পাঠান: তোমায় পুজোর ছলে নতুন করে পড়ি

Pathan Movie Review: এই ছবিতে ভাইজানের ক্যামিও কার্যত আগুন লাগিয়ে দিয়েছে স্ক্রিনে! মানিকজোড় থুড়ি শাহরুখ-সলমানের একসঙ্গে অ্যাকশন, তাও আবার বড় পর্দায়- স্বর্গীয় অনুভূতি।

মুক্তি পেয়েছে পাঠান। অনেকদিন পর দেশ জুড়ে একটা ছবিকে ঘিরে একই রকমের উন্মাদনা। প্রত্যেক দিন বক্স অফিসে নতুন নতুন রেকর্ড ভাঙছে এবং গড়ছে পাঠান। দক্ষিণি ছবিগুলিও পিছিয়ে পড়ছে পরিসংখ্যানে। সকলেই যখন বলিউডকে ডুবতে থাকা জাহাজ বলে কটাক্ষ করছিল, ঠিক তখনই বাদশাহ-র আবির্ভাব, যেন নোয়ার নৌকোয় চড়ে ঈশ্বর পরিত্রাণে হাজির। এই পাঠান মুক্তি পাওয়ার আগে কম হুজ্জুতি হয়নি। বয়কটের ডাক এসেছিল নানা মহল থেকে। দীপিকার বিকিনির রং গেরুয়া কেন, এই সওয়াল তুলে রে রে করে এসেছে গৈরিকবাহিনী। কিন্তু যা চরিত্রে অখণ্ড, তাকে শত কুঠারাঘাতে ভাঙতে চাইলেও ভাঙা যাবে না, প্রমাণ মিলল পাঠান বাজারে আসতেই। বয়কট গ্যাংকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল শাহরুখ ভক্তরা। রবরবা মুহূর্তে ফুস্। গোটা দেশ বিনিসুতোর মালায় এক একটা পুঁতির মতো গেঁথে গেল, প্রতিটিই পুঁতিই বাদশাহের নামে তদগত। পাঠান মুক্তির আগে প্রোমোশনের জন্য এক অভিনব স্ট্রাটেজি নিয়েছিলেন নির্মাতারা। আজকাল লোকে সামান্যতম কীর্তিও গণমাধ্যমে, সমাজমাধ্যমে ঢাক পিটিয়ে বলে। কিন্তু খেলা ঘোরাতে উল্টোস্রোতে হাঁটতে শুরু করেছিলেন বাদশাহ। ছবিটির কোনও প্রোমোশনই করেননি তাঁরা। সিঁদুরে মেঘ, কখন বৃষ্টি নামবে বোঝা যাচ্ছে না। এই বোধটা সংক্রমিত হচ্ছিল, ভক্তরা স্থিরবিশ্বাসে অটল তখনও, আর নিন্দুক ঈষৎ কপাল কুঁচকে আরও একটা পতনের অপেক্ষায়। অতঃপর তিনি এলেন। অধরামাধুরী হয়ে, ঈষৎ তফাতে দাঁড়িয়ে, কিস্তিমাত করতে চাইছিলেন ৫৭ বছর বয়সে। জীবন দেখেছেন তিনি, সকলেই দেখে, কিন্তু তিনি কিছু বেশিই দেখেছেন, প্রগলভ হননি, মৌনতার শক্তিতে বুঝে নিতে চেয়েছেন, কোন কথার কোন মানে। ফলে তিনি জানতেন, এই সবুরে মেওয়া ফলবে। ফেটে পড়ে মুক্তির দিন সকালেই। হলও তাই। খবররের কাগজগুলি ঢাক পেটাতে শুরু করল। দেখা গেল সিটের ধুলো ঝেড়ে খোলা হচ্ছে দেশের তামাম সিঙ্গল স্ক্রিন। হলের বাইরের লম্বা লম্বা লাইন দিচ্ছেন দর্শকরা। ছবি শুরু হল, কাকে পেলেন দর্শকরা?

চার বছর পর ছবিতে ফিরছে লোকটা। লাগাতার ব্যর্থতা, একের পর এক বিতর্ক ঘিরে ধরেছিল তাঁকে শেষ চারটে বছর। দোসর ছিল লোয়ার ব্যাক পেইন। কক্ষ থেকে সরে গেলে ফেরা সহজ নয়, যে জানে সে জানে। ফলে চুম্বকটা ছিলেন শাহরুখই। কিন্তু শুধু মুখ দেখালেই চিঁড়ে ভিজবে না। ওটিটি ছবি দেখিয়েদের সামনে তরুণ প্রতিতুলনা হাজির করেছে। প্রত্যেকে রিটায়ারমেন্টের বয়স ছুঁইছুঁই দাঁড়িপাল্লাতেই মাপবেন, সেটাই দস্তুর। পরিণতমনস্ক দর্শক একটা পরিণত কাহিনি চাইবেই। একথা মাথায় রেখেই সিনেমা বানিয়েছেন সিদ্ধার্থ আনন্দ। এই ছবির গল্পে থ্রিল, অ্যাকশন, রোমান্স, পাঞ্চলাইন- সবরকম উপাদান নিপুণ ভাবে মেশাতে একটুও কসুর করেননি তিনি। একটা বাণিজ্যিক ছবি যে যে কারণে হিট হয়, সবই রয়েছে এই ছবিতে। চলতি কথায় ‘ফুল প্যাকেজ’।

সিনেমায় প্রোটাগনিস্ট শাহরুখ নিজেই, তাঁর কাঁধেই জোয়াল। ‘বনবাস’ কাটিয়ে ফেরা র-এজেন্ট পাঠান (শাহরুখ খান) এবং তার টিম ‘জোকার’। পাঠানের বিপরীতে রয়েছে প্রাক্তন র এজেন্ট জিম (জন আব্রাহাম)। নিজের ব্যক্তিগত প্রতিশোধ পূরণ করতে ধ্বংস করে দিতে চায় ভারতকে। কীভাবে এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে রুবাই (দীপিকা)? জিম কি সফল হবে নিজের অভীষ্টে? জিমকে আটকাতে ঠিক কতটা বলিদান দিতে হবে পাঠানকে, সেই গল্প বলবে পাঠান।

দীপিকা ছিলেন, ছিলেন জন অব্রাহাম। কিন্তু তাদের দেখতে দু'দিনে একশো কোটি বেশি টাকা খরচ জনতা করবে না, বিলক্ষণ জানতেন শাহরুখ। কাজেই তার দায় ছিল অনেক বেশি। শাহরুখ এলেন, দেখলেন, জয় করলেন পুরনো ভঙ্গিমায়। গোটা স্ক্রিন জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাব্য লেখা হলো। ডায়লগ ডেলিভারি থেকে শুরু করে অ্যাকশন, এই ৫৭ বছর বয়সেও লোকটা কীভাবে এমন নির্ভার হয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারে, ভেবেছে এ দেশের সহস্র জনপদ। অ্যাকশনে ভরপুর এই সিনেমা। বড় স্ক্রিনে শাহরুখ সেখানে অনাবিল। কয়েকটা জায়গায় ভিএফএক্সের কারণে অ্যাকশন নিস্প্রভ লাগলেও শাহরুখের জ্যোতি তাতে কমে না। হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটের দৃশ্য হোক কিংবা শাহরুখের ইন্ট্রোডিউসিং সিন, তুখোড় অভিনয় বুঝিয়ে দেয় চারবছর প্রতিদিন নিজেকে কীভাবে তৈরি করেছেন শাহরুখ। এই সিনেমায় ট্রেনের মধ্যে একটি ওয়ান টেক শট আছে, আলাদা করে বলতে হয় এই শটের কথা, সত্যিই দৃশ্যায়নে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

আগে থেকেই জানা ছিল ছবিতে সলমান খানের ক্যামিও থাকবে। কিছুটা হলেও চিন্তায় ছিলাম সেই ক্যামিও কেমন হবে। আগেরবার (চিরঞ্জীবীর সঙ্গে গডফাদার) যখন সলমান ক্যামিও করেছিলেন তার ফল কী ভয়ঙ্কর হয়েছিল, আমাদের সকলের মনে আছে। তবে এই ছবিতে ভাইজানের ক্যামিও কার্যত আগুন লাগিয়ে দিয়েছে স্ক্রিনে! মানিকজোড় থুড়ি শাহরুখ-সলমানের একসঙ্গে অ্যাকশন, তাও আবার বড় পর্দায়- স্বর্গীয় অনুভূতি। এই সিনেমা সলমান খানের ক্যামিও স্পাই ইউনিভার্স সংক্রান্ত খুব তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি ইঙ্গিত দেয়।

আসি দীপিকা পাড়ুকোনের কথায়। শাহরুখ-কেন্দ্রিক সিনেমা বলে হিরোইনকে শোপিস করে রাখা হবে, পাঠানে এমনটা হয়নি। দীপিকা শুধু লাবণ্যময়ীই নন, ব্যক্তিত্বময়ীও, শো-পিসের ভূমিকা হলে তা তিনি নিজের জন্য বাছতেনও না, উল্টোদিকে যেই থাকুক না কেন। যে বিকিনি নিয়ে এত বিতর্ক, সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে দীপিকা সেই গেরুয়া বস্ত্র পরেই স্ক্রিনে আগুন জ্বালিয়েছেন, দর্শকদের সিটি বুঝিয়েছে রঙ কারও একার না। এই সিনেমার দীপিকার অ্যাকশন এবং ফাইট দুর্দান্ত, দীপিকা অ্যাথলিট, তাঁর দেহ স্বভাবপেলব, স্ক্রিন প্রেজেন্স দিয়ে বহু পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তুলেছেন,আবার শাহরুখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি।

পাঠানের সৌজন্যে বহুদিন পর এত শক্তপোক্ত এক ভিলেন পেল হিন্দি ছবি, যে শক্তিতে নায়কের থেকে কম নয়। এই ভিলেন হিরোর কাছে শুধু মার খায় না, পাল্টা মারতেও পারে। সিনেমায় এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে জিম দর্শকের মন জয় করে নেবে। হিরোকে শক্তিশালী দেখাতে হবে বলে ভিলেনকে দুর্বল বানানো হয়নি। বরং হিরোর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়ছে ভিলেন। আমরা পাচ্ছি ভারসাম্যে ভরা টানটান এক চিত্রনাট্য। চরিত্রের সঙ্গে ন্যায়বিচার করেছেন জন আব্রাহাম। ট্রেলার বা টিজার দেখে মনে হয়নি জন নিজেকে এই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন। সবাইকে ভুল প্রমাণ করেছেন তিনি। জন বরাবরই অ্যাকশন হিরো। এই সিনেমাতেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বিশেষত বরফের উপর শাহরুখ এবং জনের বাইক চালানোর দৃশ্য চোখে লেগে থাকবে বহুদিন। বলে রাখি, জনের চরিত্রটির একটি রেফারেন্স দেওয়া রয়েছে স্পাই ইউনিভার্সের অন্য একটি সিনেমার সঙ্গে। দেখলেই বুঝতে পারবেন।

পাঠানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অভিনয় করেছেন পার্শ্বচরিত্ররা। ডিম্পল কাপাডিয়া যাকে বলে চেরি অন কেক। মণীশ ওয়াধওয়া অল্প সময়ের জন্য স্ক্রিনে ছিলেন, সেই সময়টুকু অনিন্দ্যসুন্দর। তবে আশুতোষ রানাকে দেখে নিরাশ হতে হয়েছে। স্ক্রিনে ওঁর থেকে আরেকটু বেশি আশা করে দর্শক, সব সময়। আশুতোষ রানার চরিত্রটি তৈরির ব্যাপারে আরেকটু যত্নশীল হতেই পারতেন চিত্রনাট্যকার।

এই ছবিতে একটা মিড ক্রেডিট সিন রয়েছে, কোনও পোস্ট ক্রেডিট সিন নেই। যারা ওয়ার দেখেছেন তারা জানবেন, সিদ্ধার্থ আনন্দ গল্পে বারবার ট্যুইস্ট ভালোবাসেন। স্বভাবতই এখানেও বেশকিছু টুইস্ট আছে। কয়েকটি টুইস্ট ভালো হলেও অধিকাংশই আগে থেকে অনুমেয়। তবে এই সিনেমার স্ক্রিনপ্লে খুবই পাকা হাতে করা। কোথাও গিয়ে মনে হবে না গল্প অহেতুক টানা হয়েছে। ব্যক্তিগত মত, প্রথমার্ধের থেকেও জোরালো দ্বিতীয়ার্ধ। কৃতিত্ব শ্রীধর রাঘবনের। ধন্যবাদ জানানো উচিত পাঠানের সংলাপ লেখক আব্বাস টায়ারওয়ালাকে। পাঞ্চলাইনে কিস্তিমাত করেছেন আব্বাস। একই সঙ্গে শাহরুখ, সলমান এবং জনের পুরনো সিনেমাকে ট্রিবিউটও দেওয়া রয়েছে এই সিনেমায়, নস্টালজিয়ার বিক্রয়মূল্য ভালোই জানেন পরিচালক সিদ্ধার্থ আনন্দ। বিশাল-শেখরের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বেশ ভালো।

পাঠান আসলে আসা নয়, আবির্ভাব। শাহরুখ খানের মতো সুপারস্টারের এরকম প্রত্যাবর্তনই কামনা করেন ভক্তরা। শাহরুখ নিজে যদিও একে প্রত্যাবর্তন বলতে রাজি নন, তাঁর কথায় এটা- কাজ শেষ করা। পাঠান থেকে গোদারের বা ফেলিনির ট্রিটমেন্ট আশা করলে ভুল হবে। এই ধরনের অ্যাকশন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, লার্জার দ্যান লাইফ মুহূর্তগুলোয় হলের সিটি-তালি মনে হচ্ছে সিংহগর্জন, এই গর্জন ভারতের, ধর্ম-বর্ণের ছুঁৎমার্গ মুক্ত একটা দেশের যে পড়শিকে জড়িয়ে ধরতে জানে, যে কোলাহল ভালবাসে। কোভিডের পর থেকে মানুষ কেবলই ঘর-গহ্বরে সেঁধিয়ে গেছে। মুঠোফোনেই স্বচ্ছন্দ। কিন্তু সিনেমা তো সমষ্টির। পাঠান সেই সেঁধিয়ে থাকা একককে জন-অরণ্যে এনে ফেলেছে আরও একবার। ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাড়াবাড়ি, পোস্ট-ট্রুথ সিনেমার দেশে বক্স অফিস ফর্মুলা ছবি আর কী করতে পারে?

More Articles