ঘরের কাছেই নির্জন প্রকৃতির হাতছানি! সপ্তাহান্তে বাঙালির নতুন গন্তব্য বেনাপুর
Benapur-Deulti: সপ্তাহান্তে আপনার গন্তব্য হতেই পারে বেনাপুর ও দেউলটি।
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?' কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতার পংক্তিই যেন সত্যি এখানে। এখানে মেঘ যেন সত্যিই গাভীর মতো চরে। এখানে সবুজ যেন মনের কথা বলে। এখানে নৌকোগুলো নদের কাছেই থাকে। এখানে নদী-র কথা নদ-ই বলে শেষে!
এ যেন এক কবিতার দেশ। বাড়ি থেকে একটু দূরেই হয়তো বা আপনার জেলায়, আপনার শহরেই লুকিয়ে এমন সুন্দর নয়ানাভিরাম দৃশ্য। দেখলেও এড়িয়ে গিয়েছেন হয়তো। দেখেননি, নদীর ওপারে নয়, এপারেই রয়েছে এক স্বর্গসুখ! আর এমন জায়গারই সন্ধান দিতে এই লেখা।
আরও পড়ুন: দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট
সপ্তাহান্তে ব্যাগ গুছিয়ে খানিকটা সময় বন্দি করা নিজের জন্য! আর তাই ভেবেই বেরিয়ে পড়ুন বেনাপুর আর দেউলটি-র উদ্দেশ্যে। বেনাপুর খানিকটা অচেনা, অজানা। হাওড়া জেলায় এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশের অবস্থান। রূপনারায়ণ নদের পাড়। বাগনান থেকে খানিকটা দূরে। যা গোটা দক্ষিণবঙ্গের সম্ভবত বৃহত্তর সবুজে মোড়া নদের পাড়। যেখানে বিস্তীর্ণ অকৃত্রিম সবুজের গালিচা দেখে প্রাকৃতিক গলফ্ কোর্ট অথবা কোনও সবুজ রঙের মরুভূমি বলেও ভ্রম হতে পারে আপনার। যদি প্রকৃতিপ্রেমিক মন আর অনুভবের ইচ্ছা থাকে, তাহলে সেখানেই থেকে যেতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কী নেই! বিরাট নদ। টইটম্বুর জল। নৌকায় মাছধরা। ভটভটির আনাগোনা। আকাশে মেঘের চলাচল। সারি দিয়ে নৌকো। সবুজের গালিচা। মাঝে মাঝে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একাধিক গাছ। খাড়ি। যেন নদের মধ্যেই একাধিক নদীর সমাহার। জোয়ারের সময় অপূর্ব এই পাড়ে ছবি তুলতে একটুও দ্বিধা হবে না আপনার। মিশে যাবেন প্রকৃতির সঙ্গে। এর সঙ্গেই দেখে নিতে পারেন কথাশিল্পীর বসতভিটা। তা-ও মন্দ তো নয়ই, বরং অনেক কিছুর থেকেই সুন্দর। ইন্দ্র-স্রষ্টা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি দেউলটি-তে। হাওড়া জেলাতে রূপনারায়ণ তীরেই এই স্থান। প্রকৃতি, সাহিত্য-ইতিহাস আর ভালোলাগাকে সম্বল করে ফিরতে পারেন ঘরে। হাতে সময় থাকলে একটু দূরেই কোলাঘাট। যেতে পারেন সেখানেও। কাটিয়ে দিতে পারেন একটি দিন।
কীভাবে যাবেন বেনাপুর?
হাওড়া স্টেশনের ১২/১৩ প্ল্যাটফর্ম থেকে খড়গপুর, মেদিনীপুর, বাগনান, পাঁশকুড়া লোকাল ধরে প্রথমে পৌঁছে যান বাগনান। সেখানে গিয়ে ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ডানদিকে খানিকটা এগোলেই বাসষ্ট্যান্ড। ৩০ মিনিট অন্তর অন্তর ম্যাজিক গাড়ি ছাড়ে বেনাপুর যাওয়ার। পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত না হলেও রাস্তা খুব ভালো। মুহূর্তেই নির্জনতার স্বাদ। যাঁরা নিজের গাড়ি নিয়ে যাবেন বা বাইকে যাবেন, তাঁরা বাগনান যাওয়ার পর, বাসস্ট্যান্ডের পাশ থেকে সোজা রাস্তা ধরতে পারেন। অথবা আরও রুট জানতে খানিকটা শরণাপন্ন হতে পারেন গুগল ম্যাপের।
বেনাপুর থেকে দেউলটি
ফের বাগনান ফিরে ট্রেনে করে পৌঁছন, মেদিনীপুরের দিকে ঘোড়াঘাটা নামে একটি স্টেশনের পরেই দেউলটি। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে টোটো করে নির্দিষ্ট স্থানে। অথবা বাগনান স্টেশন থেকে কোলাঘাট যাওয়ার ছোট গাড়ি ছাড়ে। ওই গাড়ি করে দেউলটি যান (কোলাঘাট যেতেও এই ব্যবস্থা খারাপ নয়)। তারপর যেখানে নামাচ্ছে সেখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে টোটো ধরুন, কথাশিল্পীর বাড়ির মোড় নামুন। অসাধারণ পথ ধরে খানিকটা হেঁটে যাওয়ার পর শরৎচন্দ্রের বাড়ি। টোটো রিজার্ভ করে যেতে পারেন, বাগনান থেকেও একইভাবে। খরচ এই ক্ষেত্রে একটু বেশি।
কোথায় থাকবেন?
সপ্তাহান্তে গেলে থাকার প্রয়োজন নেই। কয়েক ঘণ্টা কাটাতে পারেন। তবুও থাকতে চাইলে বাগনান স্টেশনের কাছের কোনও গেস্টহাউস অথবা একটু দূরে আর একটি দেখার জায়গা, জাতীয় সড়কের পাশে 'নিরালা রিসর্ট'। অথবা কোলাঘাট।
কী খাবেন?
বাগগান স্টেশনের কাছে খাওয়ার অনেক হোটেল। বেনাপুরে খাওয়ার জন্য ছোট রাস্তার ধারে হোটেল আছে। দেউলটিতে খাওয়ার ব্যবস্থা যথেষ্ট। এখানে বেশি ডাব বিক্রি হয়, খেতে পারেন।
কী কী দেখবেন
বেনাপুর চরে এই সময়ে গেলে ভাটা শুরুর সময়ে মাঝ নদ থেকে ইলিশ ধরে আনা হয়, সেটা দেখতে পারেন বিকেলের দিকে। রোজ নয়। যদি আপনার কপালে থাকে তবেই। অপূর্ব সুন্দর পাড় দেখুন। প্রকৃতি ঠিক যা যা দিতে পারে, সব আছে এখানে। আর তো আপনার কাছে সবটা!
দেউলটি এসে কথাশিল্পীর বাড়ি। সাজিয়ে রাখা মাটি আর কাঠের প্রাসাদ। ভীষণ সুন্দর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। দুলালচন্দ্র মান্না দেখে রাখেন সবটা। ৬০ বছর ধরে একই কাজ করছেন। সঙ্গে প্রীতম নামে এক যুবক। লেখকের কলকাতা নিবাসী নাতি জয় চট্টোপাধ্যায় মূলত দায়িত্বে। এর পাশেই বিশাল নদ। লেখকের স্ত্রী, মেজভাই এবং স্বয়ং লেখকের সমাধি বাড়ির পাঁচিলের মধ্যে। ওই বাড়ির পাশ থেকে নদের কাছে যাওয়ার জন্য সুন্দর গলিপথ। নদের পাশে ছোট্ট পার্ক রয়েছে। যা এই বর্ষা আরও ভয়ঙ্কর সুন্দর করে তোলে।
ফেরার সময় দেউলটি বা কোলাঘাট থেকে লোকাল ট্রেনে বা বাসে ফিরুন। দেউলটি থেকে ফিরলে শরৎ ভিটা থেকে টোটো করে স্টেশনের কাছে আসুন। ৭ মিনিট হেঁটে স্টেশন যান। নইলে রিজার্ভ করে নিন গাড়ি। টাকা বেশি খরচ করে।
সতর্কতা: পূর্ণিমা, অমাবস্যা আবহে ভরা কোটালের সময় অথবা মারাত্মক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে বেনাপুর চরে যাবেন না। আর গেলেও সতর্ক থাকুন পাড়ে থাকার সময়। দেউলটি নিয়ে অসুবিধা নেই, ওই পাড় নিয়ে ওই সময়ে একটু সমস্যা আছে, যদি না সতর্ক থাকেন। বেনাপুর পাড়ে এই সময়ে উত্তাল হয় নদ। খাড়ি বেয়ে প্রবল গতিতে ঢুকতে থাকে জল। প্রায় কোমর সমান খাড়ির জল টপকে, জামা প্যান্ট ভিজিয়ে ফিরতে হয় অনেককেই! টাইটানিক সিনেমার দৃশ্য মনে হয় পুরোটা। জোয়ার আর কোটালের প্রভাবে হয় এই পরিস্থিতি। তবে কয়েক ঘণ্টা পরেই সব ঠিক। দেউলটির নদের পাড়ে একই পরিস্থিতি হয়। পার্ক অল্প ডুবে যায় জলে। যদিও যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার চান, তাঁরা যান এই সময়ে যান। শীতকালজুড়ে পিকনিক হয় ওই জায়গায়।
খরচ: হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে বাগনান ১৫ টাকা ভাড়া। সেখান থেকে ম্যাজিক গাড়ি চেপে বেনাপুর যেতে ২০ টাকা ভাড়া। বাগনান থেকে গাড়ি করে দেউলটি ১৫ টাকা। তারপর কথাশিল্পীর বাড়ির মোড় পর্যন্ত ১০ টাকা টোটো, ২ মিনিট আগে নামতে হবে। ফেরার সময় দেউলটি থেকে ১৫ টাকা হাওড়া পর্যন্ত ট্রেন টিকিট। কোলাঘাট হয়ে ফিরলে বাস বা ট্রেনে আসতে পারেন।