কালে কালে জৌলুস হারিয়েছে পুজোসংখ্যা? কী মত লেখকদের
Durgapuja 2022: পুজোসংখ্যার মান পড়ছে? কী বলছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্ত, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অপরাজিতা দাশগুপ্ত, সাদিক হোসেনরা?
শরৎকাল এলেই বাঙালি সেজে ওঠে 'পুজোর সাজ'-এ। ব্যতিক্রম হয় না সাহিত্যও। সেই কোন ১৮৭২ সালে কেশবচন্দ্র সেনের হাত ধরে শুরু হয়েছিল যে, শারদ সাহিত্যর ধারা একশো বছর কাটিয়ে আজও তার জয়যাত্রা চলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে তার রূপ। শুরুর দিকের হাতে গোনা কয়েকটা পত্রিকা এখন সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। বাঙালি মননশীল জাতি। তাই তার বিশেষ পালাপার্বণের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জুড়ে গিয়েছে সাহিত্যের উত্তরাধিকার।
বাংলায় প্রথম শারদীয়া পুজোসংখ্যায় উপন্যাস বেরোয় 'বসুমতী'-তে। তারপর সাহিত্যর পুজোসংখ্যায় হাতেখড়ি হয় 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-র। ১৯২৬ সালে প্রথম পুজোসংখ্যা বের করে আনন্দবাজার। তার কিছু বছর পরের আনন্দবাজার পুজোসংখ্যায় ছাপা হয় প্রথম উপন্যাস মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'শহরতলী' এবং রবীন্দ্রনাথের বড় গল্প 'রবিবার'।
শারদ সংখ্যার পুনর্জন্ম হয় 'দেশ'-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষের হাত ধরে। তখন বাংলা সাহিত্যের নাব্যতায় সাহিত্যের তরী ভাসিয়েছেন বহু দিকপাল লেখক। রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, পাশাপাশি তখন খ্যাতির মধ্যগগনে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী। এর পাশাপাশি লিখছেন নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী- আরও অনেকে।
আরও পড়ুন: শারদীয়া পুজোসংখ্যায় সাহিত্য হয়? নাকি গোটাটাই ঝোঁক?
সময়টা ১৯৪৩। তখনও দেশভাগের বিভীষিকাময় দিনগুলো দেখেনি বাঙালি। দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রত্যেক বছরই পুজোর সময় বের হয় একটি করে নতুন বই। সম্পাদনা করেন নরেন্দ্র দেব বা প্রেমেন্দ্র মিত্রর মতো লেখক। আর সেই বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতাজুড়ে থাকে আশাপূর্ণা দেবী, রাধারাণী দেবী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিধায়ক ভট্টাচার্য, নরেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা। তখন পুজোসংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে বেরোতে শুরু করেছে টেনিদা ও ঘনাদার একটি করে গল্প। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকে 'শুকতারা' পত্রিকার পুজোসংখ্যায় কলম ধরলেন প্রবাদপ্রতিম নারায়ণ দেবনাথ। জন্ম হলো 'নন্টে ফন্টে ' ও 'বাঁটুল দি গ্রেট'-এর মতো কমিক স্ট্রিপের।
প্রায় একই সময়ে 'দেশ' পত্রিকায় সুবোধ ঘোষের সঙ্গে লেগে থেকে তাঁকে দিয়ে পুজোসংখ্যার উপন্যাস লিখিয়ে নিচ্ছেন সাগরময় ঘোষ। ছয় থেকে সাতের দশকে বাংলা সাহিত্যে লিখছেন একঝাঁক নতুন লেখক। ১৯৭১ সালে ছোটদের জন্য বেরোচ্ছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় 'আনন্দমেলা পুজাবার্ষিকী'। প্রথম 'আনন্দমেলা'-য় পাতাজোড়া ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে বেরোচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের 'প্রোফেসর শঙ্কু'। পাশাপশি 'সন্দেশ'-এ বেরোচ্ছে ফেলুদা সিরিজ, লীলা মজুমদারের শিশুসাহিত্য, নলিনী দাশের গণ্ডালু সিরিজ।
আনন্দমেলা-র পূজাবার্ষিকীতেও তখন চাঁদের হাট। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন সন্তু-কাকাবাবু সিরিজ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখছেন 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'-র মতো মারাত্মক সব কিশোর উপন্যাস। পুজোয় ধারাবাহিক বেরোচ্ছে বুদ্ধদেব গুহ র 'ঋজুদা'। আর শেষ পাতে থাকছে মতি নন্দীর জাদু গদ্যে লেখা 'কোনি', 'স্ট্রাইকার', 'স্টপার'-এর মতো লেখা।
পিছিয়ে ছিল না আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুজোসংখ্যা। রমাপদ চৌধুরীর 'পিকনিক', 'খারিজ', 'এখনই বা বাহিরি'-র মতো সব ক্লাসিকের জন্ম পুজোসংখ্যার পাতায়। নীললোহিত-এর উপন্যাস, সমরেশ বসুর লেখা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস তখনকার পুজোসংখ্যা যেন সাহিত্যের আকর।
কিন্তু সময়ের বাঁকে বাঁকে কী জৌলুস হারিয়েছে পুজোসংখ্যা? পুজোসংখ্যার একাল-সেকালের অন্যতম সাক্ষী বর্ষীয়ান সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে, "আমরা যখন লিখতে শুরু করি তখন একঝাঁক লেখক অমর সাহিত্য সৃষ্টি করছেন একসঙ্গে। বিভিন্ন পুজোসংখ্যায় লিখছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিতের মতো লেখক। তখনকার একটা ট্র্যাডিশন ছিল, প্রত্যেক দশ বছর অন্তর অন্তর একঝাঁক নতুন লেখক তৈরি হতো। সেটা তিনের দশক থেকেই ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। এখন এসে মনে হয়, সেই ধারাবাহিকতায় একটা ছেদ পরেছে। সাহিত্য নিয়ে মাতামাতিও অনেকটা কমে গেছে।"
বিভিন্ন পুজোসংখ্যায় লিখছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিতের মতো লেখক। তখনকার একটা ট্র্যাডিশন ছিল, প্রত্যেক দশ বছর অন্তর অন্তর একঝাঁক নতুন লেখক তৈরি হতো। সেটা তিনের দশক থেকেই ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে।
কেবল আনন্দবাজার-ই নয়, তারপরে 'আজকাল' বা 'বর্তমান'-এর মতো পত্রিকার পুজোসংখ্যাতেও আত্মপ্রকাশ করেছেন একাধিক লেখক, যাঁরা দীর্ঘদিন পুজোসংখ্যায় সৃষ্টি করেছেন একের পর এক ক্লাসিক উপন্যাস। স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অমর মিত্র, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের পুজোসংখ্যার লেখা পড়ে পুজো কেটেছে আমবাঙালির। কিন্তু পুজোসংখ্যার চাপে কি কোথাও মান হারিয়েছে সাহিত্য? সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী এই প্রসঙ্গে মনে করেন, "আমাদের স্কুলজীবন কেটেছে সমরেশ বসুর 'বিবর', সুনীল গাঙ্গুলীর 'আত্মপ্রকাশ', শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'ঘুণপোকা'-র মতো উপন্যাস পড়ে। তারপর আনন্দবাজারে লিখতে এসে পেয়েছি রমাপদ চৌধুরীর মতো মানুষকে। যিনি লেখককে দিয়ে তার লেখাটা বের করে আনতে জানতেন। সাহিত্য যুগে যুগে বদলায়। মান পরেছে কি না, সেটা বিচার করবে উত্তরকাল। কিন্তু পুজোসংখ্যা নিয়ে সেই মাতামাতি হারিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। পাঠকের উৎসাহ কমে গেলে লেখকের উৎসাহে খানিক ভাটা পড়বেই।"
প্রচেত গুপ্ত-র মতে, "পুজোসংখ্যার চাপ সাহিত্যের ক্ষতি করে কি না এই প্রশ্ন বহুকাল ধরেই হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ফরমায়েশি পুজো সংখ্যার লেখাই বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক কাল্ট উপন্যাস, ছোটগল্প বা কবিতার জন্ম দিয়েছে যা ভবিষ্যতে আর কখনও হয়তো হবে না। লেখার ক্ষেত্রে সময় আমার মতে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভালো লেখা একরাতেও হয় আবার পাঁচ বছর সময় নিয়েও অনেক লেখা পাঠকের মনে দাগ কাটতে পারে না।"
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ফরমায়েশি পুজো সংখ্যার লেখাই বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক কাল্ট উপন্যাস, ছোটগল্প বা কবিতার জন্ম দিয়েছে যা ভবিষ্যতে আর কখনও হয়তো হবে না।
পুজোসংখ্যার মান পড়ে যাওয়া নিয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবনা লেখিকা অপরাজিতা দাশগুপ্তের। তাঁর বক্তব্য, "এখনকার পুজোসংখ্যার অধিকাংশ লেখা দেখে মনে হয় তার পিছনে কোনও অধ্যাবসায় নেই। কথাটা হয়তো শুধু, শারদ সাহিত্য নয়, মোটের ওপর পনেরো আনা লেখার ক্ষেত্রেই সত্যি। বিশেষ করে উপন্যাস লেখার জন্য বিশেষ পড়াশোনা বা পরিশ্রম করতে অনেকে রাজি নন। সেজন্য হয়তো তাঁদের লেখা পাঠকমনে তেমন ছাপ ফেলতে পারে না।" পুজোসংখ্যার ফরমায়েশি লেখা সাহিত্যের মান কমিয়ে দেয় কি না, এই প্রশ্নে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন তিনি। বলেন, "আমার কাছে পুজোসংখ্যার লেখার বিশেষ চাপ থাকে না। সারা বছরই আমি লিখতে থাকি। কখনও কাগজের সম্পাদকের ফরমাশ মেনে, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই নিজের ভেতরের তাগিদ থেকে। যে লেখার জন্য যত পরিশ্রম দরকার হয়, যে লেখা যে গবেষণা দাবি করে, তা করতে আমি কখনওই পিছপা হই না।"
কথাটা হয়তো শুধু, শারদ সাহিত্য নয়, মোটের ওপর পনেরো আনা লেখার ক্ষেত্রেই সত্যি। বিশেষ করে উপন্যাস লেখার জন্য বিশেষ পড়াশোনা বা পরিশ্রম করতে অনেকে রাজি নন। সেজন্য হয়তো তাঁদের লেখা পাঠকমনে তেমন ছাপ ফেলতে পারে না।
সময়ের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে পুজোসংখ্যার সাহিত্য নিয়ে অন্য মতামত রাখেন এই প্রজন্মের লেখক সাদিক হোসেন। সাদিক বলেন, "বাইরে থেকে চাপ দিয়ে লিখিয়ে নেওয়ায় আমি বিশ্বাসী নই। ফরমায়েশি লেখা সবসময়ই লেখকের লেখাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পুজোসংখ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়। 'দেশ', 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-র পুজোসংখ্যার তুলনা টেনে তাঁর অভিমত, "সেই সময়টাই বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ আর এখন কিছুই হচ্ছে না- এমনটা আমার মনে হয় না। বরং এখন আরও অনেক ভালো ভালো লেখা তৈরি হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে সফল কোনও কাগজের পুজোসংখ্যায় না লিখেও বহু মানুষ নিঃশব্দে ভালো লিখে যাচ্ছেন। সর্বোপরি ইন্টারনেটের সহায়তায় বহু তরুণ লেখক তাঁদের ব্যতিক্রমী লেখা নিয়ে সরাসরি পৌঁছতে পারছেন পাঠকের দরবারে।"
১৯৯৩ সালে কবীর সুমন লিখেছিলেন, 'লেখকরা লেখে আর প্রকাশক ছাপে/ সাহিত্য মরে পুজোসংখ্যার চাপে'- আজকের তরুণ সাহিত্যকদের হাত ধরেই প্রকাশকের সেই বাইনারির বাইরে গিয়ে পুজোসংখ্যার চাপ থেকে শাপমুক্তি ঘটছে সাহিত্যর। লেখক-পাঠকের মাঝখান থেকে প্রকাশকের ভূমিকা কমলেও নতুন পাঠক তাকে কীভাবে আত্মস্থ করছে, তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়।