কারাগারে নরকবাস! ভারতের বিচারাধীন বন্দিরা থাকছে মৃত্যুকূপে
সংশোধনাগারগুলিতে যেভাবে উত্তরোত্তর বন্দির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, আর গাদাগাদি করে অতি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে, কার্যত তা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের সমানাধিকার প্রাপ্য। অথচ সারা দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্য নাগরিকদের জীবনে প্রকট। ভারতের সংশোধনাগারগুলিতেও একই পরিস্থিতি। বন্দিদের জীবন বৈষম্যে ভরপুর। সংবিধান-স্বীকৃত প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বন্দিরা বঞ্চিত। এ-ব্যাপারে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষ আদালত।
পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছিল। সংশোধনাগারগুলি সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটির প্রধান ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অমিতাভ রায়। এরপর ২০২০ সালে করোনা দেখা দেয়। করোনা পরিস্থিতিতে সংশোধনাগারগুলি থেকে বন্দিদের একাংশকে ছাড়া হলেও সংস্কারের কাজ কার্যত হয়নি।
২০১৮ সালে ওই কমিটি তৈরির পর কেটে গিয়েছে চার বছর। অথচ সংস্কারের কাজ বিশ বাঁও জলে। এদিকে সংশোধনাগারগুলিতে বন্দির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য, বস্ত্র, শৌচাগার থেকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কিংবা জল সরবরাহ ব্যবস্থা সবেতেই সংকট দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে || ৫০ লক্ষর বেশি মামলার নিষ্পত্তি হয়নি হাই কোর্টগুলিতে
ভারতে মোট সংশোধনাগারের সংখ্যা ১,৩৭৮টি। আর সংশোধনাগারে ক্রমশই উপচে পড়ছে ভিড়। সংশোধনাগারে বন্দির সংখ্যা গত দু'বছরে ক্রমাগত হারে বেড়ে ৬ লক্ষ ১০ হাজার থেকে ৬ লক্ষ ২২ হাজারে এসে পৌঁছেছে। এই নিয়ে প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা বলেছেন, সারা দেশের সংশোধনাগারগুলিতে ৪ লক্ষ বন্দির সংকুলান হওয়ার কথা। এদিকে বন্দির সংখ্যা ২ লক্ষ বেড়ে যাওয়ায় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে বন্দিদের।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, গত দু'বছরে দেশে বন্দির সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে ভারতের বিচারব্যবস্থার গতি অত্যন্ত শ্লথ। এর ফলে বিচারাধীন বন্দিরা দিনের পর দিন সংশোধনাগারগুলির ভেতর বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন।
সারা দেশে যে রাজ্যগুলিতে বন্দির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, সেই রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলাও। এছাড়া জেলবন্দিদের সংখ্যার নিরিখে অন্য রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, ছত্তিশগড় এবং পাঞ্জাব।
সংশোধনাগারগুলির নিরিখে এক-তৃতীয়াংশ বন্দিই রয়েছেন যোগী-শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশের সংশোধনাগারগুলিতে। উত্তরপ্রদেশের ৭২টি সংশোধনাগারে বর্তমানে বন্দির সংখ্যা ১ লক্ষ ১ হাজার ২৯৭ জন।
পুরুষ ও নারী বন্দিরা সংশোধনাগারগুলিতে কী অবস্থায় রয়েছে 'মডেল প্রিজন ম্যানুয়াল' থেকে এই সংক্রান্ত উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। 'মডেল প্রিজন ম্যানুয়েল' অনুযায়ী মহারাষ্ট্রে প্রতি একজন বন্দি থাকার জন্য দরকার ৩.৭১ স্কোয়ার মিটার জায়গা। কিন্তু বরাদ্দ ১ দশমিক ১৯ স্কোয়ার মিটার জায়গা। ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতেও একই অসহনীয় পরিস্থিতি।
সংশোধনাগারগুলি থেকে করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে যে বন্দিদের সাময়িকভাবে ছাড়া হয়েছিল, তাঁরা ফের সংশোধনাগারে ফিরতে শুরু করাতে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হয়েছে। ফলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে সংশোধনাগারে বন্দিদের। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সমাজকর্মী এবং সাংবাদিকরাও।
সরকারি সূত্রের খবর, সংশোধনাগারগুলিতে নতুন বন্দিদের মধ্যে ৭০ শতাংশ তফশিলি জাতি-উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের। অন্যদিকে, বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছেন ৮০ শতাংশের কাছাকাছি বন্দি। এ-ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা বলেছেন, দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে।
করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে যে বন্দিদের সংশোধনাগারগুলি থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, অপরাধের মাত্রার ভয়াবহতা বিচার করে তাঁদের সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। জামিন অথবা প্যারোলে সংশোধনাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। গত বছরের শেষাশেষি থেকে ওই বন্দিরা সংশোধনাগারগুলিতে ফের ফিরতে শুরু করেন করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা খানিক কমার পর।
ভারতের সংশোধনাগারগুলিতে বন্দিদের সংখ্যা দু'লক্ষ বাড়লেও বন্দিদের মৌলিক অধিকার হিসেবে উন্নত জীবনযাত্রার জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে এদিকে বরাদ্দ বাড়েনি। সংশোধনাগারগুলিতে যে জটিল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব।
কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের শেষাশেষি করোনা পরিস্থিতি থেকে ভারতে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে অপরাধীর সংখ্যাও।
এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করেছে রাষ্ট্রসংঘ। 'রাষ্ট্রসংঘর অফিস অ্যান্ড ক্রাইম'-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের নানা দেশের সংশোধনাগারগুলিতে বন্দিদের একাংশ করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন। ১২২টি দেশে এই সংক্রান্ত সমীক্ষা চালিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। এ-পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, ৪৭টি দেশে করোনা-আক্রান্ত হয়ে ৪ হাজার বন্দির মৃত্যু হয়েছে।
ভারতের সংশোধনাগারগুলিতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে বন্দির সংখ্যা বেড়েছে। তবে ২০১১ সালে বন্দির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম। এরপর ২০১৯ সালে বন্দির সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ।
এই সংক্রান্ত যে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের সংশোধনাগুলিতে বন্দির সংখ্যা ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির আগে গত ৯ বছরের হিসেবের নিরিখে বন্দির সংখ্যা ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে ৩১ শতাংশ বেড়েছে।
২০২০ সালে করোনা দেখা দেওয়ার আগে বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশের সংশোধনাগারগুলিতে বন্দির সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। দেশের সহস্রাধিক জেলেও একই পরিস্থিতি ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চে করোনা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার আগে দেশের সহস্রাধিক সংশোধনাগারে ৪ লক্ষ ১৪ হাজার বন্দির স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা ছিল। এরপর করোনা দেখা দেওয়ার পর সারা দেশে মানুষের জীবন এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হওয়ার পর বন্দির সংখ্যা বেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৮৯ হাজারে।
ভারতের সংশোধনাগারের পরিস্থিতি বন্দিদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অসহনীয় হয়ে যাওয়ায় পরে বন্দিদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, ২২জন বন্দি ইতিমধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সংশোধনাগারগুলিতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে অসহনীয় পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, সেই পরিস্থিতির শিকার শুধুমাত্র সাধারণ অপরাধীরাই নন, রাজনৈতিক বন্দিরাও। এছাড়া যে বিশিষ্ট মানুষজন সংশোধনাগারে বন্দি হিসেবে রয়েছেন, যেমন শিল্পী, সাংবাদিক বা সমাজকর্মী, তাঁদেরও জীবনে একই পরিস্থিতি।
ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকারগুলি কি নেহাতই কথার কথা? সংশোধনাগারগুলিতে যেভাবে উত্তরোত্তর বন্দির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, আর গাদাগাদি করে অতি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে, কার্যত তা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।