এক ঘুষিতেই রক্তারক্তি! মহিলাদের অলিম্পিক বক্সিংয়ে ইমানে খেলিফ সত্যিই পুরুষ?
Imane Khelif Paris Olympics boxing 2024: খেলা শুরুর মাত্র ৪৬ সেকেন্ড অতিবাহিত তখন। সজোরে ঘুষি এসে পড়ে অ্যাঞ্জেলার মুখে। নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত!
"এত জোরে জীবনে কেউ মারেনি আমায়"। কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলেছিলেন ইতালির বক্সার অ্যাঞ্জেলা ক্যারিনি। খেলা শুরুর মাত্র ৪৬ সেকেন্ড অতিবাহিত তখন। সজোরে ঘুষি এসে পড়ে অ্যাঞ্জেলার মুখে। নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত! আলজেরিয়ার ইমানে খেলিফের সঙ্গে ৬৬ কেজি বিভাগের বক্সিং থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন অ্যাঞ্জেলা। ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল এই মুহূর্তটিই।
এই ৪৬ সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাঞ্জেলা ক্যারিনিকে দু'বার আঘাত করা হয়েছিল। আশঙ্কা, নাক ভেঙে গিয়েছে অ্যাঞ্জেলার। লড়াই থেকে মাঝপথেই সরে আসা ছাড়া উপায়ও ছিল না। এই ঘটনার পর এই প্রতিযোগিতা কতখানি ন্যায্য তা নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। অনেকেই বলেন, ইমানে খেলিফ আসলে 'জৈবিকভাবে পুরুষ' এবং 'ট্রান্সজেন্ডার'।
আরও পড়ুন- Paris Olympics 2024: ছাই থেকে জেগে ওঠা এক আগুনের নাম সিমোন বাইলস
দেহে টেস্টোস্টেরনের উচ্চ মাত্রার কারণে ২০২৩ সালে নয়াদিল্লিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে অযোগ্য বলে ঘোষণা করা করা হয়েছিল ইমানে খেলিফকে। প্যারিস অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী তাইওয়ানের লিন ইউ-টিংকেও গত বছর অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। লিঙ্গ-যোগ্যতা পরীক্ষায় জানা গেছে যে খেলিফের XY ক্রোমোজোম রয়েছে, যা সাধারণত পুরুষদের মধ্যে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ নারীরই XX-সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। তারপরেই, ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উমর ক্রেমলেভ জানান, খেলিফ 'প্রতারণা' করছেন। তিনি নিজেকে 'মহিলা' প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
অযোগ্য প্রমাণ যখন হয়েইছিলেন সেক্ষেত্রে কেন ইমানে খেলিফকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হলো? এর কারণ বক্সিং প্রতিযোগিতার দায়িত্বে রয়েছে দু'টি ভিন্ন সংস্থা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পরিচালনা করে ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন বা আইবিএ। দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক সমস্যার কারণে আইবিএ-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বা আইওসি প্যারিসে বক্সিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে। দুই সংস্থার প্রতিযোগীদের জন্য আলাদা আলাদা 'মেডিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড' রয়েছে, তাই এমন বিতর্ক শুরু হয়েছে। আইওসি জানিয়েছে, যে খেলিফ এবং লিন দু'জনেই যোগ্য প্রতিযোগী ছিলেন।
আইওসি-র মুখপাত্র মার্ক অ্যাডামস বলেছেন, এই দুই প্রতিযোগীই তাদের পাসপোর্ট অনুযায়ীও মহিলা, তারা মহিলা হিসেবেই টোকিও অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং বহু বছর ধরেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন।
এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা সংক্রান্ত নির্দেশিকাতে আইওসি-র সাম্প্রতিক পরিবর্তন। ক্রীড়াবিদদের আর প্রতিযোগিতায় নামার জন্য হরমোন-স্তরের পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। আইওসি আরও বলেছে, টেস্টোস্টেরন সবসময় শারীরিক সুবিধার নির্ধারক নয়।
View this post on Instagram
খেলিফ প্রথমদিকের জীবনে আলজেরিয়ার গ্রামের রাস্তায় রুটি বিক্রি করতেন। ২০২০ টোকিও অলিম্পিক সহ বহু বছর ধরেই বিশ্বব্যাপী বক্সিং ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। ইমানে খেলিফ নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স হিসাবে চিহ্নিত করেন না। ইমানে আইওসি-র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েই লড়াইয়ে নামেন। যদিও লেখিকা জেকে রাউলিং, যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস থেকে শুরু করে অনেকেই ইমানের বিরোধিতাই করেছেন। তাঁদের যুক্তি, ইমানে শারীরিকভাবে পুরুষ। তাই মহিলা প্রতিযোগীর সঙ্গে তাঁর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথাই না। তিনি প্রতারণা করেছেন। ডিফারেন্স অফ সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্ট (ডিএসডি) বিষয়টিকে ঘিরে তাই বিতর্ক শুরু করেছে।
ডিএসডি কী? সহজ করে বলতে গেলে, ডিফারেন্স অফ সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্ট হলো এমন এক বিরল অবস্থা যেখানে মহিলা হিসাবে বেড়ে ওঠা মানুষদের দেহে XY সেক্স ক্রোমোজোম (যা পুরুষদের থাকে) এবং পুরুষের দেহের মতোই টেস্টোস্টেরনের মাত্রা রয়েছে। এই মহিলাদের পেশী ভরও বেশি, আরও নানা শারীরিক সুবিধা তাঁদের থাকে। সাধারণত জন্মের সময় থেকেই যৌনাঙ্গেও এদের পার্থক্য থাকতে পারে। সুতরাং, বক্সিং-এর মতো মারামারি, আহত হওয়ার খেলায়, এটি একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে।
আরও পড়ুন- নেই স্পেশাল চশমা, পকেটে হাত ভরেই যেভাবে অলিম্পিকে রুপো জিতলেন ৫১-র যুবক
আইওসি-র নিয়ম বলছে যে ডিএসডি রয়েছে এমন অ্যাথলেটদের অন্তর্ভুক্তিতে বাধা নেই। একমাত্র স্বচ্ছতা বা নিরাপত্তার সমস্যা থাকলেই কেবল তাদের মহিলাদের প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া উচিত। এই বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। টেস্টোস্টেরনের মাত্রার বিষয়টি এর আগে কাস্টার সেমেনিয়ার ক্ষেত্রেও বিতর্কের জন্ম দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার দৌড়বিদ সেমেনিয়া ২০১২ এবং ২০১৬ সালের অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। তাঁকে ২০২০ সালের অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়া হয়। কারণ তখন দেখা যায়, তাঁর শরীরে মহিলাদের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রার টেস্টোস্টেরন তৈরি হয়।
শনিবার লাইট ওয়েল্টারওয়েট বিভাগের কোয়ার্টার ফাইনালে বক্সিং রিংয়ে ফিরবেন খেলিফ। এবার তাঁর প্রতিপক্ষ হাঙ্গেরির আনা লুকা হামোরি। তবে, অ্যাঞ্জেলার আহত হওয়ার ঘটনা এবং নিজেকে কাঁদতে কাঁদতে লড়াই থেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে অলিম্পিক ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত মুহূর্ত হয়ে থাকবে।