বিয়েতে নিজেকেই নিজে সম্প্রদান করেছিলেন এই বিধবা কনে, আশীর্বাদ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাধারাণীকে আশীর্বাদ জানিয়ে নাম লিখে পাঠালেন একটি চিঠি, "আজ থেকে তুমি নতুন জীবনে আনীতা হলে তাই তোমার নাম নবনীতা।"

'রাধারাণী-নরেন্দ্রনাথ দেব বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান!’

একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম।

বিয়ের দিন- ১৯৩১-এর ৩১ মে (পরের দিন এই খবর প্রকাশিত হয়।)

পাত্র- কবি নরেন্দ্রনাথ দেব।

পাত্রী- কবি রাধারাণী দেবী।

শুধুমাত্র কন্যা নিজেই নিজের সম্প্রদান করেছিলেন বলে নয়, তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে এই খবর ঝড় তুলেছিল এই কারণে যে, এক বিধবার বিয়ে। তাও আবার পাত্র-পাত্রী দু’জনেই কবি। কিন্তু সেদিন কবিদম্পতিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রমথ চৌধুরীরা।

বারো বছর পূর্ণ না হতেই বাবা পাত্রর সন্ধান করে তাঁর বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। মেয়েটার আরও পড়ার ইচ্ছা ছিল। সেই রক্ষণশীল সমাজ তাঁর ইচ্ছায় আমল দেয়, তা হয় নাকি! পাত্রের নাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। বয়স চব্বিশ। ইলেকট্রিক‍্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ করতেন মধ্য ভারতের রামপুর স্টেটে। মেয়েটার তখন তেরো পূর্ণ হয়নি। এই মেয়েটাই আগামীর কবি রাধারাণী দেবী এবং নবনীতা দেবসেনের মা।

আরও পড়ুন: ‘অসুস্থ তো স্টেজে নেমেছেন কেন!’ একরাশ অপমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাংলার প্রথম ম‍্যাটিনি আইডল

বিয়ের পর সত্যেন্দ্রনাথ কর্মস্থলে চলে যান। আর রাধারাণী চলে আসেন বাপের বাড়ি। তখনকার দিনে এটাই ছিল রীতি। বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই খবর এল, সত্যেন্দ্রনাথ কর্মস্থলে এশিয়াটিক ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন। রাধারাণীকে নিয়ে যেতে হলো। শ্বশুরবাড়ির লোকরা রাধারাণীকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। কিছুই বুঝতে পারেননি তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন, খাটের ওপর শুয়ে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ। বিয়ের মতো তাঁর কপালে চন্দনের ফোঁটা। এক বালিকার কাছে নির্মম বিস্ময় সেদিনের সেই দিন।

বৈধব্য কী, সেটা বুঝতেই খানিকটা সময় লাগল রাধারাণীর। শাশুড়িমা সুশীলাবালা দত্ত ঠিক করলেন ফের রাধারাণীর বিয়ে দেবেন। রাধারাণীর মা নারায়ণী সেকেলে মানুষ। কলকাতা থেকে বাপের বাড়ি মাথাডাঙায় ফিরতে হল তাঁকে। পাতে পড়ল হবিষ্যান্ন। মাথা প্রায় ন‍্যাড়া করে দেওয়া হলো। গায়ে উঠল থান। নিষ্ঠুর সমাজ ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিল বৈধব্যযাপন কাকে বলে!

পরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলেও মা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন রঙিন শাড়ি আর আমিষ আহার চলবে না। সেকথা জেনে কষ্ট পেলেন শাশুড়ি সুশীলাবালা। তিনি হাল ছাড়লেন না। আদরের বউমার গায়ে আবার উঠল ইঞ্চি-পাড় কাপড়, হাতে দু’গাছি চুড়ি, গলায় কানে সোনা।

রাধারাণীর আত্মপ্রকাশ দেখা গেল সাহিত্যক্ষেত্রে। তাঁর লেখালেখির মধ্যে প্রথম গল্প 'বিমাতা’ প্রকাশিত হয় `মাসিক বসুমতী’-তে ১৯২৪ সালে। প্রথম প্রবন্ধ 'পুরুষ’। প্রকাশিত হয় 'কল্লোল'-এ। এর পাঁচ বছর বাদে প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাধারাণী দত্তর 'লীলাকমল’। ইট, কাঠ, পাথর আর কংক্রিটে ক্লান্ত হয়ে গেলেন শিলং পাহাড়ে হাওয়া বদলের জন্য। পাইনের সারির মাঝে ধীরে ধীরে জন্ম নিলেন অপরাজিতা দেবী। ওই নামে 'ভারতবর্ষ’ দু’টি কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যমহলে হুলুস্থূল। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হলো অপরাজিতা দেবীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বুকের বীণা’।

অপরাজিতা নামধারী এই মহিলা আসলে কে, তা নিয়ে ধন্দ বাধল। এর প্রধান কারণ, অপরাজিতার নামে লেখা এই কবিতাগুলো রূপে, রসে, গন্ধে, প্রকৃতিতে আর পাঁচজনের চেয়ে এক্কেবারে আলাদা। কারও সঙ্গে মেলানোই যায় না। রহস্য যাতে আরও দানা বাঁধে তাই, অপরাজিতা দেবীর 'পুরবাসিনী’ কাব্যগ্রন্থটির উৎসর্গ অংশে দেখা গেল, তা `রাধারাণী দেবী ও নরেন্দ্র দেবের করকমলে’ অর্পিত। কবিতার সূত্রে আগেই তাঁর আলাপ হয় কবি নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে। ২৮ বছর বয়সে, ৩১ মে, ১৯৩১-এ সেই নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিয়ে হলো রাধারাণী দেবীর।

বিধবা হয়ে সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যসভায় নারীর প্রবেশ থেকে বিধবাবিবাহ– একের পর এক শেকল ভাঙলেন রাধারাণী। এর পরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিধবাবিবাহের অনুমতি চাইতে গেলেন রাধারাণী ও নরেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথও মত দিলেন এই বিয়েতে। শুধু তাই নয়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রমথ চৌধুরীরাও দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন কবি দম্পতিকে।

একজন বিধবা নারী নিজের ইচ্ছায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করছেন ২৮ বছর বয়সে, ১৯৩১ সালে এ ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। তাই এই বিধবা বিয়ে নিয়ে সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল ‘রাধারাণী-নরেন্দ্রদেব বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান!’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাধারাণীকে আশীর্বাদ জানিয়ে নাম লিখে পাঠালেন একটি চিঠি, "আজ থেকে তুমি নতুন জীবনে আনীতা হলে তাই তোমার নাম নবনীতা।" রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিবাহের পর রাধারাণীর নবজন্ম হোক। তাই নবনীতা নামে নতুন পথ চলা শুরু হোক ভাবশিষ্যার।

কিন্তু রাধারাণী ছিলেন নিজের মতে চলা তেজস্বিনী মহিলা। তিনি উত্তরে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, "আমি আপনার আশীর্বাদটুকু নিলাম। কিন্তু নামটা নিতে পারলাম না। আমি ২৮ বছর ধরে রাধারাণী। ওই নামে আমার দুটো বই আছে। কাজেই আমি এই নাম নিতে পারব না। তবে আপনার দেওয়া নবনীতা নামটা আমি তুলে রাখলাম আমার মনের মণিকোঠায়।" তিনি যে সেই নাম আসলে তাঁর ভাবী সন্তানের জন্য তুলে রেখেছিলেন, হয়তো সেদিন কেউ তা বুঝতে পারেননি।

বিধবা জীবনের লড়াই মুছে ফেলতে চাননি রাধারাণী। বরং দুঃখকেই করলেন জীবনের পাথেয়। বিয়ের পরপর নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণীর এক পুত্রসন্তান হলেও সে মারা যায়। এরপর স্ত্রীর পুত্রশোক ভোলাতে নরেন্দ্র দেব দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। বাড়ির নাম দেওয়া হয় ‘ভালো-বাসা’। সেখানেই ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্ম হয় নরেন্দ্র-রাধারাণীর এক কন্যাসন্তানের। ডাকনাম খুকু। বিয়ের আট বছর পরে জন্ম হলো এই কোল আলো করা, মন ভালো করা মেয়ের। তখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভীষণ অসুস্থ। শেষ শয্যায় শুয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্নেহের রাধুর (রাধারাণী দেবী) মেয়ের নাম রেখেছিলেন অনুরাধা। নামকরণের তিন দিন পরই প্রয়াত হন শরৎচন্দ্র। কিন্তু সেসময় ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে এল একখানি চিঠি। পাঠিয়েছেন কে? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

তাঁর দেওয়া 'নবনীতা' নাম রাধারাণী প্রত্যাখান করায় রবীন্দ্রনাথ একটু মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন। সে-যুগে সবার কাছেই রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম ছিল মহার্ঘ, সেই নাম প্রত্যাখান করেন রাধারাণী। (নবনীতার স্বামী অমর্ত্য সেনের নামও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া)। সেই ব্যাপারটা কবিগুরু ভোলেননি। তাই রাধারাণী-নরেন্দ্রর মেয়ে হয়েছে শুনেই তিনি আবার চিঠি লিখলেন, রাধারাণীর মেয়েকে। সরাসরি ‘কল্যাণীয়া নবনীতা’ নামে। নবনীতার বয়স তখন তিন দিন।

কবিগুরু লিখলেন, "তুমি যেহেতু এখনও কোনও উপহার প্রত্যাখ্যান করার মতো বড় হওনি, তাই উত্তরাধিকার সূত্রে তোমার নাম নবনীতা হলো‌।" এবার রাধারাণী মেয়ের নাম প্রত্যাখান করার সাহস দেখাতে পারলেন না। শরৎচন্দ্রের দেওয়া অনুরাধা নামের পরিবর্তে মেয়ের আনুষ্ঠানিক নাম হলো নবনীতা। তিনিই বাংলা সাহিত্যের লড়াকু মেয়ে নবনীতা দেবসেন।

...ভয় তাড়া করেছিল তাকে

মেয়েটা ছুটতে, ছুটতে, ছুটতে

কি করে? মুঠোর ছোট্ট আতরের শিশিটাই

ছুঁড়ে মারল ভয়কে-

আর অমনি সেই আতর ফুঁসে উঠল

ফেঁপে উঠল ফেনিল ঘূর্ণিতে, প্রখর কলরোলে

যোজন যোজন ব্যেপে হিংস্র গেরুয়া স্রোতের

তোড়ে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল

ভয়কে-...।

যে মা জীবনের রক্ষণশীলতা, আবহমানতাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখান, তাঁর মেয়ের কলম থেকেই তো উৎসারিত হয় এই লড়াইয়ের মেজাজ। তিনিই তো বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রাণের 'আনীতা’ নবনীতা।

More Articles