এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম || এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
Bangladesh Quota Protest: বাংলাদেশের মানুষের এবারের সংগ্রাম আর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে না, বাংলাদেশের এবারের সংগ্রাম নিজের রাষ্ট্রের অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
কিছু কিছু সময় আসে, যখন সময় আসে না। যায়ও না। সময় একটা পাথরের মতো, জমাট বাঁধা রক্তের ভেতর একটা ঠান্ডা শক্ত লাশের মতো একটা জায়গায় স্থির হয়ে ঘোলা পাথরের চোখ মেলে শুয়ে থাকে। আপনি রিয়ালিটিকে প্রশ্ন করতে থাকেন, আপনি মেট্রিক্সের ভেতর আছেন কিনা, আপনি একটা হেলিওজিওসেন্ট্রিক সিমুলেশানের, কারুর ভিডিও গেইমের অংশ কিনা ভাবতে থাকেন, নিজের ইন্দ্রিয়গুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন, আপনার মাথায় ট্যারেন্টিনোর লুসিড স্বপ্নদৃশ্যের মতো ঘুরতে থাকে রিয়া গোপ নামের একজন পাঁচ বছর বয়সি, আবদুল আহাদ নামের একজন চার বছর বয়সি শিশুর মৃতদেহের কথা, শ’খানেক পোলিসের সামনে দু’হাত মেলে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা নিরস্ত্র আবু সাঈদের বুকে টুয়েলভ গেজ শটগানের গুলি নিয়ে রাস্তায় হাঁটু ভেঙে পড়ে যাওয়া কথা, আপনার মাথায় ঘুরতে থাকে আর্মার্ড কার থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো একজন কিশোরের পরনের রক্তাক্ত জিন্সের ট্রাউযার্সের কথা— আপনি কেন ঠিক এসময়ই মৃতদেহের পোশাক নিয়ে ভাবছেন ভেবে আশ্চর্য হন নিজের কাছেই, এবং পরমূহুর্তেই ঢুকে পড়েন কালো রঙের হেলিকপ্টারের পেটের ভেতর থেকে ঝটঝটঝটঝট শব্দে নামা কমান্ডো বাহিনীর চৌকস মচমচে ইউনিফর্মে মোড়ানো টিয়ার শেলের ধোঁওয়ার বারুদের রক্তের নোনতা স্বাদের লাশের ওপর প্রিয়জনের এলোমেলো নাম্ব আচরণের জান্তব চিৎকারের পুরানো উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় পরবর্তী শীতল নন-শ্যালন্ট কাঁধ-ঝাঁকানো “হু গিভস আ ফাক্?” বলে এতদিন ব্লক করে রাখা প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে পাঠানো,
“তুমি বেঁচে আছো? মরে যেও না প্লিজ।”—টেক্সটে।
এটা এমন এক অদ্ভুত সময়, যখন আপনি নিজের মৃত্যু কামনা করেন, একলা একলা বেঁচে আছেন বলে, এই মূহুর্তে আপনাকে দেশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে নিজেকে এবং নিজের বাবা-মা’কে স্বার্থপর বলে ভাবেন, নিজের ক্ষুধা তৃষ্ণা জৈবিক চাহিদার জন্য নিজের পরিষ্কার সাদা চাদরের বিছানার জন্য নিজেকে ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, কিন্তু আপনি মরে যেতে পারেন না, আপনি ফোন একবার বন্ধ করে বিছানায় শুয়েও এপাশ ওপাশ করেন, এবং নিজের অজান্তে পরক্ষণে ফোন খুলে ডুমস্ক্রলিং করতে থাকেন গ্রাফিক ভায়োলেন্সের ট্রিগার ওয়ার্নিং দেওয়া পোস্টে আর সংবাদমাধ্যমের ডেথ কাউন্টের লিংকে।
আপনি দেখেন, সংখ্যাটা ক্রমাগত বাড়ছে।
একদিনে ৬ থেকে লাফ দিয়ে ৩৯, সেই থেকে এক লাফে ১৯৭…
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যা চালানো হচ্ছে, তার নাম গণহত্যা। এবং এই আলাপে কোনো ইফস এ্যান্ড বাটস নাই। এই আলাপে, “কিন্তু ছাত্ররা তো প্রথমে…” “কিন্তু দুষ্কৃতীরা তো মেট্রোরেলে…” বলে বাক্য শুরু করার কোনো অবকাশ নাই। এই আলাপ রাজাকারের আলবদরের দেশদ্রোহীর জামাত শিবির বিএনপি ওসামা বিন লাদেনের সিআইএর রয়ের ইয়াসির আরাফাতের বুশের ব্লেয়ারের নাইনএলেভেনের ওয়েপন অভ মাস ডেসট্রাকশানের ইরাক ওয়ার ওয়াহাবিজম ইরানের রেভোলুশান নিক্সন গভর্নমেন্টের পুতিন চায়নার কিম কার্দাশিয়ানের বায়োলজিকাল ওয়েপোনের হলিউড বলিউডের ঢিঙ্কাচিকা নাচের মোদির পানির নিচে শিবলিঙ্গের চন্দ্রঅভিযানের অমুক তমুক হিন্দুত্ববাদের “ছিলো বেড়াল হয়ে গেলো রুমাল” জাতীয় কোনো প্রকার ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে ঢাকার কোনো সুযোগ নাই। এটা একটা প্লেইন এ্যান্ড সিম্পল গণহত্যা। ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিকের ওপর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের চালানো ক্র্যাকডাউন। নিজেদের বাচ্চাদের ওপর চালানো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এ-কে পেট্রোন এ্যাসল্ট রাইফেলের লাইভ এ্যামো দিয়ে নিজের ট্যাক্সপেইং নাগরিকের ওপর কুৎসিত ক্ষমতাচর্চার সর্বোচ্চ প্রকাশ।
‘আদর’ করে ডাকা হাসিনাশাহী নামের এই শেখ হাসিনার অবৈধ লাইলাতুল ইলেকশানের সরকারের পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ পর্যবেক্ষণ করলে যে শাসনব্যবস্থা আমরা দেখি, তাতে নিপাট কর্তৃত্ববাদের বিপরীতে ফ্যাসিস্ট ধাঁচের সমস্ত উপাদানকে নির্দিষ্ট করে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকাদ দমন এবং আমলাতান্ত্রিক আত্মীয়পোষণকারী ভাইবেরাদারিবাদ (ক্রনিজম) জাতীয় উপাত্তগুলিকে ফ্যাসিবাদী আন্ডারটোন হিসাবে দেখা গেলেও জনতার একজোট হওয়ার ক্ষমতা খর্ব হওয়া এবং লিগের পোষা এলিটদের মধ্যে স্ব-স্বার্থকেন্দ্রিক সংহতি শাস্ত্রীয় ফ্যাসিবাদী ডক্ট্রিন থেকে ভিন্ন একটা চিত্র আমাদের সামনে তুলে আনে। এবং এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লিগের অবশ্যম্ভাবী পতনের জন্য একমাত্র এবং একমাত্রই হাসিনাকে, এবং তার প্রতিহিংসাকে দায়ী করার মাধ্যমে লিগের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকলাপ উপেক্ষা করা হয়।
আমি খুবই বিতর্কিত একটা কথা এক্ষেত্রে বলতে চাই। এবং তা বলার আগে ডিসক্লেইমার আকারে এও উল্লেখ করতে চাই যে, আমার নিজের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আমি কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানপন্থী রাজাকার সিম্প্যাথাইজার কোনো মানুষ না। আমার নিজের পরিবার প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী রাজনীতি থেকে তৈরি হওয়া এবং বর্তমানেও সক্রিয়ভাবে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত থাকা পরিবার। এবং এই ডিসক্লেইমার পরবর্তী আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমাকে এই ডিসক্লেইমারের পরেও রাজাকার সিম্প্যাথাইজার বানানোর সমূহ সম্ভাবনা মাথায় রেখেই আমি বলব, আমি বিশ্বাস করি, ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদেরও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রশ্ন সমাধানের ক্ষেত্রে মানবাধিকার এবং যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য, যা আওয়ামী সরকার গত চোদ্দ বছর লঙ্ঘন করে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, এমনকী ঐতিহাসিক গ্রিভেন্সের মুখোমুখি হয়েও, এমনকী চিহ্নিত শিশু-ধর্ষকের জন্যও, চিহ্নিত খুনীর জন্যও আমাদের আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে হবে যাতে ন্যায়বিচারের অবক্ষয় এবং সহিংসতার চক্র বন্ধ করা যায়। আমাদের বুঝতে হবে নৈতিক সামঞ্জস্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের জন্য এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ আলাপচারিতার ক্ষেত্র— বা জবাবদিহিতার ক্ষেত্র বজায় রাখা অত্যন্ত অত্যন্ত অত্যন্ত জরুরি, কারণ এই জবাবদিহিতাই একটা ন্যায় এবং স্থিতিশীল সমাজের ভিত্তি— যা লিগের শাসনামলে অনুপস্থিত ছিল, বা এখনও আছে, আজকের দিন পর্যন্ত।
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। সেই সময়ই রাজাকারের 'ফাঁসি চাই' স্লোগানের বিপরীতে আমার অবস্থান ছিলো। আগেই বলেছি, আবার বলছি, আমি রাজাকারের পক্ষের মানুষ না। রাজাকারদের ন্যয্য বিচার আমি অতি অবশ্যই দাবি করি, কিন্তু তা কোনোভাবেই বিচারবহির্ভূত অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গায়ের জোরে না। ২০১৩ সালেই আমি প্রকাশ্যে শাহবাগের বিপক্ষে অবস্থান করছিলাম শাহবাগ স্বৈরাচার জন্ম দিবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করে। আমার ভবিষ্যদ্বাণীর একমাত্র ভুল, শাহবাগ শুধু স্বৈরাচার জন্ম দেয়নি, স্বৈরাচারের বড় ভাই ফ্যাসিস্ট জন্ম দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থায় দু’টা সাধারণ বৈশিষ্ট্য সব সময় দেখা যায়। প্রথমত, ফ্যাসিস্ট নেতারা কখনও পরিষ্কার বাস্তব লক্ষ্যের কথা বলেন না, বা গঠনমূলক কার্যকলাপে যুক্ত থাকেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের বক্তব্য প্রধানত ঘৃণা, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং তাদের আদর্শগত গোষ্ঠীর বাইরের লোকদের অপমান বা অপরায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
একথা অনস্বীকার্য যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লিগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলত তাদের হাত ধরেই এই ভূ-খণ্ড পাকিস্তানের রাজ্য থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসাবে জন্ম নেয়। লিগের প্রধান শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই এই অঞ্চলের ভূমিপুত্রকন্যারা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে যোগ দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে নিয়ে আসেন। তবে এ কথা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হলেও অতি অবশ্যই বলতে হবে যে— ৭১ এ মুজিব যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, একই ভাবে একই স্কেল একই ম্যাগনিচুডে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন ভাসানী, মেজর জিয়া, তাজউদ্দীন, নজরুল, তোফায়েল, আবুল হাসেম, মেজর জেনরেল ওসমানি— এবং আরও অনেকে। তবে আলাপের বিষয় এই মূহুর্তে মুজিব ছাড়া অন্য কেউ না। স্বাধীনতা পরবর্তী মধ্যবামপন্থী লিগের বা বলা ভালো— মুজিবের হঠাৎ করেই ক্ষমতালোভী রক্ষীবাহিনি নির্ভর একনায়কতন্ত্র বাকশালে রূপান্তরের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জন্য প্যারাডাইম শিফটিং ঘটিয়ে দেয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট নামক রাত। এই রাতে নৃশংসভাবে পুরো পরিবার-সহ খুন হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হিসাবে খ্যাত শেখ মুজিবর রহমান। লন্ডনে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান দুই মুজিব কন্যা, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। এরপর দীর্ঘদিন প্রবাসে আত্মগোপন করে থেকে দেশে ফিরে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু হাসিনার বা লিগের এই ক্ষমতা দখলের পেছনে দু’টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ না করলেই না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা লিগের প্রধান ট্রাম্পকার্ড, তা তো বলাই বাহুল্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের নেতৃত্বের মূলধন ব্যবহার করে তারা ‘মি ভার্সাস আদার্স’ এর দ্বন্দ্বমূলক আখ্যান প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষমতায় আসে, এসব সবাই জানেন। এবং এখানে মতভেদ মানেই দেশবিরোধিতার রাষ্ট্রদ্রোহিতার নিজের মানুষের সাথে বেইমানির, গাদ্দারির সমান— যেই টেকনিক ফ্যাসিবাদী শাসনের টেকনিক-১০১, সেটাও কারুর অজানা না।
এই অপরায়নের মেরুকরণের পাশাপাশি লিগ সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনের প্রথম ঘটনা ছিলো ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে পুলিশের হাতে বস্ত্র কারখানার কর্মী ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও খুন। তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অধীনে পুলিসি বর্বরতার যে ঘটনা বাংলাদেশ দেখেছিল, তা কেন্দ্র করেই লিগের নৈতিক উচ্চতা ও ভিকটিমহুডের আখ্যান আরও শক্তিশালী হয়। দ্বিতীয়তঃ, একই বছর মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচনকে ক্যাশ করার ঘটনা এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ‘কথিত’ নির্বাচন, যেখানে অবশ্য বিএনপি বিজয়ী হয। পরবর্তীতে লিগের দেশব্যাপী লাগাতার সহিংস জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন ও অবরোধ ঐ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় খাদ্য যোগায়। খালেদা জিয়ার অদূরদর্শীতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব এবং ইয়াসমিন বিষয়ে সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে লিগ প্রবেশ করে নতুন যুগে। এবং যুগপ্রবেশের উদযাপনেই ঘোমটা লজ্জা আব্রু পোশাক ত্যাগ করে সম্পূর্ণ উদগ্র উলঙ্গ হয়ে নিজেদের সব রঙ রূপ রস মাহাত্ম্য দেখাতেও তারা বেশি সময় নেয় না। ক্ষমতায় এসেই তারা তাদের বিপক্ষে অবস্থানকারী প্রত্যেককে রাজাকার বানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজাকার শব্দের চাইতে ঘৃণ্য শব্দ সম্ভবত আর দ্বিতীয়টা নাই। রাজাকার আরবী শব্দ; এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু ব্যবহারিক বা প্রায়োগিকভাবে, অন্তত বাংলাদেশের কনটেক্সটে রাজাকারের কনোটেশান অত্যন্ত ঘৃণিত। রাজাকাররা ছিলেন পাকিস্তানী শাসক দলের তাবেদার, কন্সপিরেটোর, গাদ্দার, বেইমান, মুনাফেক— সামান্য টাকা বা সামান্য ক্ষমতার আশায় তারা নিজের মুক্তিযোদ্ধা ভাইবোনদের ধরিয়ে দেন হানাদার বাহিনির হাতে, তারা আদর্শিক বা ধর্মীয় কারণে হোক বা ব্যক্তিগত যে কোনো কারণেই হোক— মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে হাজার হাজার নারীকে ধর্ষিত হতে তুলে দেন পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে, অসংখ্য সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পত্তি দখল করে, অসংখ্য ভাই বন্ধু আত্মীয়কে সাহায্যের নাম করে পেছন থেকে তাদের পিঠে ছুরি বসিয়ে দেন নিঃশব্দে। কিন্তু হরেদরে এই রাজাকার শব্দের অসৎ যত্রতত্র ব্যবহার আমরা দেখি লিগ আমলে। ১৯৯৬ থেকেই আমরা দেখি লিগের সামান্যতম বিরোধিতা করা, লিগের সামান্যতম সমালোচনা করা প্রতিটা এনটিটিই রাজাকার হয়ে উঠছেন। রাজাকারের পৃষ্ঠপোষক জামাত। এবং জামাতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির, বা সংক্ষেপে শুধুই শিবির, সকলই তখন রাজাকার। এবং এই বলির পাঁঠা শুধু বিএনপি জামাত শিবিরের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা হন নাই সে সময়, এই বলির পাঁঠা হয়েছেন বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানও। দাঁড়ি টুপি তসবিকে রাজাকারের চিহ্ন বলে দাগিয়ে দেওয়ার মাঝখানে পড়ে যান নামাজরোজা করা দাঁড়ি রাখা টুপি পরা সাধারণ মুসলমান। কার্ল শ্মিটের মতে, এ ধরনের মেরুকরণ, এই ধরণের শত্রু-মিত্র বিভাজন তৈরির, ভাণ্ডবাটি আলাদা করে একলা একলা আমবাগিচার তলায় চড়ুইভাতি খেলার ক্লাসিক উদাহরণই ফ্যাসিবাদী শাসনের অন্যতম প্রধান মৌলিক উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক নেতৃত্বের এক গান দিনের মধ্যে চল্লিশবার জপার মাধ্যমে, ৭ মার্চের শেখ মুজিবের এক ভাষণ বারো মাসের মধ্যে তেরো মাস মানুষকে জোর করে গেলানোর মাধ্যমে আওয়ামী লিগ এই দ্বৈততাকে শক্তিশালী করে নিজেদেরকে জাতির আদর্শের একমাত্র ধারক বাহক রক্ষক কর্ণধার চক্ষুধার হিসেবে উপস্থাপন করে এবং তার বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করা সমস্ত বিরোধী পক্ষকে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে। এই নোংরা কৌশলই তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার মাধ্যম, রাজনৈতিক বিরোধকে শুধুমাত্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নয় বরং জাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবে উপস্থাপন করে, এবং এর মাধ্যমেই নিজেদের কর্তৃত্ববাদী প্রতিটা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মুভ এবং গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের অবক্ষয়কে ন্যায্যতা প্রদান করে আসে বছরের পর বছর।
আজকের কোটা আন্দোলন তার ব্যতিক্রম নয়।
সরকারি চাকরিতে কোটার সুবিধা চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে, শেখ মুজিবের হাত দিয়ে। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারকে কোটাভুক্ত করা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ ছিলো, সন্দেহ নাই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আজ থেকে ৫৩ বছর আগে। আজকে, ২০২৪ সালের মধ্যে, বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ইতোমধ্যেই মারা গেছেন। তাদের সন্তানরাও অধিকাংশই সরকারি চাকরির বয়সসীমাও অতিক্রম করে ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে ৩০% কোটা সংরক্ষণ বর্তমান ছাত্রদের কাছে অন্যায় মনে হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই জাল বা ভুয়া সনদের মাধ্যমে কোটাব্যবস্থার অপব্যবহার দেখছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সংজ্ঞত কারণেই বিশ্বাস করেন, লিগের স্বজনপ্রীতির চর্চা অব্যাহত রাখার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল এই কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ। এই কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালে।
আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি ছিল: কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা। টানা আন্দোলনের ফলে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থার একাংশ, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা ২০১৯ সালে বাতিল হয়ে যায়। তবে, এই বছরের জুন মাসে হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হওয়া কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে, জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয় আবার। এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ এবং সুসংহত পদ্ধতিতে চলছিলো। কিন্তু বিতর্ক শুরু হয় প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণহীন আপত্তিজনক মন্তব্যের মাধ্যমে, যখন তিনি আন্দোলনকারী সব ছাত্রছাত্রীকেই রাজাকার বলে সম্বোধন করেন।
আগেই বলেছি, লিগের এই মুভ নতুন কিছু না। তাদের বিরুদ্ধে সকল সমালোচনাকে তারা এক শব্দে নস্যাৎ করে দিয়ে আসছে এভাবেই, বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু এবার আর ছাত্রছাত্রীরা রাজাকার শব্দ শুনে মনঃকষ্টে কাঁদতে কাঁদতে আন্দোলন ফেলে কলসি কাঁখে যমুনায় চলে যান নাই। তারা এবার এই একই আলাপ শুনতে শুনতে অতিষ্ট হয়ে গর্জে উঠেছেন, ফুঁসে উঠেছেন, চিৎকার করে বলেছেন, হ্যাঁ, তারাই রাজাকার। তারা বলেছেন, “আমি কে তুমি কে? রাজাকার রাজাকার!” এবং তার পরের বাক্যেই বলেছেন, “কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার! সরকার সরকার!” কিন্তু লিগ এবং লিগের পা চাটা বুদ্ধিজীবি নামক ধ্বজভঙ্গ দালালরা এই স্লোগানে যে রাগ অভিমান উষ্মা ক্ষোভ ব্যঙ্গ আছে, তা দেখতে অক্ষম, বরং নিজেদের রাজাকার সম্বোধনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কতখানি অপবিত্র অসম্মানিত অবমাননা করা হয়েছে তার এক মুখস্ত জাতীয়তাবাদী গান গাইতে গাইতে, একটা যৌক্তিক সাধারণ ডিসেন্ট্রালাইজড আন্দোলনকে ডিলেজিটিমাইজ করতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর লিগের গুণ্ডাদের লেলিয়ে দিয়ে তাদের বীভৎস পদ্ধতিতে দমনপীড়ণ করে সারা দেশে ইন্টারনেট এবং সেলুলার ব্ল্যাকআউট করে একটা আস্ত গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে কারফিউ জারি করে রাস্তায় রাস্তায় জাতিসংঘের ইনসিগনিয়া সম্বলিত আর্মার্ড কার এবং সেনা নামিয়ে, হেলিকপ্টারে বোঝাই করে স্পেশাল ফোর্স নামিয়ে লাইভ বুলেট দিয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে।
আমি বিশ্বাস করি, আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা বর্বরতম ঘটনা হিসাবে নথিভুক্ত হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ তার ভূরাজনৈতিক ইতিহাসে তো কম আন্দোলন কম নিষ্ঠুরতা কম হিংস্রতা দেখে আসে নাই। বাংলাদেশ তো ২৫ মার্চ বা ১৪ ডিসেম্বারের রক্তের গন্ধ ভুলে যায় নাই। কিন্তু এই দুই তারিখের এক তারিখে কি নিজের রাষ্ট্রের শাসক নিজের নিরস্ত্র মানুষ এভাবে খুন করেছিলো? ইয়াহিয়ার আমলে, আইয়ুব খাঁর আমলেও তো মানুষ নিজের রাষ্ট্রের নিজের শাসকের মাধ্যমে এভাবে নিজের রাস্তায় নিজের জানলায়, পাঁচ বছরের রিয়া গোপের মতো নিজের বাসার ছাদে খেলতে খেলতে এভাবে প্রাণ দেন নাই।
এবং তারপরেও, তারপরেও অবিশ্বাস্যভাবে এই আন্দোলনকে এখনো জামাত শিবিরের বহিরাগতের আন্দোলন বলে ট্যাগ চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লিগ। ছাত্ররা যেই দাবি তোলেন নাই, তাদের মুখে সেই দাবি বসিয়ে ২১ জুলাই তড়িঘড়ি করে আন্দোলন ঠাণ্ডা করতেই জাতীয় সংবিধানের ২৯-এর ৩ ধারা লঙ্ঘন করে হাসিনার আঙুলের ইশারায় ওঠবস করা ‘স্বাধীন’ সুপ্রিম কোর্টের এ্যাপিলেট বেঞ্চ তাদের রায় জানায়। জানায়, নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৯৩% নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। বাকি ৭% এর মধ্যে ৫% মুক্তিযোদ্ধাকোটা। ১% ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আর ১% প্রতিবন্ধী-তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ কেউ এই প্রসঙ্গে আন্দোলন না করলেও, কেউ নারী কোটা বাতিলের দাবি না জানালেও তা গায়েব করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র এই আন্দোলনকে জামাত বিএনপি রাজাকারের নারীবিদ্বেষী নারীস্বাধীনতা পরিপন্থী রাজনৈতিক ন্যারেটিভের সাথে জোড়া দিতেই।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, জামাত বিএনপিকে কোনোভাবেই নারীবান্ধব রাজনৈতিক দল বলা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে লিগ নিজেই যেভাবে পিতৃতান্ত্রিক লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদের নির্যাতনের সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যুক্ত থেকেও নিজেকে নারীবান্ধব বলে ঘোষনা দেয়, তা হাস্যকর।
কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শেষ থাকে।
লিগের এই গুণ্ডামির, এই বিভৎস ফ্যাসিজমেরও শেষ আছে। হিটলারকে যেভাবে একদিন নিজের মাথায় নিজের পিস্তল ঠেকাতে হয়েছে, পরম পরাক্রমশালী মুসোলিনি যেমন নিজের ঝুলন্ত লাশকে মানুষের ঘৃণার থুতুতে ভেসে যেতে দেখেছেন, একই ভাবে একদিন আওয়ামী লিগ তার কাছ থেকে স্বাধীন হতে সেই রাষ্ট্রের মানুষের অভ্যুত্থান নিজের চোখে দেখবে, যেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা একদিন তাদের হাত ধরেই এসেছে। লিগ একদিন তার হাতে নিজের পতন দেখবে, যে শেখ মুজিবকে কোনোদিন বঙ্গবন্ধু ছাড়া সম্বোধন করে নাই। লিগ একদিন তার মাধ্যমে খুন হবে, যে শেখের বেটির জন্য জীবন দিয়ে দিতে দ্বিধা করেন নাই। লিগের বিকল্প কে, এই প্রশ্নের এখন আর সময় নাই। বাংলাদেশের শরীরে একটা ক্যান্সার হয়েছে। বাংলাদেশের ঘরের ভেতরে একটা আগুন লেগে গেছে। বাংলাদেশে একটা গণহত্যা হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই জুলাইয়ে একটা ২৫ মার্চ ঘটে গেছে। এখন এই আন্দোলন আর কোটা আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নাই। বাংলাদেশের মানুষের আজকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মানুষ দেখেছে, তার টাকায় বেতন হওয়া গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের সরকারের কী জমিদারী গ্রাম্য আওকাত, মানুষ দেখেছে আগুনে পুড়ে যাওয়া একটা জড় মেট্রোরেলের ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আহাজারির একাংশও এতগুলি নিরাপরাধ মানুষের প্রাণের জন্য ব্যয় হয় নাই, মানুষ আবু সাঈদকে রাস্তায় মরে যেতে দেখেছে, মানুষ দেখেছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের কীভাবে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তার ডিভাইডারে, মানুষ গত চোদ্দ বছর দেখেছে এই এক পদ্মা সেতুর উন্নয়নের আলাপের নামে কোটি কোটি টাকা পাচার আর দুর্নীতির খাবারে ভেজালের বায়ু দূষণের সুন্দরবন ধ্বংসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে কল্পনা চাকমা তনু সাগর রুনি অভিজিৎদের মরে যাওয়া, মানুষ দেখেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কীভাবে নাই হয়ে বাষ্পে মিলিয়ে গেছে, মানুষ দেখেছে নিজের রাষ্ট্রে মানুষ নিজেই কীভাবে ‘অপর’ হয়ে উঠেছে। তাই মানুষের, তাই বাংলাদেশের মানুষের এবারের সংগ্রাম হয়ে উঠেছে এই ক্যান্সার নির্মূলের, এই পোড়া বাড়ির কার্বন মনোক্সাইড থেকে নাক চেপে বাঁচার সংগ্রাম, এই নির্যাতন আর রাষ্ট্রীয় গুণ্ডামি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্টকহোম সিনড্রোম থেকে বের হয়ে নিজের ঘরের লোকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম আজকে আর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে না, বাংলাদেশের এবারের সংগ্রাম নিজের রাষ্ট্রের অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বাংলাদেশের এবারের সংগ্রাম আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্তির সংগ্রাম।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)