মেরুদণ্ড বিক্রি নেই! আদানির টাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন যে কবি...

Adani Controversy: "আমি যে রাজনীতির কথা বলি এবং যে মতাদর্শে বিশ্বাস করি তাতে আদানি গ্রুপের আর্থিকভাবে সমর্থন করা কোনও পুরস্কার পেয়ে আমি খুশি হতে পারব না।"

কবির মেরুদণ্ড রাষ্ট্রের চাবুকের কাছে নত হয় কিনা, এই নিয়ে একটি বাক্য লিখলেও হইহই পড়ে যাবে। নত কেন, মেরুদণ্ড যে পোষা বিড়ালের মতোই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে আহ্লাদী হয়ে যায় তার অনন্ত উদাহরণ চারদিকে। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের এক বড় অংশই নিজেদের শিল্পকে আর হাতিয়ার করে ভাবেন না। প্রতিবাদের অস্ত্র নয় বরং পুরোটাই 'শিল্পের জন্য শিল্প'। পুরস্কার, সম্মান এবং ক্ষমতার কাছাকাছি নিরাপদে থাকতে শিল্পী সাহিত্যিকদের বড় অংশই দেশের সমস্ত রাজনৈতিক 'ইস্যু'তে শান্ত থাকেন। মাঝেসাঝে ততটাই প্রতিবাদ করেন, যতটা করলে রোজের জীবনে, সাহিত্য চর্চায়, খ্যাতিতে কোনও প্রভাব না পড়ে। এই গোষ্ঠীর উল্টোপিঠেই আছেন শিল্পীদের অন্য এক দল যারা তাঁদের চর্চাকে যাপন করেন। যারা জীবন দিয়ে শিল্প-সাহিত্যকে প্রকৃত অর্থে হাতিয়ার করতে চান। যারা পৃষ্ঠপোষকতা চান না, বরং অন্যায়ের দিকে সোজাসাপটা তাকান। দেশ জুড়ে আদানিচর্চার মধ্যে প্রতিবাদের এক অন্য ভাষা লিখলেন তামিল কবি সুকীর্থারানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ সম্প্রতি আদানির সংস্থাকে প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশাল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে আদানিরা। আর পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকার করেছেন সুকীর্থারানি কারণ এই সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আদানি গ্রুপ। স্পষ্ট জানিয়েছেন, এই পুরস্কার নিলে তা তাঁর নীতি, তাঁর লেখা এবং তাঁর দর্শন যার জন্য তিনি এতদূর এসেছেন সবটার সঙ্গে অন্যায় করা হতো।

৪ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুক পেজে পুরস্কার গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন সুকীর্থারানি। তিনি লেখেন, “নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপ তাদের নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য সারা দেশ থেকে নির্বাচিত ১২ জন মহিলাকে ‘দেবী পুরস্কার’ প্রদান করবে। দলিত সাহিত্যে আমার অবদানের জন্য আমাকে এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। আমি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে ধন্যবাদ জানাই।”

ওই পোস্টেই তিনি লেখেন, “আমি গতকালই জানতে পেরেছি যে অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আদানি। আমি যে রাজনীতির কথা বলি এবং যে মতাদর্শে বিশ্বাস করি তাতে কোনও সংস্থা বা আদানি গ্রুপের আর্থিকভাবে সমর্থন করা কোনও অনুষ্ঠানে কোনও পুরস্কার পেয়ে আমি খুশি হতে পারব না। তাই, আমি দেবী পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকার করছি।"

গত ৮ ফেব্রুয়ারি চেন্নাইয়ের আইটিসি গ্র্যান্ড চোলা হোটেলে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানী গগনদীপ কাং, ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী প্রিয়দর্শিনী গোবিন্দ, সমাজসেবী রাধিকা সান্থানকৃষ্ণ এবং স্কোয়াশ খেলোয়াড় জোশনা চিনপ্পা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বারোজন মহিলাকে এই বছর পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে৷

আরও পড়ুন- ‘অন্ধকার বলে কিছু নেই, আছে আলোর অভাব’, বলতেন আজীবন মার্কসবাদী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

সুকীর্থারানির সাহিত্যকর্ম ভারতের, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর দলিত নারীদের জীবন ও বিচারের কথা তুলে ধরে। “আমার কাছে, জাত এবং নারীদেহ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দলিত নারীদের সমস্যা অন্যান্য বর্ণের নারীদের থেকে আলাদা। আমার সব লেখা আমার নিজের অভিজ্ঞতা নয়; এগুলি অন্য মহিলা বা দলিত মহিলাদের অভিজ্ঞতা। আমরা সবাই জাত-পাতের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে আছি। বিশেষ করে দলিত নারীদের দেহ নিয়মিত হিংসার শিকার। উচ্চবর্ণের নারীরা যে যন্ত্রণা ভোগ করে তার তুলনায়, আমার মতে, দলিত নারীরা আরও খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। আমাদের নিজেদের শ্রেণির পুরুষদের সঙ্গে, যারা নারীর উপর ক্ষমতা জাহির করতে চায়, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়। উচ্চবর্ণের পুরুষরা আমাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ, কারণ তারা মনে করে তাদের ক্ষমতা আরও বেশি করে জাহির করার জন্মগত অধিকার রয়েছে। যে কোনও বাড়িতেই নারীদের অবস্থা সমাজবিচ্ছিন্ন নয়,” ২০১৭ সালে একটি সাক্ষাত্কারে দ্য ওয়্যারকে বলেছিলেন সুকীর্থারানি।

সুকীর্থারানি পেশায় রানিপেট জেলার লালাপেটের একজন শিক্ষিকা। ছয়টি কবিতার সংকলন রয়েছে তাঁর, কাইপাত্রি ইয়েন কানাভু কেল, ইরাভু মিরুগাম, কামাত্থিপু, থেনদাপদথা মুথাম, আভালাই মজিপেয়ারথাল এবং ইপ্পাদিক্কু ইয়েভাল। তাঁর লেখা অনেক কবিতাই তামিলনাড়ুর কলেজে পড়ানো হয় এবং বহু কবিতা ইংরেজি, মালয়ালম, কন্নড়, হিন্দি এবং জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ২০২১ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় নিজের পাঠ্যক্রম থেকে সুকীর্থারানির লেখা বাদ দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়।

"একজন মহিলার শরীরকে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয় বা ক্ষমতা দিয়ে ধ্বংস করা হয়। আমি একদমই অবাক হচ্ছি না যে এই কবিতাগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সনাতনে বিশ্বাস করে। তাই স্পষ্টতই, আমি যা লিখছি তাতে তারা বিরক্ত। আমি বিস্মিত নই কারণ শক্তিশালী দলিত কণ্ঠ মুছে ফেলার ঘটনা সবসময়ই ঘটেছে। যখন তারা আমাদের কাজে সত্যের-সততার মুখোমুখি হতে পারে না- আমার, বামা বা মহাশ্বেতা দেবীর- তারা আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের কাজ নিজেদের কথা বলেই যাবে,” দ্য ওয়্যারকে বলেছিলেন সুকীর্থারানি।

 

More Articles