দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন'-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট
Gongoni Weekend Tour: লোককাহিনি অনুযায়ী, পাণ্ডবরা নাকি তাঁদের অজ্ঞাতবাসের সময় মাথা গুঁজেছিলেন এই অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গুহাগুলিতে
মেদিনীপুরের নাম শুনলেই প্রথমে মনে আসে দিঘা, তাজপুর কিম্বা মন্দারমণির কথা, তাই না? কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, এই মেদিনীপুরে সমুদ্র সৈকত ছাড়াও অবস্থান করছে আরও একটি ভ্রমণস্থান। হপ্তান্তে, অল্প খরচে এই অফবিট ভ্রমণস্থানই হয়ে উঠতে পারে প্রকৃতির কোলে নিরিবিলিতে দু’দিন ছুটি কাটানোর মতো এক আদর্শ ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশন।
গিরিখাত সম্পর্কে ছোটবেলায় কমবেশি সকলেই ভূগোল বইতে খানিক হলেও পড়েছেন, জেনেছেন আমেরিকার বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথাও। এরকমই একটি ক্যানিয়ন রয়েছে খোদ আমাদেরই রাজ্যে? হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে অবস্থিত গড়বেতা শহর থেকে খানিক দূরেই অবস্থান করছে এ রাজ্যের একমাত্র গিরিখাত, গনগনি। উচ্চতায় প্রায় ৭০ মিটার গভীর এই গনগনির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে শিলাবতী নদী। একদিকে শিলাবতী নদী যেমন ক্ষয় করেছে গনগনি অঞ্চলের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকাকে, তেমনই প্রাকৃতিক আবহবিকারও যেন সুচারু এক শিল্পীর ন্যায় ইচ্ছামতো আকার দিয়েছে এই ভূমিভাগকে। সারাবছর শিলাবতী গা এলিয়ে থাকলেও, বর্ষায় সে কিন্তু রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। ভাসিয়ে দেয় চন্দ্রকোণা, ক্ষীরপাই এবং ঘাটালের বেশকিছু অংশ। তাই বর্ষার সময়ে এই অঞ্চলে ঘুরতে না আসাই শ্রেয়, গনগনিতে ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ সময় হল শীতকাল।
শীতের দুপুরে বিস্তীর্ণ লাল মাটির পথ ধরে হেঁটে গিয়ে অবশেষে আপনি যখন পৌঁছে যাবেন শিলাবতী নদীর তীরে, তখন গোটা অঞ্চলে অস্তগামী সূর্যের লাল আভার বিকিরণ গনগনির শোভা যেন আরও শতগুণ বাড়িয়ে দেবে- সে দৃশ্য ভোলার নয়। এই দৃশ্য দেখে আপনার মনে পড়লেও পড়তে পারে সত্যজিতের ‘সোনার কেল্লা’র কথা। গনগনি দর্শনের পর, আপনি চাইলে একবার ঢুঁ মেরে আসতে পারেন পাশেই অবস্থিত গড়বেতার জঙ্গল থেকে, সেখানে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে পারে বুনো হাতির।
আরও পড়ুন- পুজোয় সাধ্যের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দিচ্ছে ভারতীয় রেল! প্ল্যান করুন আজ থেকেই
গনগনিকে জড়িয়ে রয়েছে মহাভারতের কাহিনি
গনগনির উৎপত্তি নিয়ে এখানের লোকের মুখে একটি কাহিনি প্রায়শই শোনা যায়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পাণ্ডবরা নাকি তাঁদের অজ্ঞাতবাসের সময় মাথা গুঁজেছিলেন এই অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গুহাগুলিতে। নদীর অপরদিকে ভীখনগর নামে এক গ্রামের অস্তিত্ব ছিল বলেও তাঁরা বিশ্বাস করেন। কথিত আছে, একদিন যুধিষ্ঠির শিলাবতী নদীর তীরে এক ব্রাহ্মণকে বসে ব্যাকুলভাবে কাঁদতে দেখেন। ব্রাহ্মণকে এইভাবে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছিলেন বক রাক্ষসের কথা, যে নাকি প্রতিদিন গ্রামের একজন লোককে ভক্ষণ করে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করত। সেদিন ছিল সেই ব্রাহ্মণকে ভক্ষণের পালা। এই কথা শোনা মাত্রই যুধিষ্ঠির ভীমকে আদেশ দেন, বক রাক্ষস বধের। লোককথা অনুসারে, বিশালাকার বক রাক্ষসের সঙ্গে ভীমের যুদ্ধের সময়ই নাকি সৃষ্টি হয়েছিল ক্ষতবিক্ষত এই গনগনি ভূমির।
গনগনির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
লোকসৃষ্ট কাহিনির পাশাপাশি গনগনির কিন্তু এক বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে গনগনির রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। চুয়াড় বিদ্রোহের শীর্ষ নায়ক অচল সিংহ তাঁর দলবল নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন গনগনির গভীর জঙ্গলে। এই স্থান থেকেই তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছিলেন বলে জানা যায়। একদিন গভীর রাত্রে ইংরেজরা কামান দেগে গোটা শালবন ধ্বংস করলেও সন্ধান মেলেনি অচল সিংহের। কিন্তু সেইদিনের সেই কামানের গোলার মুখে প্রাণ গিয়েছিল অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসীর। অবশেষে রাজা ছত্র সিংহের বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে একদিন ধরা পড়তে হয় অচল সিংহ এবং তাঁর বাহিনীকে এবং ব্রিটিশদের গুলিতে প্রাণ যায় তাঁর। শোনা যায়, এই ছত্র সিংহ ছিলেন অচল সিংহের আত্মীয় এবং তাঁর কথাতেই নাকি একসময় অচল সিংহ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।
কীভাবে যাবেন গনগনি?
গনগনি রেলপথে এবং সড়ক পথে দুইভাবেই যাওয়া যায়। রেলপথে যদি যেতে ইচ্ছুক হন তবে, হাওড়া স্টেশন থেকে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে সাঁতরাগাছি স্টেশনে। সেখান থেকে সকাল ৬ টা ২৫ মিনিটের রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরতে পারেন অথবা ধরতে পারেন সকাল ৭ টা ৫৭ মিনিটের আরণ্যক এক্সপ্রেস। ব্যাস! একবার ট্রেনে চেপে বসলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন গড়বেতা স্টেশনে। স্টেশন থেকে টোটোতে মাত্র ২ কিমি পথের মধ্যেই পড়বে এই গনগনি অঞ্চল।
আপনি যদি সড়কপথে পৌঁছে যেতে চান গনগনি তবে, কলকাতা বা হাওড়া থেকে এনএইচ-৬ ধরে কোলাঘাট হয়ে মেদিনীপুর শহর থেকে ৬০ নম্বর জাতীর সড়ক ধরে শালবনির উপর দিয়ে শাল জঙ্গল পেরিয়ে চন্দ্রকোণা রোডের উপর দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে গড়বেতা। আবার মেদিনীপুর শহর থেকে বাসে করেও গড়বেতা যাওয়া যায়, তারপর সেখান থেকে টোটো করে গনগনি।
আরও পড়ুন- মিষ্টির জন্য ট্রেন দাঁড়াত এক ঘণ্টা! লেডিকেনির ইতিহাস আজও অবাক করে
হাতে যদি একদিন অতিরিক্ত সময় নিয়ে যান তবে গনগনি দর্শনের পাশাপাশি ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকেও। কথিত রয়েছে রাজা বিক্রমাদিত্য নাকি শবতন্ত্রের আরাধনা করতেন এবং তাঁর আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে, দেবী তাঁকে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন এবং একইসঙ্গে নাকি দান করেন বিক্রম ও বেতাল নামে দুই পিশাচকে। শোনা যায়, এই মন্দিরের মুখ আগে দক্ষিণ দিকেই ছিল কিন্তু রাজা তাঁর অলৌকিক শক্তির পরীক্ষাস্বরূপ বিক্রম-বেতালকে মন্দিরের মুখ উত্তরদিকে ঘোরানোর আদেশ দেন। সেই থেকেই এই মন্দিরের উত্তরমুখী।
তবে গনগনি যেহেতু একেবারেই অফবিট একটি জায়গা, তাই সেখানে থাকা বা খাবার ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নেই, গনগনিতে থাকার চেয়ে বরং থাকতে পারেন গড়বেতা শহরে, সেখানকার ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো।