অনলাইন শপিং না গড়িয়াহাট? কলকাতা বাঁচে কীসে?

Durga Puja 2023 Shopping Gariahaat: আসলে যুগ যতই শপিংমল কিংবা অনলাইন কেনাকাটার দিকে বাঁক নিতে থাকুক না কেন গড়িয়াহাট আছে গড়িয়াহাটেই।

ফুটপাতের উপর সারি সারি দোকান। দোকানিদের হাঁক, ক্রেতাদের ভ্রূ কুঁচকে সেরা পণ্য কেনা, ঘাম, ঠেলাঠেলি, খিদে পেরিয়ে আসছে পুজোর উচ্ছ্বাস। কলকাতায় পুজোর বাজার আসে রমরমিয়ে, গমগমিয়ে। ফুটপাতের ঘিঞ্জি দোকানগুলিতে উপচে পড়া ভিড় দেখে টের পাওয়া যায় দুর্গাপুজো আসছে। পুজোর সময় গড়িয়াহাটের চিরাচরিত চেহারা দেখে তাই ভিনরাজ্যের মানুষের চমকে যাওয়া স্বাভাবিক। রাস্তার ধারে বসে কেউ জামা, প্যান্ট, কেউ বা আবার ঝলমলে চুড়িদার বের করে দেখিয়ে চলেছেন ক্রেতাদের। ক্রেতারাও গলা সপ্তমে তুলে দর কষাকষি করছেন। 'না আপনার না আমার, ৫০০ টাকা ফাইনাল', 'এক রেট দিদি' জাতীয় বিক্ষিপ্ত শব্দগুচ্ছ কান ঘেঁষে চলে যাচ্ছে এদিক সেদিক। সকাল পেরিয়ে দুপুর হচ্ছে, দুপুর গড়িয়ে রাত; মানুষের মুখ পাল্টাচ্ছে, জামা কাপড়ের রঙ পাল্টাচ্ছে কিন্তু ভিড় সেই একই লেগে থাকে গড়িয়াহাটে, বলা ভালো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।

দক্ষিণ কলকাতার এই জমজমাট বাজারটি দুর্গাপুজো উপলক্ষে আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্র হয়ে ওঠে। পুজোর প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় কেনাকাটা। সকালের ঘুম কাটতে না কাটতেই থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে গড়িয়াহাটে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ভিড়। তবে এবারে কিন্তু এই পুজো পূর্ববর্তী কেনাকাটায় কিছুটা হলেও বাধ সেধেছিল অকাল বর্ষণ। গত কয়েক সপ্তাহের বৃষ্টির ঠেলায় বাঙালির 'পুজোর কেনাকাটা' শব্দটিই কেমন দিশাহারা হয়ে পড়ে। বর্ষার এই খামখেয়ালিপনার খেসারত দিতে হয়েছে গড়িয়াহাটের ফুটপাতে বসা সাধারণ বিক্রেতাদের। একেই বিভিন্ন অনলাইন বাজারের কারণে কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে এই গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট, হাতিবাগানের মতো সুপ্রাচীন বাজারগুলি। উপরন্তু 'পিক সিজন'-এ প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনা! অন্যান্য সকলের মতোই ভুক্তভোগী হয়েছেন গড়িয়াহাটের বিক্রেতা বিকাশ বণিক। এক খদ্দেরকে প্যান্ট দেখাতে দেখাতেই ইনস্ক্রিটের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। বৃষ্টির কারণে এই বছরের পুজোর বাজার কতটা প্রভাবিত হয়েছে? বিকাশ বললেন, “কার কী হয়েছে বলতে পারব না, তবে আমার ভাল রকম লস হয়েছে। জিনিস আনলাম; লোক আজকে কিনল না, কিন্তু দু'দিন পর বিক্রি হয়ে গেল। সেটা একরকম। কিন্তু এই বৃষ্টির কারণে আমার বেশ কয়েক হাজার টাকার জামাকাপড় নষ্ট হয়েছে শুধু। তবে বৃষ্টি থামায় মানুষ আবার বাজারে আসছেন এবং কেনাকাটা করছেন। যতটা আশা করেছিলাম ততটা লাভ না হলেও, আশা করছি ক্ষতিটা পূরণ করে ফেলতে পারব।” ক্রেতাদের একটা অংশই পুজোর বাজার অনলাইনে করেছেন। এতেও কিছুটা হলেও 'কাস্টমার লস' হয়েছে কি? বিকাশ জানান, “এটা সত্যি যে অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট আসার পর থেকেই মানুষের একটা অংশ অনলাইনে কেনাকাটা করতেই পছন্দ করেন। তবে অনলাইনে যেমন কিনছেন, তেমন আমার দোকানেও তো মানুষ আসছেন।”

আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়

একই সুর শোনা গেল, আরেক স্থানীয় বিক্রেতা হারান চক্রবর্তীর গলায়। তিনি বলছেন, “অনলাইন শপিংয়ের কারণে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে আমাদের ব্যবসায়। অনেকেই পছন্দ করেন এখন অনলাইনে কেনাকাটা করতে। তবে এখনও অনেক মানুষ এখানে বাজার করতে আসেন, চোখে দেখে, হাতে ধরে জিনিস কেনেন।” তবে হারানও মেনে নিচ্ছেন বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কিছুটা হলেও কমেছে ক্রেতার সংখ্যা। তাঁর কথায়, “ঝড়-বৃষ্টির কারণে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্রি-বাট্টা সেরকম হয়ইনি বলা যায়। আমি ক্যানিংয়ে থাকি। বর্ষার কারণে গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কিছুদিন দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। এবার ব্যবসা বন্ধ রাখলে তো আর ঘর চলবে না। তাই এখন সকাল সকাল খুলছি, রাত পর্যন্ত থাকব যতক্ষণ কাস্টমার দেখব। পুজোর আগের ক’দিন এমন চললেই হয়। আপাতত পুজো পর্যন্ত এদিকেই এক গোডাউনে থাকার ব্যবস্থা করেছি।”

তবে অনলাইন কেনাকাটাকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে নারাজ বাসুদেব শিকদার। বরং এই পদ্ধতিকে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে লাগানোর পক্ষে তিনি। বাসুদেব জানান, “এখন তো অনলাইনেরই যুগ। আজকাল তো হোয়াটসঅ্যাপেও অনলাইন স্টোর খোলা যায়। আমার এই দোকান দেখছেন, এর পাশাপাশি আমার মোবাইলেও দোকান আছে। আমার ছেলে মেয়ে মিলে হোয়াটসঅ্যাপে আমার স্টোর খুলে দিয়েছে। দোকানে যে জিনিসপত্র আছে ওখানে ক্যাটালগ করে রাখা আছে। এই গড়িয়াহাট চত্বরে অনেকে আমার অনেক পুরনো কাস্টমার আছে। প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে তারা আমায় চেনে, আমার জিনিস কেনে। এখন অনেকেই বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। মোবাইলে মেসেজ করে দেয় কোন কোন জিনিসটা দেখাতে হবে বা লাগবে, আমি সময় করে তাদের বাড়ি নিয়ে যাই জিনিসগুলি। তারা পছন্দ মতো কেনেন।”

অনলাইনের পাশাপাশি গড়িয়াহাট চত্বরেও তো তিন-চারটি বড় বড় শপিংমল রয়েছে। এই শপিংমলগুলো কিছুটা হলেও ব্যবসায় প্রভাব ফেলে না কি? বাসুদেবের মতে, এই শপিংমলের ক্রেতারা কখনই তাঁদের 'টার্গেট কাস্টমার' নয়। তিনি বলেন, “যাদের সময় নেই হাতে বিশেষ, টাকা দিতেও বিশেষ কার্পণ্য করেন না, তাঁরা শপিংমলে যান। তবে যারা একটু দেখে শুনে ভালো জিনিস ন্যায্য দামে কেনেন তারা এই গড়িয়াহাটেই আসেন। সুতরাং ওদের (শপিংমল) সঙ্গে আমাদের কম্পিটিশন সেরকম নেই।”

কথাবার্তার মাঝেই দেখা মেলে একদল কলেজ পড়ুয়ার, দল বেঁধে এসেছেন কেনাকাটা করতে। এই প্রজন্মের যুবক-যুবতী বা তথাকথিত Gen Z-র কাছে গড়িয়াহাটের আকর্ষণ কোথায়? অনলাইন শপিং কিংবা তাবড় তাবড় শপিংমল থাকতেও তারা এই বাজারেই কেন কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। প্রশ্ন করতেই এক যুবতীর সহাস্য জবাব, “করোনার সময় তো বাইরে বেরিয়ে কেনাকাটা করা যায়নি অত, তাই অনলাইনে জামা কিনেছিলাম। সাইজ দেখেই কিনেছিলাম কিন্তু তা সত্ত্বেও ফিটিং ঠিকমতো হয়নি। তারপরও বেশ কয়েকবার অনলাইনে কিনেছি কিন্তু কোনওবারেই ঠিক সেই সন্তুষ্টি পাইনি। এই ধরনের বড় বাজার থেকে জামাকাপড় কিনলে ফিটিং কিংবা গুণগত মান নিয়ে বিশেষ চিন্তা করতে হয় না। সেই কারণেই অনলাইনে থেকে আমি অফলাইনেই কেনাকাটা করতে বেশি পছন্দ করি।” পাশ থেকে তাঁর এক বন্ধুর সংযোজন, “তাছাড়া পুজোর সময়, বাজারে বেরিয়ে লোক দেখতে দেখতে কেনাকাটা করার একটা মজা আছে। কোথায় বাঁশ বাঁধা হচ্ছে, কোথায় হোর্ডিং লাগানো হচ্ছে, পুজোর জন্য কোন কোন রাস্তা দিয়ে বাস অন্য রুটে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এসব দেখতে বেশ লাগে। এসব অনলাইনে আর কোথায়?”

আরও পড়ুন- কীভাবে বাংলায় এল জনপ্রিয় ক্যাপ বন্দুক! অবাক করবে দুর্গাপুজোর এই খেলনার ইতিহাস

গড়িয়াহাট বা সমগোত্রীয় বড় বড় বাজারগুলিতে সাধারণত একই জায়গায় হরেক রকমের জিনিস পাওয়া যায়। সেসব মানুষ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী চোখে দেখে কেনেন। পুজো যত এগিয়ে আসছে, ততই ভিড় বাড়ছে বাজারগুলিতে। কলেজ কিংবা অফিস, দৈনন্দিন জীবন থেকে একটু সময় বের করে সকলেই ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন গড়িয়াহাটে। এইরকমই অফিস ফেরত এক তরুণী জানান, “আজ অফিসে হাফ-ডে ছিল। ডোভার লেনের কাছে আমার অফিস। তাই আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম ফিরতি পথে একবার গড়িয়াহাটের বাজার ঘুরে যাব। কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমি গড়িয়াহাটই পছন্দ করি। অনলাইনে বাড়িতে বসে জিনিসপত্র কেনাকাটা করা গেলেও ঠিক জিনিস সবসময় আসে না। তারপর ক্যান্সেলেশন, রিপ্লেসমেন্ট, রিফান্ড- এসব অনেক ঝামেলার। তার থেকে হাতে হাতে দেখে কিনে নেওয়াই ভালো।” তাহলে শপিংমল না বাজার? পছন্দ কোনটা? তরুণীর কথায়, “শপিংমলে অনেক জিনিসই ওভারপ্রাইসড কিন্তু ওই একই জিনিস এই বাজারে একটু খুঁজলে অনেক কম দামে পাওয়া যায়। ঠিকমতো দরদাম করলে অনেক সস্তায় ভালো জিনিস পাওয়া যায়। তবে হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে। নচেৎ তাড়া থাকলে শপিংমল তো আছেই। আর কোথাওই পাওয়া না গেলে শেষ পর্যন্ত অনলাইন ভরসা।”

আসলে যুগ যতই শপিংমল কিংবা অনলাইন কেনাকাটার দিকে বাঁক নিতে থাকুক না কেন গড়িয়াহাট আছে গড়িয়াহাটেই। বাজারের অবস্থা যাই হোক না কেন, আজও নিজের পসার বজায় রেখেছে দক্ষিণ কলকাতার এই বাজারটি। পুজোর ঠাকুর দেখতে শুরু করে দিয়েছেন অনেকেই। তবে এখনও বাজারের ভিড় কমেনি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ছে ভিড়। শেষবেলায় বাজারের জন্য এখনও বসে থাকেন অনেকেই। সেই ভিড় উজাড় হয়ে এসেছে পুজোর আগের শেষ রবিবারে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে পুলিশকর্মীদের। বৃষ্টি-দুর্যোগে যে বাজার মিইয়ে গেছিল, তা এই শেষবেলায় স্লগ ওভারে এসে চালিয়ে খেলছে বাঙালি।

More Articles