সন্দীপ ঘোষদের বাড়বাড়ন্তে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র হাত? এই প্রভাবশালীরা আসলে কারা?
North Bengal Lobby: সন্দীপের দুর্নীতি এবং সেদিনের সেই ভিডিওকে কেন্দ্র করে বারবার আরজি করের ঘটনায় চর্চায় এসেছে উত্তরবঙ্গ লবির প্রসঙ্গ। যে লবির দাপাদাপি নিয়ে অনেকদিন ধরে সরব ডাক্তারদের একটা বড় অংশও।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল এক তরুণী চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত দেহ। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল রাজ্য-দেশ। ঘটনার তদন্তভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। এমনকী সেই মামলায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করছে সুপ্রিম কোর্ট। ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে আরজি কর কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ভূমিকা নিয়েও। সেই সূত্রেই তদন্তকারীদের ব়্যাডারের তলায় চলে আসে সন্দীপ। তদন্ত করতে করতেই সামনে আসতে শুরু করে সন্দীপ ঘোষের একের পর এক দুর্নীতি।
হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ লোপাট থেকে শুরু করে হাসপাতালের জৈব বর্জ্য নিয়ে বেআইনি কারবারের মতো একাধিক দুর্নীতিমূলক কাজকর্মে লিপ্ত ছিলেন সন্দীপ ঘোষ। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় একটি ভিডিও। সেমিনার রুম থেকে যেদিন তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়, সেদিন ওই সেমিনার রুমে দেখা গিয়েছিল বড়সড় জমায়েত। তার মধ্যে অনেকেই ছিলেন সন্দীপ ঘোষ 'ঘনিষ্ঠ', যাদের কার্যত সেখানে থাকার প্রয়োজন সেদিন ছিল না। সে নিয়ে ইতিমধ্যেই উঠেছে প্রশ্ন। ভিডিওতে ভিড়ের মধ্যেই দেখা গিয়েছে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের তৎকালীন আপ্তসহায়ক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়,সন্দীপের আইনজীবী শান্তনু দে, হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিনের শিক্ষক দেবাশিস সোমের মতো ব্য়ক্তিকেই।
আরও পড়ুন: জোর তল্লাশি এবার আরজি করের মর্গে, কী খুঁজছেন সিবিআই গোয়েন্দারা?
সন্দীপের দুর্নীতি এবং সেদিনের সেই ভিডিওকে কেন্দ্র করে বারবার আরজি করের ঘটনায় চর্চায় এসেছে উত্তরবঙ্গ লবির প্রসঙ্গ। যে লবির দাপাদাপি নিয়ে অনেকদিন ধরে সরব ডাক্তারদের একটা বড় অংশও। কী এই উত্তরবঙ্গ লবি? সূত্রের খবর, স্বাস্থ্য দফতরে দীর্ঘদিন ধরেই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন ক্ষমতাসীন একদল চিকিৎসক। তাঁদের নির্দেশেই নাকি বকলমে চলছে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। প্রভাব এতটাই যে তাঁদের নির্দেশ ছাড়া পাশ হয় না স্বাস্থ্যদফতরের একটি সিদ্ধান্তও। এই লবিই পরিচিত উত্তরবঙ্গ লবি নামে। গত দশ বছরে স্বাস্থ্য-প্রশাসনে এই ‘লবি’ ক্রমশ জাঁকিয়ে বসেছে।
রাজ্যে তৃণমূল সরকার তখন ক্ষমতায় এসেছে বছর দুয়েক হবে। সে সময় একবার জলপাইগুড়িতে পরিদর্শনের এসে কাজে অনুপস্থিত ২০ জন সরকারি চিকিৎসককে সাসপেন্ড করে দেন তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিকর্তা। শাস্তিপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের তালিকায় ছিলেন বর্তমানে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ‘মেজো-কর্তা’ হিসাবে পরিচিত এক চিকিৎসকও। ঘটনাচক্রে, সে সময় উত্তরবঙ্গ সফরে ছিলেন রাজ্য সরকারের শীর্ষ কর্তারা। চিকিৎসকদের সাসপেন্ড হওয়ার খবর রাতারাতি কানে পৌঁছয় তাঁদের। এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকর্তার নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়। সেই থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ‘জয়যাত্রা’। এই উত্তরবঙ্গ লবির বিরুদ্ধে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ।
স্বাস্থ্য প্রশাসনে চালু কথা, ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র আশীর্বাদ থাকলে এক পড়ুয়াও রাতারাতি মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার তদারকির দায়িত্ব পেয়ে যেতে পারেন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এমডি-তে পড়াশোনা করা এক ডাক্তারি পড়ুয়াকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার পর্যবেক্ষক করা হয় শুধু ‘উত্তরবঙ্গ লবির লোক’ বলেই। স্বাস্থ্য দফতরের উত্তরবঙ্গ লবির আওতায় থাকা একাধিক চিকিৎসক পোস্টিং, বদলি সহ নানা বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে এই লবি। আর জি কর-কাণ্ডের পরে, ৪৩ জন চিকিৎসককে বদলির যে নির্দেশ হয়েছিল, যা পরে বাতিল হয়, তার নেপথ্যেও ছিল ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র হাত।
এই ‘লবি’র মূল কর্তা বলে পরিচিত রাজ্যের এক শীর্ষ কর্তার ঘনিষ্ঠ এক বর্ষীয়ান চিকিৎসক। যিনি সরকারি পদে ছিলেন না। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। রাজ্যে পট পরিবর্তনের পরে, জলপাইগুড়ির সুশান্ত রায় সে সময়ে উত্তরবঙ্গে সিপিএমের এক মন্ত্রীকে হারিয়ে বিধায়ক হওয়া আর এক চিকিৎসকের ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন। বছর খানেকের মধ্যে সে বিধায়ককে ছেড়ে সুশান্ত রায় যোগ দেন তৃণমূলের এক চিকিৎসক-নেতার ‘ঘনিষ্ঠ-বৃত্তে’। কিছুদিনের মধ্যেই সে শিবির ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সুশান্ত এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের পুনর্মিলন উৎসবে রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের প্রাক্তনী ওই বর্ষীয়ান চিকিৎসককে সম্মাননা দেওয়া হয়। সেখান থেকেই সুশান্তের সঙ্গে ওই প্রবীণ চিকিৎসকের সুসম্পর্ক ‘অন্য মাত্রা’ পায়। তাঁদের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকেরাই পর-পর স্বাস্থ্য-প্রশাসনের পদ পেতে থাকেন।
আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে উঠে বেসরকারি প্র্যাক্টিস করা অস্থি চিকিৎসক ডাক্তার শ্যামাপদ দাসের নাম। বদলি, পোস্টিং থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন ‘অনৈতিক’ কাজের নেপথ্যে অন্যতম নাম হিসেবে পরিচিত যিনি। রয়েছেন জলপাইগুড়ির অবসরপ্রাপ্ত চোখের চিকিৎসক ডা. সুশান্ত রায়। যাকে সেদিন দেখা গিয়েছিল হাসপাতালের সেমিনার রুমে। রয়েছেন এসএসকেএম-এ কর্মরত ডা. অভীক দে এবং বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডা. বিরুপাক্ষ বিশ্বাস। নাম রয়েছে বিধায়ক ও আরজি কর রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ডা.সুদীপ্ত রায়। আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডাক্তার সন্দীপ ঘোষ, ডাক্তার সুহৃতা পালও ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ।
ডাক্তাদের মধ্যে কানাঘুষো শোনা যায়, গড়িয়ার এক অর্থোপেডিক সার্জেনই হলেন এই উত্তরবঙ্গ লবির প্রধান নেতা। তিনি আবার নিজে সরকারি চিকিৎসক নন। থাকেন গড়িয়ায়। কিন্তু, তাঁর গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া কোনও চিকিৎসকের পোস্টিং থেকে কোনওরকম ফাইলই নাকি নড়াচড়া করে না। চিকিৎসক মহলের একাংশের দাবি, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া ছিলেন ওই চিকিৎসক। তিনি ওর তাঁর ‘ফলোয়ার্সদের’ মিলিত টিম নর্থ বেঙ্গল লবি নামে পরিচিত। মারাত্মক ক্ষমতাশালী এই লবির অন্তত সাত চিকিৎসকের মধ্যে এক চিকিৎসক জলপাইগুড়ির বাসিন্দা বলেও শোনা যাচ্ছে। আইএমএ-র প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আবার কয়েকজন চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখার দাবি করা হয়েছে।
চিকিৎসকেদের কেউ কেউ বলছেন, এই লবি আসলে অশরীরি আত্মা। বাস্তবে এদের প্রকাশ্যে দেখা যায় না। কিন্তু, রাজ্যের স্বাস্থ্যে নাকি শেষ কথা এই লবিই। সম্প্রতি একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিস্ফোরক অভিযোগ করেছে ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনও। সেখানেও বলা হয়েছে, আরজি কর কাণ্ডের পর আইএমএ-র তরফে ডাকা হয়েছিল ভার্চুয়াল বৈঠক। সেখানে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ বিরুদ্ধে সরবও হয়েছিল। অভিযোগ, দক্ষিণবঙ্গের এক মহিলা অধ্যক্ষকে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক বলে পরিচিত বীরুপাক্ষ বিশ্বাস ফোনে হুমকি দেন।
আরও পড়ুন:হাসপাতালে হাসপাতালে সিন্ডিকেট রাজ, কাকে কেন আড়াল করছে প্রশাসন?
এমনকী আরজি করের চিকিৎসক খুনের ঘটনা নিয়েও কাঠগড়ায় এই উত্তরবঙ্গ লবি। ঘটনার দিন তদন্তকে ভুল পথে চালিত করা, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করার অভিযোগ রয়েছে এই লবির বিরুদ্ধে। বারবার উঠে এসেছে সুশান্ত রায়ের প্রসঙ্গ। ঘটনার পর কেন তাঁকে আরজি করে আচমকা দেখা গেল সেই প্রশ্ন বারেবারে উঠেছে। চিকিৎসকদের কয়েক জনের দাবি, উত্তরবঙ্গ লবির মাথা সুশান্ত রায় আইএমএ-র গ্রুপে নিজে লিখেছিলেন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে আমরা এখানে এসেছি আমরা জেনেছি ঘটনার দিন রাত অবধি বহু লোকজন মিলে তৎকালীন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের অফিসে মিটিং করেছে। কিন্তু, তবু সন্দীপ ঘোষ মৃতার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। প্রশ্ন উঠেছে, কী এমন মিটিং চলছিল যে সেই সময় পেলেন না?
সব মিলিয়ে বকলমে স্বাস্থ্য দফতর পরিচালনা থেকে শুরু করে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মাথার উপর বসে ছড়ি ঘোরানোর কাজে সিদ্ধহস্ত এই উত্তরবঙ্গ লবি সাম্প্রতিক কালে চর্চায়। চিকিৎসক মহলের বড় অংশের দাবি, এই লবিকেও নিয়ে আসা হোক তদন্তের ব়্যাডারে। নাহলে আরজি করে চিকিৎসক খুনের তদন্ত সম্ভব হবে না বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের।