ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি
Rabindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথ কিঞ্চিৎ ক্রিকেট খেলেছিলেন বটে, তবে তিনি ঠিক কোন সময়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন, তা নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা নেই কোথাও।
'রামমোহন আজ যদি ইউরোপ যাইতেন, তবে তাঁহার গৌরব ক্রিকেট খেলোয়াড় রঞ্জিত সিংহের গৌরবের কাছে খর্ব হইয়া থাকিত।'– 'ভারতবর্ষ' বইয়ে 'বারোয়ারি-মঙ্গল' নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাহলে কবিগুরু একদা দুনিয়াকাঁপানো ব্যাটসম্যান রঞ্জিত সিংহের নাম ভালোভাবেই জানতেন। রঞ্জিত সিংজি কিন্তু ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ১৮৯৬ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত। তাঁর দাপটে বোলারদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন। তাঁর খেলায় মুগ্ধ ক্রিকেটলেখক নেভিল কার্ডাস তাঁকে ''Midsummer night's dream of cricket' আখ্যায় ভূষিত করেন। রঞ্জিত সিংজীই ব্যাকফুটে খেলার টেকনিক আবিষ্কার করেন, তার আগে ক্রিকেটাররা মূলত ফ্রন্টফুটে খেলতেন। লেগ গ্লান্সও তাঁরই আবিষ্কার। তিনি ১৫টি ম্যাচ খেলে টেস্ট ক্রিকেটে ৯৮৯ রান করেন, দুটি সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ রান ১৭৫। গড় খুব ভালো, ৪৪.৯৫। তাঁর নামেই ভারতে রঞ্জি ট্রফির প্রচলন হয়। প্রসঙ্গত দলীপ ট্রফির নাম তাঁর ভাইপো ক্রিকেটার দলীপ সিংহের নাম থেকে, তিনিও ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছিলেন। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের গুণকীর্তন বা জয়গাথা সংবাদপত্র মারফত পৌঁছে যেত। রবীন্দ্রনাথ তখন নিজেও ক্রিকেটে উৎসাহী ছিলেন, তাই খোঁজখবর রাখতেন এসবের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'গোরা' উপন্যাস লেখেন ১৯০৭ সালে। সেই উপন্যাসে একজায়গায় লিখেছেন,
এখানকার মেলা উপলক্ষ্যেই কলিকাতার একদল ছাত্রের সহিত এখানকার স্থানীয় ছাত্রদলের ক্রিকেট-যুদ্ধ স্থির হইয়াছে। হাত পাকাইবার জন্য কলিকাতার ছেলেরা আপনদলের মধ্যেই খেলিতেছিল, ক্রিকেটের গোলা লাগিয়া একটি ছেলের পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে। মাঠের ধারে একটি বড় পুষ্করিণী ছিল–আহত ছেলেটিকে দুইটি ছাত্র ধরিয়া সেই পুষ্করিণীর তীরে রাখিয়া চাদর ছিঁড়িয়া জলে ভিজাইয়া তাহার পা বাঁধিয়া দিতেছিল, এমন সময় কোথা হইতে একটা পাহারাওয়ালা আসিয়াই একেবারে একজন ছাত্রের ঘাড়ে হাত দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাহাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিল।
তার মানে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ক্রিকেটের নেট প্র্যাকটিস সম্বন্ধেও অবহিত ছিলেন, খেলতে গিয়ে আঘাত লাগলে ফার্স্ট এইড নিয়েও ওয়াকিবহাল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ চিরকুমারসভা লিখেছিলেন ১৯০৪ সালে(১৩১১ বঙ্গাব্দ)। সেখানেও দেখছি ক্রিকেট নিয়ে উল্লেখ আছে। 'তোমরা যে দিনরাত্রি ফুটবল টেনিস ক্রিকেট নিয়ে থাক, তোমরা একবার...।'
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কবিগুরুর মনে ক্রিকেট গেড়ে বসেছিল।
আরও পড়ুন: চোর না পতিতা? ‘ছিনাল’ শব্দের আসল মানে রয়ে গেছে আড়ালেই
এটাকে রঞ্জিত সিংজি-র পরোক্ষ প্রভাব বলা যেতেই পারে। নাহলে রাজা রামমোহন রায়ের বিলেতযাত্রার সঙ্গে রঞ্জিতসিংহের জনপ্রিয়তার তুলনা করতে যাবেনই বা কেন! আর রঞ্জিত সিংজি তো শুধু ক্রিকেটারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন পরাধীন ভারতের নয়ানগরের জাম সাহেব। পতৌদির নবাবের মতো ছিল তাঁর স্টেটাস। জমিদার বংশের সন্তান রবীন্দ্রনাথ এই কারণেও রঞ্জিতের প্রতি অনুরক্ত থাকতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথ কিঞ্চিৎ ক্রিকেট খেলেছিলেন বটে, তবে তিনি ঠিক কোন সময়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন, তা নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা নেই কোথাও। তবে ক্রিকেট বিষয়ে গবেষক-লেখক শঙ্করীপ্রসাদ বসু (যিনি বিবেকানন্দ-বিশেষজ্ঞও বটেন) তাঁর 'সারাদিনের খেলা' বইয়ে জনৈক জগদীশচন্দ্র রায়ের 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-য় লেখা একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন, যাতে কবির ক্রিকেট খেলার সরাসরি উল্লেখ আছে।
এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যাক কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় আইসিএস। তিনি ৩২ বছর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ইংরেজের অধীনে চাকরি করেন। কিন্তু নেটিভ ইন্ডিয়ানদের তখন হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রমোশন দেওয়া হত না। সত্যেন্দ্রনাথও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। তাই ১৮৯৭ সালে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। বালিগঞ্জের ১ নং রেইনি পার্কে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন সস্ত্রীক। ওই সময়েই পিতা দেবেন্দ্রনাথ তাঁর উইল করেন, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথকে জোড়াসাঁকোর বাড়ির কোনও অংশ না দিয়ে নগদ অর্থ ধরে দেন। সেই টাকায় সত্যেন্দ্রনাথ ১৯, বালিগঞ্জ স্টোর রোডে(এখনকার গুরুসদয় দত্ত রোড) একটি সুরম্য বাড়ি তৈরি করেন। বাড়িটি ছিল বিশাল জায়গা জুড়ে, কম্পাউন্ডের মধ্যে তিনটি বড় পুকুর ও ছড়ানো বাগান ছিল। তিনতলা বাড়িটির ভেতরে একটি সাহেবিকেতার বলরুমও ছিল।
১৯০০ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ১ রেইনি পার্ক থেকে এই স্টোর রোডের বাড়িতে উঠে আসেন। জগদীশচন্দ্র রায় আনন্দবাজার পত্রিকায় চিঠিটি লেখেন ১৯৬২ সালের ৩রা জানুয়ারি। বলা বাহুল্য, তখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে বাঙালির উৎসবের রেশ চলছে।
চিঠিটির অংশবিশেষ উল্লেখ করতেই হয়–
১৯ নং স্টোর রোডে (বালীগঞ্জ) স্বর্গীয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় থাকতেন। তিনি তাঁর পেনসনের সমস্ত টাকাটাই দেশের জন্য খরচ করতেন। বিশেষ করে পালোয়ানদের ও লাঠিয়ালদের মাহিনা দিয়ে দক্ষিণ কলকাতার ছোট-ছোট ছেলেদের সংগঠন([Sic?]ও শক্তিশালী করিতেন। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে সপ্তাহে তিনদিন নিয়মিত এসে খেলায় যোগ দিতেন।
১৯ নং স্টোর রোডের সামনেই মিলিটারী মাঠ, সেই মাঠের একপাশে তখনকার দিনের ভারত-বিখ্যাত সাহেবদের ক্রিকেটক্লাব। ঐ ক্লাবে ভারতীয়দের সভ্য হওয়ার কোন উপায় ছিল না, তাঁরা যতই বড় হউন না কেন।।
কোনো একদিন ঐ ক্লাবের ক্রিকেট-খেলা দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেজদাকে বলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর ম্যানেজার ভোগেল এবং আমাকে ব্যাট, বল, নেট প্রভৃতি কিনতে পাঠিয়েছিলেন। ঐ সঙ্গে বলে দেন– ভারতীয় দোকান থেকে জিনিস কিনতে। আমরা এসপ্ল্যানেডের উত্তরদিকের দোকান থেকে সমস্ত জিনিস কিনে ফিরি। তার পরদিন থেকেই খেলা আরম্ভ হয়। সত্যেন্দ্রনাথ দুইজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানকে মাইনে দিয়ে খেলা শিখাবার জন্য নিযুক্ত করলেন। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে প্রত্যহই খেলা দেখতে ও খেলতে আসতেন। রবীন্দ্রনাথের এই খেলা কিন্তু মোটেই ভাল লাগেনি। তার কারণ একদিন খেলতে-খেলতে একটা বল তাঁর পায়ে লাগে এবং তিনি জখম হন। তাছাড়া ক্রিকেট খেলার যা বিশেষ দরকার তা তাঁর ছিল না। অর্থাৎ তিনি তাঁর মন ও চোখ ঠিক রাখতে পারতেন না। প্রায় তিনমাস পরে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় খেলা লাঠি নিয়ে থাকতেন। তাঁর দাদা অবশ্য বৃদ্ধ বয়সেও ক্রিকেট খেলতেন।
জগদীশবাবুর চিঠিটি প্রামাণ্য বলেই মনে হচ্ছে। বানিয়ে বানিয়ে এরকম লেখা একজন প্রবীণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বছরভর অনুষ্ঠানের সময়।
প্রসঙ্গত, ১৮৬১-তেই বিখ্যাত চিত্রসমালোচক স্টেলা ক্রামরিশ রবীন্দ্রনাথের আঁকায় বর্ণান্ধতার প্রভাব নিয়ে লেখেন জন্মশতবার্ষিকী-স্মরণিকায়।
পরে চিত্রসমালোচক শোভন সোম ১৯৮২-তে 'অনুষ্টুপ' থেকে প্রকাশিত তাঁর বই 'শিল্পী, শিল্প ও সমাজ' বইটিতে কবির বর্ণান্ধতা বা প্রোটানোপিয়া নিয়ে আলোকপাত করেন। ১৯৮৭তে চক্ষুচিকিৎসক জ্যোতির্ময় বসু আর ডব্লিউ পিকফোর্ড 'কালার ভিশন অ্যান্ড অ্যাসথেটিক প্রবলেমস ইন পিকচারস বাই রবীন্দ্রনাথ টেগোর' নামক গবেষণাপত্র লেখেন।
এই গবেষণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯৭ সালে কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারী লেখেন 'রঙের রবীন্দ্রনাথ' নামক গবেষণাধর্মী বইটি। রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা ছিল বলেই তিনি লাল রঙকে সবুজ বা বাদামি দেখতেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর চিত্রকলায়।।
এটা বলার কারণ এই যে, রবীন্দ্রনাথ এই বর্ণান্ধতার জন্যেই তিন মাসের মধ্যে ক্রিকেটের পাট চুকিয়ে দেন। জগদীশচন্দ্র রায় তাঁর চিঠিতে পরিষ্কার লিখেছেন, '...তিনি তাঁর মন ও চোখ ঠিক রাখতে পারতেন না...।' লাল ক্রিকেট বলকে সবুজ দেখতেন বলেই বলকে তিনি অনুসরণ করতে পারতেন না। বিশেষত সবুজ আউটফিল্ড থাকলে সমস্যা আরও গুরুতর হত। বল তাঁর দৃষ্টিপথ থেকে হারিয়ে যেত।
ঠিক কোন বছর রবীন্দ্রনাথ বালিগঞ্জের ১৯ স্টোর রোডে সত্যেন্দ্রনাথের বাড়ির মাঠে ক্রিকেট খেলতে আসতেন, তা কেউ লিখে যাননি। লেখক শঙ্করীপ্রসাদ বসুও লেখেননি সময়টার কথা।
এখানে সত্যেন্দ্রনাথের এই বাড়িতে কাটানো বছরগুলির হিসেব নেওয়া দরকার। ১৯০০ সালে(খ্রিস্টাব্দে) তিনি এই বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ১৯১২ সালের Thackers Directory'-র রেকর্ডে বাড়িটির নাম 'Granville'। ১৯১৮-'১৯-এ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িটি বিক্রি করে দেন বিড়লাদের। পুত্র সুরেন্দ্রনাথ দেনার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনের টাকা জোগাতেই বাড়িটি বিক্রি করেন সত্যেন্দ্রনাথ।
ওদিকে রবীন্দ্রনাথ বড় মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ের পর ১৯০১-এ আর দুই মেয়ে রেণুকা ও মীরা, আর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রথমে শিলাইদহ ও পরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। দেবেন্দ্রনাথের সেই আদি শান্তিনিকেতনে গিয়ে এবার তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করবেন। খোলনলচে বদলে দিয়ে একে একে গড়ে তুলবেন সবকিছু।
অর্থাৎ, ১৯০০-'০১-এই মাত্র কবির ফুরসত ছিল প্রতিদিন জোড়াসাঁকো থেকে বালিগঞ্জের স্টোর রোডে গিয়ে ক্রিকেট খেলার। ট্রামে করে ধর্মতলা হয়ে বালিগঞ্জ এমন কিছু দূর ছিল না। যদিও ঘোড়ার গাড়িতেও যাওয়াও সম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে। তাঁর বয়স তখন মাত্র চল্লিশ ছুঁইছুঁই। ক্রিকেট খেলার নেশা এই বয়সেও থাকে। চল্লিশের পর তা আস্তে আস্তে কমে যায়। মনে হয়, ১৯০০-'০১-ই সেই সময়, যখন রবীন্দ্রনাথ বালিগঞ্জে যেতেন মেজবৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর সাহেবি খানাপিনা ও ক্রিকেটের টানে। রান্নার সুবাস ও ক্রিকেট তখন কবির চিত্তে ঝড় তুলেছে। ওদিকে ইংল্যান্ডে রঞ্জিত সিংজীও তখন ফর্মে আছেন। বিলেত থেকে নেটিভ ভারত পর্যন্ত ম' ম' করছে তাঁর ব্যাটিং-সৌরভে। নেভিল কার্ডাসের মত লেখকও তাঁর বন্দনা করছেন।
বিশ্বভারতী গড়ে ওঠার আগে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম(বোলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয়)। আশ্রমের ছাত্রদের ক্রিকেট খেলা শেখাতেন রেবাচাঁদ নামে এক শিক্ষক। তিনিও ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় গড়ে তুলতে অর্থ দিয়েছিলেন। অনেকে বলেন তিনি নাকি আদতে খ্রিস্টান ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর নাম হয় অনিমানন্দ। যাহোক রেবাচাঁদের দলের সঙ্গে কবিগুরুকে আর গা-ঘামাতে দেখা যায়নি। ক্রিকেটের প্রতি তখন আর কোনও মোহ নেই তাঁর।
রবীন্দ্রনাথ চিরকুমারসভা আর গোরা লিখেছিলেন যথাক্রমে ১৯০৪ ও ১৯০৭-এ। এর আগেই তাঁর বলিগঞ্জপর্ব শেষ হয়ে গেছে। তাই চিরকুমারসভা আর গোরায় তাঁর বালিগঞ্জীয় ক্রিকেট-অভিজ্ঞতার নিদর্শন পাওয়া যায়। এমনকি নিজের পায়ে চোট পেয়ে জখম হওয়ার কথা 'গোরা' উপন্যাসে স্কুলছাত্রের পায়ে ক্রিকেট বলের আঘাতের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন।
১৯৩৩-'৩৪-এ ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল প্রথম ভারত সফরে আসে। বোম্বাই, কলকাতা ও মাদ্রাজে তিনটি টেস্ট খেলে। প্রথম ও তৃতীয় টেস্টে ভারত হেরে যায়। শুধু কলকাতার ইডেন গার্ডেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টটি ড্র হয়। ইংল্যান্ডের সিরিল ওয়াল্টার্স, ডগলাস জার্ডিন, ব্রায়ান ভ্যালেন্টাইনের ব্যাটিং, হেডলি ভেরিটি-ক্লার্কের বোলিং যেমন দর্শকদের মাতিয়েছিল, ভারতের লালা অমরনাথ, বিজয় মার্চেন্ট, সি কে নাইডু(ক্যাপ্টেন), সি এস নাইডু, মুস্তাক আলি, দিলওয়ার হোসেনের ব্যাটিং, মহম্মদ নিসার আর অমর সিংয়ের বোলিংও মাতিয়েছিল ভারতবাসীকে। রবীন্দ্রনাথ তখন নোবেল জয়ের পর কুড়ি বছর পেরিয়ে এসেছেন, বিশ্বভারতীর সর্বময় কর্তা তিনি। সকলের গুরুদেব। ক্রিকেট তাঁর নজর থেকে সরে গেছে। তাঁর কোনও লেখায় মহম্মদ নিসার-অমর সিং পেস-জুটির কথা, লালা অমরনাথ, বিজয় মার্চেন্টের কথা পাওয়া যায় না। সেই সফরে ইডেনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কারও খেলা দেখা বাবদ কোনও খরচের উল্লেখ নেই ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার জাবদা ক্যাশবহিগুলিতেও।
তবে আমরা কী করে ভুলব, বিদুষী কেতাদুরস্ত মেজবৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর রান্নার টানে, রইস ক্রিকেটের ব্যাটবলের টানে, ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথকে নিয়ে সাতসকালে বালিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন বছর উনচল্লিশের তরতাজা কবি। সেখানে কত কিছু অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। ভাবলেই গায়ে রোমাঞ্চ দেয়।