অলড্রিচ এমস: আমেরিকার ইতিহাসে সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচর আজও জেলে
Spy Aldrich Ames: এই মুহূর্তে, ২০২৫ সালে, ৮৩ বছর বয়সি এমস ইন্ডিয়ানার এক কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবন, বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ এবং পতনের গল্প ইতিহাসের পাতায় এক অন্ধকার দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে গেছে।
আজ থেকে তিন দশক আগের এক শীতসকাল। ভার্জিনিয়ার আরলিংটনের নিরিবিলি এক রাস্তায় আচমকা নেমে এল এফবিআই-এর ঝড়। হুঁশিয়ার চোখ, দৃঢ় পদক্ষেপ— তারা এসে ধরপাকড় চালাল আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম প্রখ্যাত (বলা চলে কুখ্যাত) গুপ্তচরের বাড়িতে। গ্যারেজে রাখা জাগুয়ার গাড়ির ভিতর থেকে টেনে রাস্তায় বের করে এনে পরানো হলো হাতকড়া। গ্রেফতার হলেন সিআইএ-র অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতক তথা তৎকালীন সময়ের সবথেকে বিখ্যাত ডবল এজেন্ট অলড্রিচ 'রিক' এমস। প্রায় এক দশক ধরে তিনি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার হৃদপিণ্ড থেকে সবচেয়ে গোপনীয় তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এর ফলে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছিল অন্তত দশজন আমেরিকান গুপ্তচরকে— যারা মস্কোর ছায়ায় থেকেও ওয়াশিংটনের পক্ষে কাজ করছিলেন। এ এমন এক বিশ্বাসঘাতকের কাহিনি, যিনি লোভ ও আত্মকেন্দ্রিকতার কাছে বিকিয়ে দিয়েছিলেন সহস্র প্রাণ ও একটি রাষ্ট্রের গোপন কাঠামো।
সরষের মধ্যেই ভূত
অলড্রিচ এমসের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬ মে, উইসকনসিনের রিভার ফলস শহরে। শৈশব থেকেই গোয়েন্দা দুনিয়ার বাতাস লেগেছিল এমসের গায়ে। বাবা কার্লটন এমস ছিলেন সিআইএ-র ডিরেক্টরেট অব অপারেশনসের একজন কর্মকর্তা। ১৯৫২ সালে পরিবারের সঙ্গে এমস ল্যাংলি, ভার্জিনিয়ায় পাড়ি দেন এবং পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দুই বছর কাটান। কিন্তু অত্যধিক মদ্যপানের কারণে কর্মজীবনে ধস নামে অলড্রিচের বাবার। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থায় নিজের পদ হারান তিনি। বাবার মতোই অলড্রিচও একসময় নেশার কবলে পড়েন কিন্তু তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ভিন্নভাবে।
তবে, পদ খোয়ানোর আগেই নিজের ছেলের জন্য জায়গা তৈরি করে রেখেছিলেন এমসের বাবা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিআইএ-র গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করেন এমস। চাকরি হিসেবে নথিপত্র বিশ্লেষণের দায়িত্ব পান। ওই চাকরিতে যে নথিপত্র নিয়ে তাঁকে কাজ করতে হতো তার মধ্যে বেশ কিছু এমন নথি ছিল যেখানে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থার গোপন অভিযানের তথ্য মজুত ছিল। তবে সেই সময় এই নথি সোভিয়েত ইউনিয়নের হতে তুলে দেননি এমস। সেই সময় তাঁর যৌবনের উচ্ছ্বাস চরমে। ১৯৬০-এর সময়কালে তখন আমেরিকায় চলছে কাউন্টার কালচার মুভমেন্টের যুগ। বৈকল্পিক জীবনধারা, নাগরিক অধিকারের আন্দোলন, রক মিউজিকের আমদানি, মাদক দ্রব্যের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং 'ক্যাজুয়াল সেক্স'-এর স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে আমেরিকার যুব সমাজ তখন এক মোহে আবদ্ধ। এই একই মোহ ঘিরে ধরে এমসকেও। মঞ্চনাটকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে শুরু করেন যুবক এমস। নাটক ও সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করার পরিকল্পনা করেন এবং সেই তাগিদেই ছেড়ে দেন আমেরিকান গুপ্তচর সংস্থার চাকরি।
আরও পড়ুন-উল-কাঁটার নকশায় গোপনে খবর পাচার! বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হয়ে উঠেছিলেন বাড়ির মেয়েরাই
তবে ইচ্ছা থাকলেও অভিনয়ের দিকে এমসের দক্ষতা ছিল না একটুও। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে ভর্তি হলেও অভিনয়ের অডিশনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন ল্যাংলিতে, আবারও সিআইএ-র ছত্রচ্ছায়ায়। ইতিহাসে স্নাতক হন। তবে নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন, মদ্যপান এবং একাধিক অপরাধমূলক ঘটনার কারণে তাঁর প্রতি সন্দেহ দানা বাঁধে। তবুও, ১৯৬৭ সালে সিআইএ-র কেরিয়ার ট্রেইনি প্রোগ্রামে সুযোগ পেয়ে যান এমস। এটিই পরবর্তীতে এক মহাধ্বংসের পথ খুলে দেয় এমসের সামনে।
প্রথমে তুরস্কে নিয়োগ হলেও সেখানে খুব একটা সফল হতে পারেননি এমস। সিআইএ তাঁকে আরও প্রশিক্ষণ দেয়। নিজেদের তাগিদেই এমসকে রাশিয়ান ভাষা শেখায় আমেরিকা। তারপর নিউ ইয়র্কে কাজ করার সময় উচ্চপদস্থ সোভিয়েত গুপ্তচরদের পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং সেখানে বেশ সাফল্য পান এমস। ১৯৮১ সালে মেক্সিকো সিটিতে বদলি হওয়ার পরই এমসের ব্যক্তিগত জীবনে ভাঙন শুরু হয়। প্রথম স্ত্রী ন্যান্সির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয় একাধিক পরকীয়ার কারণে। নতুন প্রেম আসে জীবনে— মারিয়া দেল রোসারিও, এক কলম্বিয়ান কূটনীতিক, যিনি এমসের ভবিষ্যতের নিয়তি একেবারেই পাল্টে দেন। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের পাশাপাশি এমস ছিলেন অতিরিক্ত মদ্যপায়ী। এর কারণে বেশ কয়েকবার তাঁকে গভীর সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কিউবার অফিসিয়ালদের সঙ্গে বৈঠকের সময় একবার এমন মদ্যপান করে পৌঁছেছিলেন যে তারপরই এমসকে ফিরিয়ে আনা হয় নিউ ইয়র্কে। ১৯৮৩ সালে এমস নিযুক্ত হন নতুন পদে। এবারে তাঁর দায়িত্ব হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে নজর রাখা এবং সিআইএ সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কী করছে সেই ব্যাপারেও নজরদারি করা। আর এখান থেকেই জন্ম হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতকের।
ঠান্ডা লড়াই ও এমসের বিশ্বাসঘাতকতা
বিশ্ব ইতিহাসে গুপ্তচরবৃত্তি সবসময়ই এক রহস্যময় ও দৃষ্টিনন্দন অধ্যায়। বিশেষত, বিংশ শতকের ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়কাল এই রহস্যের তীব্রতাকে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র— দুই পরাশক্তির মধ্যে চলতে থাকা ছায়াযুদ্ধের এক বিপজ্জনক হাতিয়ার ছিল মানব গোয়েন্দা বা 'হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স'। সেই ঠান্ডা যুদ্ধের ময়দানে, অলড্রিচ এমস ছিলেন এমন এক মার্কিন গুপ্তচর, যিনি নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সোভিয়েত কেজিবির হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমেরিকার অমূল্য গোয়েন্দা সম্পদগুলির নাম ও পরিচয়।
১৯৮৫ সাল। হঠাৎ করেই একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েত কর্মকর্তা, যাঁরা মার্কিন গোয়েন্দাদের জন্য কাজ করছিলেন, ধরা পড়তে শুরু করলেন। কেউ নিখোঁজ, কেউ গ্রেফতার, কারও ফাঁসিও হয়।
দিমিত্রি পলিয়াকভ— যিনি আমেরিকার চোখে ছিলেন ‘ক্রাউন জুয়েল’— ১৮ বছরের তথ্যসেবার পরে ধরা পড়েন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। আদলফ টলকাচেভ— যাঁকে ‘বিলিয়ন ডলার স্পাই’ বলা হতো— তিনিও হারিয়ে গেলেন সোভিয়েত রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির অন্ধকার কুঠুরিতে। একই সঙ্গে প্রায় ৩০ জন মার্কিন গুপ্তচর কর্মী, যাঁরা অবসর নেওয়ার পরও রাশিয়ায় থেকে আমেরিকার পক্ষে কাজ করছিলেন, ধরা পড়েন বা অদৃশ্য হয়ে যান। এই রহস্যময় ঘটনার পরেই সিআইএ-র অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন যে, তাঁদের ভেতরেই আছে একজন ‘মোল’— একজন ডবল এজেন্ট, যে নিজের দেশের তথ্য অন্য দেশের কাছে বিক্রি করছে।
আরও পড়ুন-একসঙ্গে চার দেশের গুপ্তচর! নেতাজিকে বর্ডার পার করানো এই ‘স্পাই’ ছিলেন বাস্তবের জেমস বন্ড
সন্দেহের সঞ্চার ও তদন্তের সূত্রপাত
ডবল এজেন্টের উপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই সিআইএ নিজেদের তদন্ত সংস্থার কর্মীদের উপর তদন্ত শুরু করে। সিআইএ-র অভিজ্ঞ কর্মকর্তা জিন ভার্টিফ্রে ও সান্দ্রা গ্রাইমসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল গঠিত হয়। সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন ১৯৮ জন, যাঁদের কাছে ছিল সোভিয়েত সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার সুযোগ। একে একে তাঁদের আচরণ, আর্থিক অবস্থা, পেশাগত জীবন— সব খতিয়ে দেখা শুরু হয়। সেই ১৯৮ জন সন্দেহভাজন কর্মীদের একটি বিশেষ প্রশ্ন করেন জিন ভার্ট্রিফ্রে,
"আপনি যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে স্বেচ্ছায় গুপ্তচর হয়ে যেতে চাইতেন, তাহলে কীভাবে যোগাযোগ করতেন?"
বাকিরা নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেও রিক এমস এই প্রশ্নে থমকে যান, জবাব দেন অস্পষ্টভাবে। অথচ তিনি ছিলেন সবসময়ই কথার খেলোয়াড়, যিনি 'হাইপোথেটিকাল' প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিতে অভ্যস্ত, তাঁর অসঙ্গত আচরণ নজরে আসে তদন্তকারীদের। আরও খুঁটিয়ে দেখা হলে, একটি অবাক করা তথ্য সামনে আসে— রিক এমসের জীবনযাত্রা হঠাৎ করেই বিলাসবহুল হয়ে উঠেছে। রিকের রয়েছে একটি জাগুয়ার গাড়ি, বিশাল এক বাড়ি এবং তাঁর স্ত্রী প্রতি মাসে শুধুমাত্র নিজের উপরই খরচ করছেন লাখ লাখ ডলার। শুধুমাত্র সরকারি বেতনে এইসব হচ্ছে কীভাবে? ন্যান্সির সঙ্গে যখন তাঁর বিবাহিত জীবন ঠিকঠাক ছিল তখন কিন্তু এসব কিছুই ছিল না। এই সব কিছুই রিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তীব্র করতে শুরু করে।
বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার শুরু
রিকের দ্বিতীয় স্ত্রী মারিয়া রোজারিও ধনী পরিবারের উত্তরসূরি ছিলেন এবং অতিরিক্ত টাকার আকাঙ্খা ছিল বরাবরের। সংসারের এই চাপ, বিলাসের চাহিদা ও নিজের দুর্বলতা— সব মিলে এমস তখন অনেকটাই চাপে পড়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৫ সাল, ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তাল সময়। তখন সিআইএ-র সোভিয়েতবিরোধী অপারেশন বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন এমস। সোভিয়েত রাশিয়া তখন আমেরিকাকে পরাস্ত করার জন্য সমস্ত উপায় অবলম্বন করতে শুরু করেছে। এখানেই এক সুযোগ পেয়ে গেলেন এমস। নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কেজিবির সঙ্গে হাত মেলালেন এমস। এপ্রিল মাসে, কেজিবি-র একজন সংযোগকারীর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করলেন তিনি। একটি ক্যাফেতে তাঁদের প্রথমবার দেখা হয় এবং সেখানেই এমস ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে তুলে দেন ২০ জন মার্কিন গুপ্তচরের নাম। তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে অন্তত ১০ জন প্রাণ হারান। এর পরবর্তী বছরগুলোতে এমস বারবার সোভিয়েত রাশিয়ার হাতে তথ্য তুলে দেন, ধাপে ধাপে ধ্বংস হতে থাকে সিআইএ’-র ‘হিউম্যান সোর্স নেটওয়ার্ক’। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রিক এমস আমেরিকার অন্তত ১০০টি গোয়েন্দা অপারেশন বিপর্যস্ত করে দেন।
তিনি সোভিয়েত ও পরে রুশ গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেন আমেরিকার সবচেয়ে সংবেদনশীল নথিপত্র, শীর্ষ গুপ্তচরদের নাম ও কৌশলগত পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ। তাঁর দুঃসাহসিকতা এতটাই ছিল যে দিনের আলোয় রাশিয়ান অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করে ফিরে এসে নিজের অ্যাকাউন্টে নগদ টাকা জমা দিতেন। ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায়, একটি বৈঠকের পরদিনই তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৯ হাজার ডলার। এই ‘ডেড ড্রপ’ সিস্টেম এবং প্রত্যক্ষ লেনদেনের মাধ্যমে তিনি বছরের পর বছর ধরে অর্থ উপার্জন করতে থাকেন।
মাত্র দুই মাসের মধ্যে, তিনি কেজিবি-কে এমন কিছু গোপন তথ্য সরবরাহ করেন, যা ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক বিশ্বাসঘাতকতাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ— কেজিবি বিদ্যুৎগতিতে আমেরিকার গুপ্তচরদের চিহ্নিত করে এবং একের পর এক ধরে ধরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
আরও পড়ুন-লাস্য, যৌনতা আর ৫০ হাজার মৃত্যুর দায়! বিশ্বের ভয়াবহ এই গুপ্তচরের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
সিআইএ-র কিস্তিমাত
প্রথমদিকে সিআইএ এমসের অস্বাভাবিক সম্পদ নিয়ে সন্দেহ করেনি। তিনি গল্প ফেঁদেছিলেন যে, তাঁর শ্বশুরবাড়ি কলম্বিয়ায় বিত্তশালী। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে দুইবার পলিগ্রাফ পরীক্ষায় পাশও করেন তিনি, যা সিআইএ-র তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করে। পলিগ্রাফে পাশ করলেও এমসের হঠাৎ আসা সম্পদ নিয়ে সন্দেহ একেবারেই কাটেনি সিআইএ-র।
১৯৯৩ সালে, সিআইএ ও এফবিআই যৌথভাবে তাঁর ওপর ১০ মাস ধরে নজরদারি চালায়। বাড়ির ডাস্টবিন পর্যন্ত ঘেঁটে দেখা হয়। ফোন ট্যাপ করা হয়। তাঁর গাড়ি অনুসরণ করতে ছোট বিমান ব্যবহার করা হয়। তারপর, ১৯৯৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে, তাঁকে তাঁরই জাগুয়ার গাড়ি থেকে টেনে বের করে হাতকড়া পরানো হয়।
পরদিন খবর ছড়িয়ে পড়ে। গোটা ওয়াশিংটনে আলোড়ন। এমনকী যে সাধারণ ডাকবাক্সে এমস তাঁর গুপ্তচর সংকেত রেখে যেতেন, সেগুলোর সামনেও মানুষের ভিড় জমে যায়। ১৯৯৪ সালের ২৮ এপ্রিল, আদালতে দাঁড়িয়ে এমস নিজের অপরাধ স্বীকার করেন।
এমস বলেন, "আমি যা কাজ করেছি আমি সব স্বীকার করছি কিন্তু আমি এটাও জোর গলায় বলতে পারি আমি একা নই। এই কাজ অনেকেই করেন। আমি শুধু টাকার জন্য করেছিলাম। আমি যা করেছি, তা শুধুই লোভের কারণে। টাকার লোভ সব মানুষেরই থাকে। আর আমি যে টাকা পেয়েছিলাম সেইটাকে আমি আমার প্রাপ্য বলেই মনে করেছিলাম।"
স্ত্রী রোসারিও স্বীকার করেন যে তিনি জানতেন তাঁর স্বামী রাশিয়ার কাছ থেকে নগদ অর্থ পাচ্ছেন। রোসারিও কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পান আর এমসের সাজা হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড। এই মুহূর্তে, ২০২৫ সালে, ৮৩ বছর বয়সি এমস ইন্ডিয়ানার এক কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবন, বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ এবং পতনের গল্প ইতিহাসের পাতায় এক অন্ধকার দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে গেছে। একবার এক সাক্ষাৎকারে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "আপনি যদি দশ বছর আগে সিআইএ ছেড়ে দিতেন, তাহলে কি জীবন অন্যরকম হতে পারত?" এমস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, "হয়তো! তাহলে আমার ছেলে তাঁর বাবা-মাকে একসঙ্গে পেত। আমার স্ত্রী একজন স্বামী পেতেন!" তারপর আর কিছু বলেননি এমস।
রিক এমসের কাহিনি ঠান্ডা যুদ্ধের এক অন্ধকার প্রতিচ্ছবি। এ শুধু একজন গুপ্তচরের গল্প নয়— এ লোভ, আত্মঘাতী অহংকার, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসের চূড়ান্ত ভঙ্গুরতার গল্প। পুঁজিবাদী এক সমাজে বেড়ে ওঠা এমস কোনও রাজনৈতিক আদর্শের জন্য নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি— তিনি শুধু চেয়েছিলেন অর্থ, ক্ষমতা ও প্রশান্তি। গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে অনেক বিশ্বাসঘাতকেরই নাম এতদিনে উঠে এসেছে কিন্তু খুব কমজনই অলড্রিচ রিক এমসের মতো এত সুপরিকল্পিতভাবে, এত নির্মমভাবে একটি গোটা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পেরেছেন। তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দেশের জন্য কাজ করা মানেই কেবল দেশপ্রেম নয়—তা একটি নৈতিক দায়িত্ব, যা একবার ভঙ্গ হলে ক্ষতি শুধু রাষ্ট্রের নয়, গোটা মানবতার।