে, কৈলাশ-কুণ্ড যাত্রার সময় বাদ দিয়ে যে কোনও সময়ই ভাদরবায় যাওয়া যায়, তবে এলে আসতে হবে কমপক্ষে ৪ রাতের জন্য।