জবরদখল হয়ে যাচ্ছে বাঙালিদের জমি? কেন ক্ষোভে ফুটছেন মমতা?
Mamata Banerjee: ইতিমধ্যেই এই জমি জবরদখল নিয়ে একগুচ্ছ পদক্ষেপ করা হয়েছে। জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে ৬ দফা নির্দেশিকা।
জমি জবরদখল নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নে পুরসভার চেয়ারম্যানদের নিয়ে বৈঠকে ফের সেই বিষয়টি নিয়েই খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন মমতা। রাজ্য সরকারের জমি পেলেই বেচে দেওয়া হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে বাংলার আইডেন্টিটি। ক্ষোভে গর্জে উঠলেন মমতা।
পুরবৈঠকে মমতা অভিযোগ করেন, মহানগর কলকাতা ও বিধাননগরের একের পর এক সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অথচ তা নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। কেন এই অবহেলা প্রশ্ন তুললেন মুখ্যমন্ত্রী। গত সোমবার লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্যালোচনা বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী । প্রায় ৪৫ মিনিট এই বৈঠক চলে । সেখানে একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় । অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এদিন আলোচনায় জমি ছিল অন্যতম প্রধান বিবেচনার বিষয় । এখানেই সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে পুলিশের ভূমিকায় সমালোচনার সুর শোনা গেল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়।
মুখ্যমন্ত্রী সেখানে অভিযোগ তোলেন, শহর কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় জমি দখল হয়ে যাচ্ছে । এক্ষেত্রে পুলিশি উদাসীনতা রয়েছে । জানা গিয়েছে, এদিন এই জমি দখল নিয়ে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়েন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল ৷ এই জমি দখল নিয়ে কলকাতা পুলিশের ভূমিকা কী, তা জানতে চান মুখ্যমন্ত্রী। একা কলকাতার পুলিশ কমিশনার নন, এদিন সরকারি জমি বেহাত হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়েন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারও । মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, একই অভিযোগ উঠছে কলকাতার পাশাপাশি সল্টলেকেও । এক্ষেত্রে পুলিশ কী করছে! ওই সময় সশরীরে নবান্নে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল।
আরও পড়ুন: বেছে বেছে মন্ত্রীদের তোপ, কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ মমতার?
কয়েকদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে গিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক করেছিলেন ৷ সেখানেও জমি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী । বিশেষ করে সে সময় তিনি সরব হয়েছিলেন হিডকোর জমি নিয়ে । সরাসরি প্রাক্তন মুখ্যসচিব তথা মুখ্যমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর নেতৃত্বে তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভপ্রকাশের পরেই বদলি করা হয়েছে, বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার আইপিএস গৌরব শর্মাকে। একই সঙ্গে বৈঠকের পরে পরেই বদলে ফেলা হয়েছে পুর সচিবকে। রাজ্য়ের নতুন পুর সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হল বিনোদ কুমারকে। ভূমি দফতরের নতুন সচিব হয়েছেন বিবেক কুমার।
শুধু সল্টলেকই নয়, কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় জমি জবরদখল নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। সূত্রের খবর, যাদবপুরের প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে সরকারি জমি জবরদখলের অভিযোগ নিয়ে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একেবারে কোন জায়গায়, কোন প্লট সব নাম করে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ৩৫৫, প্লিজ আনোয়ার শাহ রোড। লর্ড বেকারি মোড়ে। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রায় ২৯ কাঠা জমি রয়েছে। মুখ্য়মন্ত্রী জানিয়ে দেন, রাজ্য়ের জমি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। মেয়র বৈঠকে বলার চেষ্টা করেছিলেন, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের পাঁচিলের কথা। তখনই মমতা বলেন, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর পাঁচিল দিচ্ছে না কেন? তারা কি নিজেরা জানে না কোথায় নিজেদের কী জায়গা আছে? সবই কি আমি করব? একেবারে মোড়ের মাথায় জমি। জবরদখলের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
যতদূর জানা যাচ্ছে, যাদবপুরের প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে প্রায় ২৯ কাঠা জমির অর্ধেকের বেশি বর্তমানে বেদখল হয়ে রয়েছে। রয়েছে গ্যারেজ। রয়েছে বাজার। রয়েছে অসংখ্য দোকান। ব্যবসায়ীদের দাবি, তাঁদের কেউ ৪০ বছর, কেউ আবার ৫০ বছর ধরে এখানে দোকান করে নিজেদের সংসার চালাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এদিনের নির্দেশের পর উদ্বিগ্ন এই জায়গায় দোকান সাজিয়ে বসা ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেছেন, তাঁরা জানেনই না এটা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের জমি। তবে তাঁরা কোনও বিরোধের পথে যেতে চান না। বরং তাঁদের জন্য যাতে বিকল্প কিছু ব্যবস্থা করা হয়, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছেন তাঁরা। আবেদন জানিয়েছেন পুনর্বাসনের। না হলে তাঁরা না খেতে পেয়ে মরে যাবেন বলেও আবেদন করেছেন।
ইতিমধ্যেই এই জমি জবরদখল নিয়ে একগুচ্ছ পদক্ষেপ করা হয়েছে। জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে ৬ দফা নির্দেশিকা। সেখানে একাধিক বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসক সহ প্রশাসনিক কর্তাদেরও বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সরকারি জমি দখলমুক্ত করতে না পারলে এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়তে থাকবে। এর জেরে সরকারি জমি কোথাও থাকলেই তা দখল করার প্রবণতা তৈরি হবে। তবে আপাতত সেই নির্দেশিকায় একাধিক বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমত, সরকারি জমিতে সাইনবোর্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ যে সরকারি জমিটি রয়েছে সেটা যাতে বোঝা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই সাইনবোর্ডে লিখতে হবে এই জমির মালিক রাজ্য সরকার। তৃতীয়ত, বিলআরও ও ডিএলআরও অফিসের সামনে যাতে দালালরা ঘোরাফেরা না করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, কিছুদিন অন্তর সরকারি আধিকারিকরা সরকারি জমিগুলি সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন, সেগুলি পরিদর্শন করে দেখবেন সেগুলি ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে। পঞ্চমত, যখন তারা পরিদর্শন করবেন তখন সংশ্লিষ্ট জমি ও জলাশয়ের ছবি বিভিন্ন দিক থেকে তুলতে হবে। অর্থাৎ জমিটি যথাযথ রয়েছে কি না সেই সম্পর্কিত তথ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি জেলাশাসক ও এডিএম ল্যান্ডদের কাছে এই সরকারি নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশের পরেই একের পর এক জায়গায় শুরু হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান। সোমবার রাত থেকেই সল্টলেকের ওয়েবেল মোড়-সহ পাঁচ নম্বর সেক্টরের একাধিক জায়গায় ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। মঙ্গলবার সকাল থেকে গড়িয়াহাট, বিধাননগর, হাতিবাগান-সহ বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাথ দখলমুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। সল্টলেকে সেক্টর ৫-এ পুলিশ ইতিমধ্যেই সময় বেঁধে দিয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধে ৬টার মধ্যে ফুটপাথ খালি করে দিতে হবে হকারদের । মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর সক্রিয় ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পুলিশ। সেক্টর ফাইভে জবরদখল করে রাখা ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে শুরু হচ্ছে পুলিশ এবং পুরসভার যৌথ অভিযান।
আরও পড়ুন: ৪৬টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে! শহর কলকাতায় কেন কাজ করল না মমতা-ম্যাজিক?
সব মিলিয়ে জমি জবরদখল নিয়ে মোটামুটি চূড়ান্ত বার্তা দিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর এই নয়া পদক্ষেপে চাপের মুখে পড়েছেন সরকারি জমি জবরদখল করে দোকান খুলে বসা বিভিন্ন দোকানিরা। যদিও মমতা বলেছেন, কারওর রুজিরুটি নিয়ে টানাটানি করতে চান না তিনি। তাদের জন্য আলাদা করে স্টলের ব্যবস্থা করার কথাও বলেছেন তিনি। কিন্তু আপাতত জীবিকা হারানোর চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে তাঁদেরও।