আজও মহালয়ার ভোর মানেই রেডিও! আকাশবাণী থেকে এফএম, অব্যাহত নস্টালজিয়া

কলকাতায় রেডিওর যাত্রা শুরুর গার্স্টিন প্লেস আজ মাটিতে মিশে গিয়েছে। রেডিওতে নতুন অনুষ্ঠান এবং সম্প্রচারক দর্শকদের নিজেদের অনুষ্ঠান শোনানোর চেষ্টায় ক্রমাগত নিজেদের রূপ বদলে চলেছে।

 

"আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি.."

বিগত শতকের শেষ দিকেও রেডিও সম্প্রচারের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। নতুন প্রযুক্তির আগমনের পর মানুষের মধ্যে সেসবের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে শুরু করে, এবং প্রযুক্তির পৌষমাসই রেডিওর সর্বনাশ কিছুটা হলেও ডেকে এনেছিল। এখন তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। প্রায় একশো বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে বাঙালিদের কাছ থেকে শুধুমাত্র মহালয়ার দিন সকালে আকাশবাণী তার পুরনো খাতির কিছুক্ষণের জন্য ফিরে পায়। যদিও কিছু বেসরকারি সংস্থার রেডিও অফিস বিভিন্ন নতুন নতুন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কিছুটা সমর্থ হয়েছে।

১৯২৩-১৯২৪ সালে বম্বে, মাদ্রাজ এবং কলকাতার মানুষ নিজেদের প্রচেষ্টায় কিছু রেডিও ক্লাব গড়ে তুলেছিল। ১৯২৩ সালেই জন রুজ স্টেপলটনের প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছিল বেঙ্গল রেডিও ক্লাব। এই জন স্টেপলটন টাইটানিক জাহাজের রেডিও রুমের নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বেঙ্গল রেডিও ক্লাব তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য মার্কনি কোম্পানির ছোট এফএ রেডিও ব্যবহার করত। আকাশবাণীর প্রথম সম্প্রচার হয়েছিল ১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই। তখন তার নাম আকাশবাণী ছিল না। মুম্বই, বা তৎকালীন বম্বেতে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নাম নিয়ে আকাশবাণী আত্মপ্রকাশ করেছিল। মুম্বই রেডিও স্টেশন থেকেই আকাশবাণীর প্রথম সম্প্রচার হয়। ১৯২৭-পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানিকে সরকারি দফতরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ১৯৩৬ সালে তার নাম বদলে হয়ে যায় আমাদের পরিচিত অল ইন্ডিয়া রেডিও। ১৯৫৭ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আকাশবাণীর বিখ্যাত সুরসংকেত তৈরি করেছিলেন জন ফোল্ডাস। বেহালা, তানপুরা, সেলো, ভায়োলা ব্যবহার করে আট সেকেন্ডের সেই সুর তৈরি করা হয়েছিল। একবার সুর বাজার শেষে দশ সেকেন্ডের বিরতির পুনরায় আট সেকেন্ড সুর। এই পদ্ধতিতে সেই বিখ্যাত সুরসংকেত বাজানো হয়।

কলকাতায় আকাশবাণীর প্রথম অফিস ছিল গার্স্টিন প্লেসের দুই এবং তিনতলায়। ১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় এই বেতার অফিসের উদ্বোধন করেছিলেন বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্যর স্ট্যানলি জ্যাকসন। তখন গার্স্টিন প্লেসের একতলায় এক ইউরোপীয়র ওয়াইন শপ ছিল। সেই দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একতলাতেও আকাশবাণীর অফিস খোলা হয়েছিল। গার্স্টিন প্লেসের সিঁড়িগুলি কাঠের ছিল। সেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার ফলে তৈরি হওয়া অবাঞ্ছিত আওয়াজ কাজের ক্ষতি করত। তাই সিঁড়িগুলি মোটা কার্পেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। কার্পেট দিয়ে ঢেকে অবাঞ্ছিত শব্দ এড়িয়ে গেলেও রেডিও অফিসে ভূতের গল্প এড়ানো যায়নি। গার্স্টিন প্লেসের ভূতের গল্প আজও অনেক সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। দোতলায় চেয়ারে বসে থাকা গোরা সাহেবের ভূত থেকে রাতের বেলা পিয়ানোর আওয়াজের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই ভূত দেখা এবং শোনার গল্প। কথিত আছে যে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এই বাড়ির দোতলায় এক গোরা সাহেবের ভূত দেখেছিলেন।

আরও পড়ুন: রহস্যমৃত্যুর ডিপো! ডাকবাংলো মানেই অলৌকিকের হাতছানি

শুরুতে আকাশবাণীর ঠিকানা গার্স্টিন প্লেস হলেও পরবর্তীকালে হাই কোর্টের কাছে ইডেন গার্ডেনসের পাশের বাড়ি আকাশবানীর ঠিকানা হয়েছিল। সেখানেই বর্তমানে আকাশবাণীর অফিস রয়েছে। আকাশবাণী কলকাতার সঙ্গে বহু বিখ্যাত মানুষের নাম জড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে পঙ্কজ মল্লিক, রায়চাঁদ বড়াল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, কাজি নজরুল ইসলাম বিভিন্ন সময় আকাশবাণী কলকাতার বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন।

ভারতে রেডিও সম্প্রচারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, সময়ের সঙ্গে রেডিও এবং সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের ধরনে অনেক বদল এসেছে। প্রথমে ছোট রেডিও ক্লাবগুলো শুধুমাত্র গান এবং আলোচনা-সংক্রান্ত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। ধীরে ধীরে রেডিওতে দৈনিক সংবাদ এবং শ্রুতিনাটক সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। সংবাদ ছাড়াও বিভিন্ন নতুন ধরনের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। সেই সময় প্রতি রবিবার সম্প্রচারিত হওয়া 'বিরূপাক্ষর আসর' মানুষের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল ।মহালয়ার সকালে সম্প্রচারিত মহিষাসুরমর্দিনী যেমন আজও মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়।

কলকাতায় আকাশবাণীর একচেটিয়া আধিপত্য প্রথমে টেলিভিশন এবং পরে নতুন এফএম চ্যানেলগুলোর দৌলতে কমতে শুরু করে। এই নতুন এফএম চ্যানেলগুলো শুধুমাত্র সংগীত অথবা টুকটাক খবর পরিবেশনে থেমে থাকেনি। তারা নিজেদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে থাকে। শ্রোতারা তাদের ফোন করে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিতে শুরু করেন। এছাড়া বিভিন্ন গল্পপাঠ এবং হাসির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা শুধু গান এবং খবরের একঘেয়েমি কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। কলকাতায় এই শতকের শুরু থেকে রেড, পাওয়ার, রেডিও মির্চি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। নতুন শতকে রেডিও শ্রোতাদের জন্য নতুন সম্প্রচারকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় নাম মীর। রেডিও মির্চির সকালবেলার অনুষ্ঠান হোক অথবা সানডে সাসপেন্সের গল্পপাঠ- মীর সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব পরিচিত একটা নাম। তাই তাঁর রেডিও মির্চি ছেড়ে দেওয়া আলোড়িত করেছে অনেককেই।

বর্তমানে সম্প্রচার শুনতে আর রেডিওর আলাদা যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের মুঠোফোন সেই কাজ করে দিতে পারে। কলকাতায় রেডিওর যাত্রা শুরুর গার্স্টিন প্লেস আজ মাটিতে মিশে গিয়েছে। রেডিওতে নতুন অনুষ্ঠান এবং সম্প্রচারক দর্শকদের নিজেদের অনুষ্ঠান শোনানোর চেষ্টায় ক্রমাগত নিজেদের রূপ বদলে চলেছে। এই সবকিছুর মধ্যেই বাঙালি আজও মহালয়ার সকালে রেডিও চালিয়ে শুনতে চায়, কখন বেজে উঠবে "অশ্বিনের শারদপ্রাতে... ।"

More Articles