পানীয় জল থেকেই ক্যান্সার! রোজ এভাবেই মিশছে ক্ষতিকর চিরস্থায়ী রাসায়নিক
Drinking Water Pollution: বয়নশিল্প থেকে শুরু করে কাগজ শিল্প, কিংবা জল ও তেল প্রতিরোধী পদার্থ থেকে শুরু করে নন-স্টিক রান্নার বাসন, আগুন-রোধী ফোম তৈরি করা, সবেতেই ব্যপকভাবে ব্যবহার করা হয় PFAS।
আপনি যদি ভাবতেন প্লাস্টিকই একমাত্র ক্ষতিকর পদার্থ যা পরিবেশে দীর্ঘদিন থেকে থাকে, তাহলে ভুল ভাবতেন। আদতে প্লাস্টিকের সমান বা তার থেকেও ক্ষতিকর একাধিক রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে থেকে যায়, ঠিক প্লাস্টিকের মতোই। পার অ্যান্ড পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল সাবস্টেন্স বা PFAS এত দীর্ঘকাল ধরে পরিবেশে থেকে যায়। “এত দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশে টিকে থাকার কারণেই তাদের ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ ডাকনাম দেওয়া হয়েছে”, একটি ইমেলে ইন্সক্রিপ্টকে জানিয়েছেন স্টকহোম ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক ড: আয়ান কাজি়নস।
কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় PFAS?
PFAS কিন্তু মানুষেরই তৈরি। বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে প্রায় চোদ্দোশো রকমের আলাদা আলাদা PFAS ব্যবহৃত হয়। বয়নশিল্প থেকে শুরু করে কাগজ শিল্প, কিংবা জল ও তেল প্রতিরোধী পদার্থ থেকে শুরু করে নন-স্টিক রান্নার বাসন, আগুন-রোধী ফোম তৈরি করা, সবেতেই ব্যপকভাবে ব্যবহার করা হয় PFAS। আর PFAS সবথেকে বেশি ব্যবহার করা হয় এশিয়াতে, বিশেষ করে চিনে।
কীভাবে PFAS পরিবেশে মেশে?
PFAS-এর অন্তর্ভুক্ত চারটি রাসায়নিকের দিকেই নজর দেওয়া হয়েছিল সাম্প্রতিক প্রকাশিত রিভিউ আর্টিকেলে। এই চারটি রাসায়নিক হল পারফ্ল্যুরোঅক্টেনসালফোনেট, পারফ্ল্যুরোঅক্টানোয়িক অ্যাসিড, পারফ্ল্যুরোহেক্সেনসালফোনিক অ্যাসিড, পারফ্ল্যুরোনোনানোয়িক অ্যাসিড। এই সমস্ত রাসায়নিককে একত্রে PFAS বলে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যে বিপুলভাবে ব্যবহার করা হয় এগুলি। আর সেখান থেকেই এই রাসায়নিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। আগে উল্লেখ করা চার প্রকার PFAS-ই উদ্বায়ী, ফলে সহজেই বাতাসে মিশে যেতে পারে তারা। তারপর বৃষ্টি বা বরফপাতের সময় বাতাসে মিশে থাকা বৃষ্টি ও বরফের সঙ্গে মাটি এবং জলভাগে এসে আছড়ে পড়ে PFAS। তারপর সমুদ্রে মিশে থাকা PFAS-ও আবার বাতাসে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু কীভাবে?
সমুদ্রে যখন ঘন ঘন ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, সেই ঢেউয়ের সঙ্গে অসংখ্য ফেনা তৈরি হয়। আর সেই ফেনা যখন বাতাস বা মাটির ধাক্কায় ফেটে যায়, তখন সেখান থেকে ‘সি স্প্রে এরোসল’ তৈরি হয়। সমুদ্রের কাছাকাছি গেলে যখন সেই অঞ্চলের বাতাস সামান্য ঝাপসা হয়ে থাকে, তখনই বোঝা যায় ‘সি স্প্রে এরোসলের’ অস্তিত্ব।
আরও পড়ুন- রাত হলেই গায়েব হয়ে যায় দুবাইয়ের এই আস্ত গ্রাম! ‘ভুতুড়ে’ কারণ খুঁজতে গিয়ে মাথায় হাত
আর সেই এরোসলে মিশে থাকে সমুদ্র থেকে আসা PFAS। এই এরোসল ভেসে যেতে পারে অনেক দূর অবধি, আর তারপরে অভিকর্ষজ বলের কারণে আবার মাটিতে পড়ে যায়। তখন দূষিত হয় মাটি, এবং তার নিকটস্থ জল। সে জল পানীয়ও হতে পারে, থাকতে পারে মাটির উপরিতলে; বা ভূগর্ভস্থও হতে পারে।
কী ভাবে ক্ষতি করছে এই চিরস্থায়ী রাসায়নিক?
কেবল বাতাসেই নয়, সমুদ্রের জল থেকে শুরু করে বৃষ্টির জল, এবং মাটির উপরিভাগের জল সবেতেই পাওয়া গেছে ক্ষতিকর চিরস্থায়ী রাসায়নিকগুলিকে। সাম্প্রতিক একটি রিভিউ আর্টিকেলে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। সেই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে “আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি” নামের জার্নালের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে।
এই শ্রেণির রাসায়নিক সারা পৃথিবীর ক্ষতিসাধন করছে তো বটেই, যে ক্ষতিটা হচ্ছে তাও কিন্তু অপরিবর্তনীয়। “PFAS-এর প্রভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ (পানীয় জল, মাটির উপরে ও নীচে থাকা জল) এত ব্যপক হারে দূষিত হয়েছে যে আমরা পৃথিবীকে বেঁচে থাকার জন্যে অত্যন্ত অনুপযোগী একটি গ্রহে পরিণত করেছি”, ইন্সক্রিপ্টকে জানান ড. কাজি়নস। এই রাসায়নিকগুলি মানুষ তো বটেই গাছপালা থেকে শুরু করে পশু-পাখিদের শরীরেরও চরম ক্ষতি করে। একটি নির্দিষ্ট সীমা অবধি এর সংস্পর্শে এলে উল্লেখযোগ্য ভাবে আমাদের শারীরিক ক্ষতি হয় না। কিন্তু বাতাসে যে পরিমাণ PFAS রয়েছে, তা ইতিমধ্যেই আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, বিষক্রিয়া, সন্তানধারণে অক্ষমতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, আলসারেটিভ কোলাইটিস, লিভার এনলার্জমেন্ট, থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করা ছাড়াও একাধিক সমস্যা সৃষ্টি করছে।
তাই প্রকৃতিতেও ঠিক কী PFAS পরিমাণ থাকলে তা আমাদের বা পরিবেশের ক্ষতি হবে না, তা অনেক আগে থেকেই জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। কিন্তু খুব দ্রুত হারে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ায়, PFAS-এর সীমা সম্পর্কে সচেতন করেছেন পরিবেশবিদরা।
আরও পড়ুন- সাজতেন অনুব্রতর ৫৭০ ভরি সোনায়, কেষ্টর গরু পাচারের দুর্নাম ঘোচাবেন কালীই!
PFAS থেকে বাঁচার উপায় কী?
বর্তমানে পানীয় জল এবং মাটিকে PFAS-মুক্ত করার জন্যে একাধিক পদ্ধতি এবং উপকরণ অবলম্বন করা হয়; যাদের মধ্যে অন্যতম সক্রিয় কার্বনের ব্যবহার, অ্যানায়ন এক্সচেঞ্জ রেসিনস, ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল অক্সিডেশন, রিভার্স অসমোসিস, সোনোলাইসি, প্রভৃতি।
তাহলে কি আমরা পৃথিবীকেও PFAS-মুক্ত করতে পারি? ড. কাজি়নস জানাচ্ছেন, “পানীয় জল কিংবা মাটিকে PFAS-মুক্ত করা সম্ভব হলেও, সারা বিশ্ব যা আজ চিরস্থায়ী রাসায়নিকের দূষিত, তাকে আমরা মুক্ত করতে পারবো না। PFAS নষ্ট হবে না সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।”
তবে আশার বিষয় হল, এই রাসায়নিকগুলি ধীরে ধীরে সমুদ্রে মিশতে থাকবে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে যদি আমরা PFAS-এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, তাহলে হয়তো একদিন সারা বিশ্ব জুড়ে এদের পরিমাণ হ্রাস পাবে। তবে তা নিকট ভবিষ্যতে ঘটছে না। এর জন্যে সময় লাগবে দশকের পর দশক। তবে সমুদ্রে মিশলেও, সমুদ্রের বাষ্পীভূত জলের সঙ্গে PFAS আবার বায়ুমণ্ডলে মিশবে এবং বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা PFAS আবার বৃষ্টির সঙ্গে ঝরে পড়তে পারে পৃথিবীর বুকে; যা ফের দূষিত করতে পারে মাটি এবং পানীয় জলকে। সেই আশঙ্কের কথাও ইন্সক্রিপ্টকে জানিয়েছেন ড: কাজি়নস। কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, ভূভাগ এবং জলরাশি সবই দৃশ্যমান কিংবা আপাত অদৃশ্য কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন সূত্রে বাঁধা। একটির ক্ষতি হলে আরেকটির ক্ষতি আটকানো এত সোজা নয়।