স্বদেশি আন্দোলনের উত্তরাধিকার, ১০০ কোটির নস্টালজিয়ার নাম পার্লে-জি
সকাল হতেই দুধের গ্লাস হাতে মা ছুটছেন সন্তানদের পিছনে। জোর করে দুধ বিস্কুট খাইয়ে দিচ্ছেন সন্তানকে। ব্যাস আর খাওয়ার চিন্তা নেই ! বা বন্ধুদের চা-বিস্কুট সহযোগে অফুরান আড্ডা- নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা মানুষের এসব স্মৃতি মনে আসতেই হলুদ প্যাকেটে মোড়া পার্লে-জি বিস্কুটের কথা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। একটা বিস্কুট কী ভাবে মানুষের জীবনের বহতার সাথে মিশে যেতে পারে তার আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। দিল্লী নিবাসী স্বস্তিকা জজ্জুর ঠাকুরদা বয়সজনিত সমস্যায় ভর্তি হাসপাতালে। নাকে পড়ানো রয়েছে নল। আবছা হয়ে আসছে জীবন স্মৃতি।সুস্থ হয়ে উঠে তিনি প্রথম কি খেতে চান প্রশ্ন করায় তাঁর উত্তর," পার্লে-জি ও চা"। হাসপাতাল থেকে ফিরে তেমনটাই করেছিলেন স্বস্তিকার ঠাকুরদা। সমঝদার মাত্রই জানেন, এমনটাই পার্লেজির ব্র্যান্ড ইমেজ। সময়ের সঙ্গে ব্যাবসায় লাভের পরিমাণ কমলেও কমেনি পার্লে-জি বিস্কুটের জনপ্রিয়তা। আট থেকে আশি তাকে ভরসা করে।
ইংরেজ শাসনকালে ব্রিটেন থেকে আমদানি হতো ক্যান্ডি ও বিস্কুট। ভারতীয় বাজারে সেগুলি বিক্রি হত চড়া দামে যা সাধারণ ভারতবাসীর কাছে ছিল সাধ্যের অতীত। তাই ১৯২৯ সালে ভারতের সাধারণ মানুষের জন্য প্রথম বিস্কুট নিয়ে আসেন পার্লে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মোহনলাল দয়াল। তিনি ছিলেন মূলত রেশম ব্যবসায়ী। স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই বেকারির ব্যবসা শুরু করেন। জার্মানি থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ শেষে সেই সময় ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ক্যান্ডি মেশিন কিনে দেশে ফেরেন মোহনলাল।মুম্বইয়ের ইরলা ও পারলা নামে দুই গ্রামের মাঝে একটি পুরনো কারখানা কিনে ১২ জন পরিবারের সদস্য নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। মজার বিষয় হল এই জায়গার নাম খানিক বদলেই কোম্পানির নাম রাখা হয় পার্লে। প্রথম পথ চলা শুরু হয় অরেঞ্জ ক্যান্ডি দিয়ে।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটের সময়ে প্রথম পার্লে বিস্কুট তৈরি করেন মোহনলাল। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মোহনলালকে। স্বদেশি বাজারে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই বিস্কুট। দামে কম , মানেও ভালো পার্লে অল্প সময়েই ভারতবাসীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণঅংশ হয়ে ওঠে।লোকসান হতে শুরু করে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর। তবে চলার পথে চরাই উৎরাই এসেছে অনেক। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর দেশে গমের সংকট তৈরি হলে বন্ধ হয়ে যায় বিস্কুটের উৎপাদন। কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? পার্লের অভাব বোধ করতে শুরু করেন প্রত্যেক ভারতবাসী। অবশেষে ১৯৮২ সালে ভারতের বাজারে কামব্যাক করে পার্লে গ্লুকো। তবে গ্লুকো শব্দের পেটেন্ট না থাকায় ততদিনে বাজার ছেয়ে গেছে একাধিক গ্লুক বিস্কুটে। ফলে খানিক নাম বদলে হল পার্লে- জি। ট্যাগলাইন জি ফর জিনিয়াস।পার্লে-জির প্যাকেজিং নিয়েও মানুষের কৌতূহল ছিল চোখে পড়ার মতোই। যদিও হলুদ প্যাকেটের ওপর ছোট্ট শিশুর পরিচয় আজও অজানাই থেকে গেছে।
আরও পড়ুন-বিরাট বিতর্কই প্রথম নয়, ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কের নৌকা টলমল হয়েছে বারবার
একের পর এক মাইলস্টোন পার করেছে এই বিস্কুট উৎপাদনকারী সংস্থা। ২০০৩ সালে বিশ্বের এক নম্বর বিস্কুট কোম্পানির শিরোপা পায় পার্লেজি। বাজার সংক্রান্ত গবেষণাকারী সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭সালে এই সংস্থার বাজারদর ছিল প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।অনুমান করা হয় প্রতি ঘণ্টায় এক কোটিরও বেশি পার্লে বিস্কুট খায় ভারতবাসী এবং প্রতি মাসে এক বিলিয়ন প্যাকেট বিস্কুট বিক্রি হয় । ধারাবাহিক ভাবে ভারতের সবচে-য়ে স্থায়ী ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে পার্লেজি। ফার্জি ক্যাফের মত অভিজাত রেস্তোরাঁর মেনুতে পার্লে-জি চিসকেক ,পার্লেজি মিল্কশেক-এর মত একাধিক রেসিপি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৩৮ থেকে ২০২১-- বাজারের সাথে পাল্লা দিতে মোনাকো, হাইড অ্যান্ড সিক, ক্র্যাক জ্যাক, ২০-২০ কুকিস, মিলানোর মত ভিন্ন স্বাদের নতুন নতুন বিস্কুট নিয়ে এসেছে এই সংস্থা।তবে ২০১৭ সালে জিএসটি চালু হতেই মন্দার মুখোমুখি হয় কোম্পানি। কর্মী ছাঁটাই,ফ্যাক্টরি বন্ধ করা থেকে শুরু করে প্রতি প্যাকেটে বিস্কুটের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার মত কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সংস্থা।ফলে চাহিদার গ্রাফও নামতে শুরু করে বিশেষত গ্রামীণ ভারতে। তবে করোনা অতিমারির কারণে যখন বিশ্ব বাজার মন্দার সম্মুখীন তখন শেয়ার বাজারে পাঁচ শতাংশ মুনাফা বাড়িয়েছে পার্লে। পার্লে প্রোডাক্টস এর অন্যতম শীর্ষকর্তা মায়াঙ্ক শাহ জানিয়েছিলেন যে এই মুহূর্তে দেশের মোট বিস্কুটের বাজারের প্রায় ৩২ শতাংশ রয়েছে পার্লে-জির দখলে।
অতিমারী ফের একবার ভারতবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে পার্লেজি ছিল, আছে আর থাকবে। হয়তো বাধা আসবে আরো অনেক, আসবে নিত্যনতুন সংস্থা। কিন্তু দরিদ্রের হাতের সম্বল পার্লে জি। ভারতের মন চিনেছে সে। কে না জানে জিনিয়াস যে সে কখনও হারিয়ে যায় না বাজার থেকে।