আরজি করে মাদক, যৌনচক্র, মানব অঙ্গ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ! কেন চুপ মুখ্যমন্ত্রী?
RG Kar Rape and Murder: প্রাক্তন আমলারা এই চিঠিতে আরজি করে দুর্নীতির চক্র সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আরজি করের ঘটনা নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে যে একাধিক প্রশ্নের কোনও উত্তরই নেই তা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম আরজি করের হত্যা ও ধর্ষণ নিয়ে এমন বেশ কিছু 'অপ্রিয়' প্রশ্ন তুলেছে যার উত্তর প্রশাসন দিতে অপারগ। এবার এই উত্তরহীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খোলা চিঠি লিখলেন সাংবিধানিক আচরণ গোষ্ঠীর (সিসিজি) অধীনে ১০০ জনেরও বেশি শীর্ষ প্রাক্তন আমলাদের একটি দল।
আরজি করের এই ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটি সারা দেশেই ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সিবিআই এই ঘটনার তদন্ত করছে ঠিকই তবে এই ঘটনার ছায়াতেই দুর্নীতির এক বড় অভিযোগও লুকিয়ে রয়েছে। আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠা এসব দুর্নীতির তদন্ত করতে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে রাজ্য সরকার। প্রাক্তন আমলারা এই চিঠিতে আরজি করে দুর্নীতির চক্র সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আরজি কর হাসপাতালে যৌনচক্র, ওষুধ, মানব অঙ্গ ও চিকিৎসার বর্জ্য নিয়ে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিতা তরুণী চিকিৎসক এই দুর্নীতি নিয়ে সওয়াল তুলেছিলেন। তাতেই কি এমন মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে হলো? মৃত মেয়ের বাবা-মাকে কেন আসল ঘটনা জানাতে এত দেরি হলো? কলেজের অধ্যক্ষের বদলি ও ‘প্রমোশন’ কেন ঘটল এত কিছুর পরেও? কেন অপরাধের ঘটনাস্থল অরক্ষিত রাখা হলো? প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই চিঠিতে।
আরও পড়ুন- ১৩ ঘণ্টা ধরে ক্রাইম সিন খোলা! আরজি করে পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি, নাকি অভিসন্ধি?
“আমরা সচেতন যে অন্যান্য রাজনৈতিক দল শাসিত অন্যান্য রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এগুলো কোনওভাবেই বর্তমান ঘটনার গুরুত্ব কমাতে পারে না। পশ্চিমবাংলার মতো একটি রাজ্যে, যেখানে একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, যিনি জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণকে উত্সাহিত করেন বলে জানা যায়, সেই রাজ্যে এমনটা মোটেও উচিত ছিল না। কীভাবে এবং কেন পরপর এতগুলি ভুল পদক্ষেপ করা হলো?” ২১ অগাস্ট প্রাক্তন আমলাদের লেখা চিঠিতে এই প্রশ্নই তোলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই প্রাক্তন আমলাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের কাজের মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গেও কাজ করেছেন।
আর কী লেখা হয়েছে ওই চিঠিতে? প্রাক্তন আমলারা স্পষ্ট করেছেন, তাঁদের কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই কিন্তু ভারতের সংবিধানে নিহিত আদর্শের প্রতি তারা দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই সিবিআইয়ের তদন্তের পাশাপাশিই সংবাদমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের তোলা প্রশ্ন নিয়ে তারা চিন্তিত। তারা বলছেন,
১. আরজি কর হাসপাতালে কান পাতলেই শোনা যায় যে, এখানে যৌন, মাদক, মানব অঙ্গ এবং চিকিৎসা বর্জ্যের সঙ্গে জড়িত একটি র্যাকেট চালানো হচ্ছে। ধর্ষিতা ও মৃতা তাঁর সিনিয়রদের কাছে এই তথ্যগুলি জানিয়েছিলেন কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদি এই অভিযোগ ভুয়ো হয় তাহলে সরকার এই নিয়ে স্পষ্ট করে কেন কিছু বলছে না?
২. কেন তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি ধাপে ধাপে, প্রথমে অসুস্থতা, তারপর মৃত্যু, তারপর আত্মহত্যা এবং শেষে ধর্ষণ ও হত্যা হিসেবে তাঁর বাবা-মাকে জানানো হয়েছিল? কলকাতা পুলিশ অস্বীকার করেছে যে, তারা মেয়ের বাবা-মাকে আত্মহত্যার ঘটনা বলেনি। তাহলে কে বলল?
৩. কলেজের অধ্যক্ষের উচিত ছিল পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং এফআইআর দায়ের করা। তিনি এসব তো করলেনই না উলটে রাতে ডিউটিতে থাকা চিকিৎসকদের বিশ্রামের কোনও জায়গা নেই জানা সত্ত্বেও মন্তব্য করলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক একা মেয়ে হয়েও কেন সেমিনার রুমে ঘুমাতে গেলেন!
৪. কেন আরজি কর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে বদলি করা হলো কলকাতারই অন্য একটি নামী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে?
৫. খুন হওয়া চিকিৎসকের বাবা-মা জানিয়েছেন, অন্য জুনিয়র ডাক্তাররা এই ধর্ষণ-হত্যায় জড়িত ছিল। যদি এই অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে এটি অত্যন্ত মারাত্মক ও গুরুতর বিষয়। তাহলে এই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
৬. জুনিয়র ডাক্তাররা বিশেষভাবে প্রাক্তন অধ্যক্ষ, মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট, ছাত্র বিষয়ক ডিন এবং চেস্ট মেডিসিন বিভাগের এইচওডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছে। কেন বেছে বেছে এদের কথাই বলা হচ্ছে?
৭. আরজি কর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ একশো বছরেরও বেশি পুরনো। কেন এটির পরিকাঠামো এবং পরিষেবা দিন দিন খারাপ হয়ে চলেছে? রাজ্য সরকার এই হাসপাতালের পরিকাঠামো বজায় রাখতে এবং এই হাসপাতালকে আরও আধুনিক করতে বা সুরক্ষা মজবুত করতে কেন্দ্রীয় তহবিল পাওয়ার জন্য কী পদক্ষেপ করেছে?
৮. কেন ক্রাইমসিন হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ ওই স্থান অরক্ষিত রেখে দিয়েছিল? ঘটনার কয়েকদিন পরে দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালিয়ে অনেক কিছুই ধ্বংস করে দিয়েছিল? অপরাধের ঘটনাস্থলসহ যা কিছু প্রমাণ ছিল তাও ধ্বংস করা যেত। তা যে হয়নি এই বড় বাঁচোয়া।
আরও পড়ুন- স্বর্ণপদক জয়, সেরা হাসপাতালের তালিকা, আরজি করের মৃতার ডায়রিতে যা যা লেখা…
ওই চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রাক্তন আমলারা লিখেছেন, "আমরা লক্ষ্য করছি যে আপনি নির্যাতিতার বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাদের ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করি, আপনি এমনটা নিশ্চিত করার জন্য সমস্ত সম্ভাব্য ব্যবস্থাই গ্রহণ করবেন। কোনও ব্যক্তি, সে যতই উচ্চ পদে থাকুক না কেন, তাঁকে সুরক্ষা জোগাবেন না। আপনি বাংলার রাজ্য সরকারের প্রধানের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য বিভাগের মন্ত্রী। অতএব, অপরাধ রোধ করার জন্য পদক্ষেপ করা বা সিবিআই এই তদন্তের ভার নেওয়ার আগেই এর দ্রুত সমাধান করা আপনার এবং আপনার আধিকারিকদেরই কাজ ছিল। তাহলে, আপনার প্রতিবাদ মিছিলের কী লাভ? কার বা কীসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন আপনি?”
প্রাক্তন আমলারা লিখছেন, "আপনার কথায় আমরা বিস্মিত হয়েছি যে সিবিআইয়ের তদন্ত রবিবার ১৮ অগাস্টের মধ্যে শেষ হওয়া উচিত এবং দোষীদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। বিষয়টা কানে লাগছে কারণ আপনি এবং আরও অন্যরা জানেন যে, এই ধরনের গুরুতর অপরাধের তদন্ত কয়েক দিনের মধ্যে শেষ করা যায় না। সমস্ত অপরাধের বিচার আদালতে করতে হয় এবং দোষী সাব্যস্ত আদালতই করতে পারে। আপনার দোষীদের ফাঁসি দেওয়ার দাবি আদালতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে না। এই দেশের অন্যান্য উদ্বিগ্ন নাগরিকদের মতো, আমরাও এই মামলার ফলাফল এবং দোষীদের শাস্তির জন্য অপেক্ষা করছি। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ করার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। সত্যের জয় হোক!"