রাজকুমারী ডায়নার হত্যায় হাত ছিল স্বয়ং রানি এলিজাবেথের? আজও যে প্রশ্নে তোলপাড় বিশ্ব
Diana Death Mystery: সত্যিই কি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন ডায়না, না কি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খোদ রানি এলিজাবেথ এবং তাঁর পুত্ররা?
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরে অবসান ঘটল একটা দীর্ঘ যুগের। আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটেনের সম্রাজ্ঞীর শাসনকাল ছিল বহু ইতিহাসের সাক্ষী। ভারতের স্বাধীনতাকালের বিতর্ক থেকে শুরু করে, বিভিন্ন দেশের সম্পত্তি চুরির অভিযোগ, রানী এলিজাবেথের জীবনে জড়িয়ে ছিল একাধিক বিতর্ক। তবে রাণীর জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও যে বিতর্ক পুরো ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারকে তাড়া করে বেড়ায়, সেটা ছিল প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যু। যখনই মায়াময় নীলাভ চোখের ওই ব্রিটিশ রাজবধূর মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠে আসে, তখনই একই সাথে ওঠে রানি এলিজাবেথের নাম। 'সুন্দরীদের সুন্দরী' ডায়না যে এখনও একজন 'মিথ'। 'হাউস অফ উইন্ডসর'-এর চৌকাঠ ডিঙিয়ে যে ব্রিটিশ রাজবধূ আন্তরিকভাবে মিশে যেতে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে, তাঁরই মরদেহ একদিন শায়িত অবস্থায় দেখতে হবে, এটা হয়তো ভাবতেই পারেননি কেউ। তাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেই। প্রিন্সেসের মৃত্যুতে কার্যত ভেঙে পড়েছিলেন রানি নিজেও। পরিবারের রীতি ভেঙে মাথা নত করতে দেখা গিয়েছিল তাকে।
ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের সঙ্গে রাজকুমারী ডায়নার সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক ছিল বিস্তর। রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করতেন, ডায়নার সঙ্গে রানি এলিজাবেথের সম্পর্কের রসায়ন একেবারেই ভালো ছিল না। আবার অনেকে বলেন, ডায়নার ওপর নাকি রানি বেশ ভরসা করতেন। এমন বহু সময় গিয়েছে, যখন রানি এলিজাবেথ নিজে রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পাঠিয়েছিলেন ডায়নাকে। রানির নির্দেশমতো ডায়নাও রাজপরিবারকে সম্মানের সঙ্গে সারা বিশ্বে উপস্থাপন করতেন। অনেকে বলেন, তাঁর বাচনভঙ্গি এতটাই ভালো ছিল যে, অনেকেই তাঁর এই ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিলেন। বলা হয়, 'সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র'। তবে শুধু মুখ না, রানি এলিজাবেথের এই পুত্রবধূর হৃদয়টাও ছিল সোনায় মোড়া।
প্রিন্সেস ডায়নার পুরো নাম ছিল ডায়না ফ্রান্সেস স্পেনসার। আর বিবাহ-পরবর্তী নাম হয়েছিল ডায়না ফ্রান্সেস মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর। তাঁর জন্ম হয় ১ জুলাই, ১৯৬১ সালে। যুবরাজ চার্লসের প্রথম স্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের যুবরাজ্ঞী। তাঁর পুত্র রাজপুত্র উইলিয়াম এবং হ্যারি, ব্রিটিশ মসনদের উত্তরাধিকারীদের তালিকায় রয়েছেন যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নম্বরে। ১৯৯৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত তিনি সম্বোধিত হতেন, 'হার রয়াল হাইনেস দি প্রিন্সেস অফ ওয়েলস' নামেই। এরপরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আদেশ অনুযায়ী তাকে শুধু ডায়না, প্রিন্সেস অফ ওয়েলস হিসেবে সম্বোধনের অনুমতি দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মৃত্যুর পরেও একদা ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির নোটে থেকে যাচ্ছেন রানি এলিজাবেথ
যদি ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাজবধূদের মধ্যে কেউ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকেন, তিনি হলেন প্রিন্সেস ডায়না। তাঁর এবং প্রিন্স চার্লসের প্রেমের কাহিনি ছিল বিশ্ববন্দিত। ডায়নাকে দেখেই তাঁর রূপের জৌলুসে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন প্রিন্স চার্লস। সেই সময় চার্লসের দৃষ্টিতে ডায়না পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী নারী। আর ডায়নার চোখেও প্রিন্স চার্লস বিশ্বের সবচেয়ে আরাধ্য পুরুষ। দু'জনেই দু'জনের প্রেমে একেবারে মজে গেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, একসঙ্গে জীবন কাটাবেন দু'জনে। বিশ্বে উঠল ঝড়। রানি এলিজাবেথের পুত্র প্রিন্স চার্লসের বিয়ে বলে কথা!
রানি এলিজাবেথ প্রথমে এই বিয়েতে অমত করলেও পরে রাজি হয়ে যান। ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাই মহা ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয় ডায়না এবং চার্লসের। ৫০০ কোটি মানুষ সেই দিন টেলিভিশনের পর্দায় উপভোগ করেছিলেন তাঁদের দু'জনের বিয়ের অনুষ্ঠান। বিবাহের সময় প্রিন্স চার্লসের বয়স ছিল ৩২ বছর এবং প্রিন্সেস ডায়নার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। বিবাহের পরেই তাঁদের জীবনে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আনন্দের জোয়ার আসে। রাজকীয় জাহাজ ব্রিটানিয়াতে চড়ে মধুচন্দ্রিমা করতেও গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু, বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথাতেই সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতে শুরু করে। ডায়না অনুভব করেন, চার্লস তাকে আর তেমনভাবে পছন্দ করেন না। একান্তে সময় দিতে চান না। বারবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
কিছুদিন এই ঘটনা ঘটার পরে এবারে চার্লসকে সরাসরি এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন ডায়না। অবহেলার কথা উঠতেই, সবদিক সামলাতে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে ব্যস্ততার কথা বলে তখনের জন্য ব্যাপারটা এড়িয়ে যান চার্লস। তবে সম্পর্কের যে বাঁধন আলগা হয়েছিল, সেটা আর শক্ত করা গেল না এই কথায়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দু'জনের মধ্যে দূরত্ব। দু'জনেই দু'জনকে সন্দেহ করতে শুরু করলেন। আর চার্লসের কানেও ডায়নাকে নিয়ে আসতে থাকল নানা রটনা-ঘটনার খবর।
বিয়ের ঠিক সাত বছরের মাথায় ১৯৮৯ সালে প্রিন্স চার্লসের হাতে এল একটি টেপরেকর্ডার ক্যাসেট। আর তাতে রয়েছে দু'টি কণ্ঠের সংলাপ। একটি নারীকণ্ঠ এবং অপরটি পুরুষ কন্ঠ। নারীকণ্ঠটি প্রিন্সেস ডায়নার। তবে পুরুষ কণ্ঠটি ছিল জেমস গিলাব নামের একজন ব্যক্তির। অনুসন্ধান করে জানা যায়, জেমস গিলাব ছিলেন ডায়নার বিবাহ-পূর্ব জীবনের প্রেমিক। আর কথোপকথনটা একেবারেই পুরনো সময়ের নয়, মাত্র সপ্তাহখানেক আগের। ক্যাসেট প্রকাশের খবর সারা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আর এর ছোঁয়া লাগে ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের ওপরেও। বিবাহের সাত বছর পর সংসারে ওঠে ভাঙনের সুর। এই ক্যাসেট প্রকাশ্যে আসার পর ডায়না এবং চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা থাকার ঘোষণা করেন। আর সেই সময়ই ডায়নার জীবনে আসেন মিশরীয় ধনকুবের দোদি আল-ফায়েদ। জানা যায়, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনিই ছিলেন তাঁর সঙ্গী।
নানারকম কেলেঙ্কারির গুজবে কলঙ্কিত হতে শুরু করে ডায়নার ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডায়নার প্রতিচ্ছবি ছিল দানশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে, তবে সেই সবকিছুই যেন ফিকে হতে শুরু করে। চার্লসের সঙ্গে ডায়নার দাম্পত্য কোনওদিনই সুখের ছিল না। নয়ের দশকে ডায়নার পরকীয়া প্রেমের কাহিনি সারা বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে অবশেষে ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ। চার্লসের সঙ্গে বাগদানের পর থেকে মৃত্যুর আগের সময় পর্যন্ত ডায়না ছিলেন বিশ্বের সবথেকে খ্যাতিমান এবং সবথেকে সুন্দরী নারীদের মধ্যে একজন।
ফ্যাশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগের বিষয়ে সচেতনতার সৃষ্টিতে তাঁর অবদান, ভূমি মাইনের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন বিখ্যাত করেছে ডায়নাকে। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, সেই পুরো সময়টা তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক খ্যাতিপ্রাপ্ত নারী। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, খ্যাতি আর এই খ্যাতির জন্য প্রচেষ্টাই ছিল ডায়নার জীবনের সবথেকে বড় কাল। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ঘটা ১৯৯৭ সালের গাড়ি দুর্ঘটনা ছিল এর অন্তিম পরিণতি। সেই দিনটি ছিল ৩১ অগাস্ট, যেদিন সবাইকে বিদায় জানিয়ে না-ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন প্রিন্সেস ডায়না।
তবে প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যু যেন আজও রহস্যের চাদরে মোড়া। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, ওই পথ দুর্ঘটনায় প্রিন্সেস ডায়নার বন্ধু দোদি আল-ফায়েদ-সহ প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর হাতে আসা কিছু তথ্য প্রমাণ বলছে, হত্যাকাণ্ডর শিকার হতে হয়েছিল প্রিন্সেস ডায়নাকে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর ওই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ডায়নার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন নাকি একজন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সদস্য। অন্য একটি সেনাসূত্র থেকেই নাকি এই গোপন তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। ওই সূত্রটি দাবি করছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নয়, বরং ডায়না, তাঁর বন্ধু দোদি এবং তাঁর গাড়িচালক হেনরি পলের মৃত্যু হয়েছিল কারও ষড়যন্ত্রের কারণে। আর এই ষড়যন্ত্রের পিছনে ছিলেন সেই ব্রিটিশ সৈন্য।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম 'দ্য সানডে পিপল' জানাচ্ছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যক্তি ব্রিটিশ সেনাকে অভিযুক্ত করে সাত পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেছে, যেখানে ডায়ানা এবং তাঁর বন্ধুর মৃত্যুর পিছনে রাজকীয় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ রয়েছে। তার পাশাপাশি ব্রিটিশ সেনার হাতেই এই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও একটি তথ্য তাদের কাছে এসেছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই টেলিভিশন নেটওয়ার্ক। তবে, একটি অন্য রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আসলে ডায়নার মৃত্যুর পিছনে হাত ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারের। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলেও, শোনা যায়, পিছন থেকে প্রিন্সেস ডায়না এবং প্রেমিককে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষই। দোদির বাবা মোঃ ফায়েদও চেষ্টা করেছিলেন, ওই ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণ করার। কিন্তু ২০০৮ সালে ডায়নার দুই সন্তানের কথা ভেবে ওই প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত হন মোঃ ফায়েদ।
তবে, ডায়নার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও একাধিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৭ সালের ৩১ অগাস্ট প্যারিসের রিতজ হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন প্রিন্সেস ডায়না, তাঁর বন্ধু এবং গাড়িচালক। ধারণা করা হয়েছিল, একজন নাছোড়বান্দা ফটোসাংবাদিকের লেন্স থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যই ডায়না এবং তাঁর বন্ধু অনেকটা গোপনে এবং তীব্র বেগে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন রিতজ হোটেল থেকে। আর গাড়িচালকের আসনে ছিলেন হোটেলের নিরাপত্তা বিভাগের উপপ্রধান হেনরি পল। প্যারিসের পন্ট-ডি-আলমা রোড টানেল পার হওয়ার সময় ঘটে এই দুর্ঘটনা। দু'জনকে বহন করা মার্সিডিজ গাড়িটি ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে তীব্র বেগে আঘাত করে টানেলের ১৩তম স্তম্ভে। কংক্রিটের একটি স্তম্ভের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ায় পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায় এই গাড়ি। আর ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান ডায়নার বন্ধু দোদি ও সেই গাড়িচালক। আর ডায়না মারা যান এই দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই।
তবে ডায়নার মৃত্যুরহস্য নিয়ে নতুন করে সন্দেহ দানা বাঁধে তদন্তকারী রডনি টার্নারের একটি বক্তব্যে। আদালতের সঙ্গে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালের অগাস্ট মাসে ডায়নার সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি জানতে পেরেছিলেন, তাঁর প্রেমিক দোদি-র সঙ্গে ডায়না সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এই ঘটনার মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই মারা যান ডায়না এবং তাঁর প্রেমিক। এই বয়ানের পরেই অনেকে মনে করেন, পরিকল্পিতভাবেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ডায়না। ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রাক্তন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এই দুর্ঘটনায় প্রাণ না হারালে হয়তো এটি একটি স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতো। কিন্তু সেরকমটা হয়নি। ডায়নার মৃত্যুর পরেই নানারকম প্রশ্ন তোলা শুরু হয় ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে। আর এই সমস্ত প্রশ্নের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
শোনা গিয়েছিল, মাতাল চালকের কারণে ডায়নার গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। এই কথা জোর দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। কিন্তু দুর্ঘটনার বিষয়টা নিয়ে সমগ্র সত্যি কখনওই বলা হয়নি। তদন্তকারীরা মনে করেন, এই পুরো হত্যাকাণ্ডে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের গোপন হাত ছিল। অনেকে বলে থাকেন, ব্রিটিশ রাজপরিবারের কঠোর নিয়মনিষ্ঠা এবং ভাবমূর্তির কারণেই দোদি-র সঙ্গে ডায়নার সম্পর্ক রানি এলিজাবেথ ভালোভাবে মানতে পারেননি। এই কারণেই দুর্ঘটনা সাজিয়ে ডায়নাকে হত্যা করা হয়।
ডায়নার মৃত্যুকে ঘিরে অনেক প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। মনে করা হয়, এই দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য একযোগে কাজ করেছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫ এবং ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। অনেকে আবার মনে করেন, ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজার সৎ পিতা হিসেবে একজন মুসলমানকে মেনে নিতে পারেনি ব্রিটিশ রাজপরিবার। যদি মধ্যযুগে এমন ঘটনা ঘটত, তাহলে সরাসরি ডায়ানার শিরশ্ছেদ করা হতো। এই কারণেই দুর্ঘটনার নাম করে ডায়নাকে হত্যা করেছে ব্রিটিশ রাজপরিবার। অন্যদিকে আবার ডায়নার সঙ্গে পুত্র দোদি-র সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে মন্তব্য করেছিলেন তাঁর পিতা মোহাম্মদ। তিনি মনে করতেন, প্রিন্স কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজার সৎ পিতা হবেন একজন মুসলমান। হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন বলেও দাবি করেছিলেন মোহাম্মদ। এই ফোন কলেই একইসঙ্গে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারেও কথা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ।
অন্যদিকে, ঘটনার দু'দিন পরে ফরাসি পুলিশ দাবি করে, ডায়নার গাড়িচালক ছিলেন মাতাল। নির্ধারিত মাত্রার তিনগুণ বেশি মদ্যপান করে সেদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন হেনরি পল এবং সেই কারণেই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ওই গাড়ি। তবে মজার ব্যাপারটা হলো, হেনরি ফলের রক্তে নমুনায় অ্যালবেনডোজল নামের একটি ওষুধের উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু পলের চিকিৎসক তাঁকে কখনওই এই ধরনের ওষুধের কথা লেখেননি বলেই জানিয়েছেন। অন্যদিকে পল নিয়মিত অ্যাকামপ্রোস্টেট নামের একটি ওষুধ খেতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর চিকিৎসক। কিন্তু রক্তের নমুনায় এই ওষুধের কোনও উপস্থিতি ধরতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ।
এছাড়াও, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে রয়ে গিয়েছে একাধিক রহস্য। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ওই মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিকে নিয়েও রয়েছে ধন্দ। দুর্ঘটনার সময় ডায়না এবং দোদি একটি কালো রঙের মার্সিডিজ গাড়িতে ছিলেন। প্যারিসের একটি কোম্পানি থেকে এই গাড়িটি ভাড়া করা হয়েছিল বলে জানা যায়। সেই রাতে ডায়নার চড়ার জন্য আর কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে ফরাসি পুলিশ জানতে পারে, ভাড়া করার আগে নাকি এই গাড়িটি চুরি করা হয়েছিল এবং গাড়িটিতে একটি কম্পিউটার চিপের মাধ্যমে গাড়িটির গতি এবং স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ করা যেত। অর্থাৎ কেউ মনে করলে, ড্রাইভারের অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই গাড়ি নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তদন্তকারীরা মনে করেন, দুর্ঘটনা বলে দাবি করে ডায়নার হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এই গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
তবে, সবথেকে বড় ব্যাপারটা হলো মার্সিডিজ কোম্পানিকে দিয়ে ওই ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়ির কোনওদিন পরীক্ষা করানো হয়নি। যদিও মারাত্মক দুর্ঘটনার পর এই জাতীয় পরীক্ষা করার রেওয়াজ রয়েছে পশ্চিম বিশ্বে। এভাবে পরীক্ষা করালে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সত্যিই কোনও রদবদল করা হয়েছে কি না, তা সহজে বুঝতে পেরে যান সেই কোম্পানির প্রকৌশলী। সরকারি বেশ কিছু বক্তব্য থেকে উঠে আসে, আহত ডায়নাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে ৭৫ থেকে ৯৫ মিনিট পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়েছিল। প্যারিসের ব্যস্ত মুহূর্তে দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে পৌঁছতে মাত্র ১১ মিনিট সময় লাগে। তাহলে অত রাত্রে নির্জন রাস্তায় হাসপাতালে পৌঁছতে ৯৫ মিনিট কীভাবে লেগে গেল, সেই নিয়ে রয়েছে রহস্য।
পাশাপাশি ডায়নাকে যে অ্যাম্বুলেন্স বহন করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সেই অ্যাম্বুলেন্স ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের কাছে থেমেছিল। সেই অ্যাম্বুলেন্সের হিস্ট্রি লগ থেকে এই পুরো বিষয়টা উঠে এসেছিল। ডায়নার অবস্থা এতটা শোচনীয় হওয়ার পরেও কেন এভাবে অ্যাম্বুলেন্সকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, তা নিয়েও দানা বেঁধেছিল রহস্য। এছাড়াও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কাউকে অ্যাম্বুলেন্সের জরুরি তলব দেওয়া হয়নি কেন, সেই নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
তবে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা কি আগেভাগেই টের পেয়েছিলেন ডায়না? ফরাসি ওই হোটেলের প্রাক্তন বাটলার পল ব্রুরেলের কাছে লেখা একটি চিঠিতে নিজেই মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ডায়না। তিনি লিখেছিলেন, ক্যামেলিয়াকে বিয়ের পথ সুগম করার জন্য তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন রানির স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। গাড়ি দুর্ঘটনা, ব্রেক ফেল-সহ নানারকম ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছিলেন প্রিন্স ডায়না। এই চিঠিটি লেখার মাসকয়েক আগে বিবিসি প্যানোরামা অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি নিজেই।
এছাড়াও, ডায়নার মরদেহ এবং শেষকৃত্য নিয়েও রয়েছে একাধিক প্রশ্ন। ফরাসি আইনের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও, ডায়নার মরদেহ শীতল হয়ে আসার আগে তাতে অবৈধভাবে পচনরোধক রাসায়নিক পদার্থ মাখানো হয়েছিল যাতে, মৃতদেহের সঠিক ময়নাতদন্ত অসম্ভব হয়ে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্সে করে আহত ডায়নাকে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর দেহে কোনও বিষক্রিয়া করানো হয়েছিল কি না, তাও ধরা পড়েনি ময়নাতদন্তের রিপোর্টে। অন্যদিকে, দুর্ঘটনাস্থল সম্পূর্ণ ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল।
এই সমস্ত ঘটনা থেকেই ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে উঠেছিল ডায়নাকে হত্যার অভিযোগ। সত্যিই কি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন ডায়না, না কি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খোদ রানি এলিজাবেথ এবং তাঁর পুত্ররা? কেমন ছিল ডায়না এবং রানির ব্যক্তিগত সম্পর্ক? ডায়নার মৃত্যুর পর, কেন শোকজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ? পরে মিডিয়াতে বক্তৃতা দিলেও কতটা সত্যি ছিল তাঁর শোকবার্তা? আর ডায়নার স্বামী, প্রিন্স চার্লস, তিনি এই ঘটনার সঙ্গে কীভাবে জড়িত? এই সমস্ত প্রশ্নেই আজও রহস্যাবৃত রয়েছে প্রিন্সেস ডায়নার হত্যাকাণ্ড।