বাবা বলেছিল, এই দুঃখটা কখনও ভুলবি না
Iraq America War: পানকৌড়ির মতো দেখতে একটা পাখি জলে ঠোঁট ডোবাল, আর উঠল না। World this week হত শুক্রবার রাতে।
সময় কখনও সখনও আমাদের এমন দৃশ্যের সম্মুখীন করে যখন মনে হয় এর চেয়ে অসময় বুঝি আর নেই। শৈশব আসলে আশ্চর্য এক মরসুম, যখন চারপাশে রঙের ঔজ্বল্য অনেক বেশি। রোদের মালিকানা নিজের আয়ত্তে আছে বলে স্থির বিশ্বাস হয়। ছাদের ফুটো আটকে দিলে বৃষ্টি আমাকে নিজস্ব একটা পুকুর উপহার দেবে বলে ভ্রম হয়। মাঠের কাদা ঠান্ডার ধাত ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ফুটবল নিয়ে আছাড়, ঋতুকে প্রশ্রয় দিয়ে চলে ফি বর্ষায়। কিন্তু বাস্তব। পাঠান স্যুট পরা সঞ্জয় দত্তের মতো দীর্ঘ ছায়া ফেলে শৈশবের বেঁটে খাটো শরীরে। শৈশবের পজিটিভ আর বাস্তবের নেগেটিভের সংঘর্ষে চিড়িক চিড়িক করে ফুলকি ওঠে। ওই ফুলকির আগুনে ফুটো হতে থাকে শৈশবের মোলায়েম মসলিন। সেই ছিদ্র দিয়ে বড় হওয়ার অজুহাতে আধপোড়া মন ক্রমশ কাঠখোট্টা হয়ে ওঠে। আমরা ক্রমশ টের পাই ডালিম কুমার বলে কেউ নেই। ঘুমন্ত রাজকন্যার পাশে পড়ে নেই কোনও সোনাকাঠি বা রুপোকাঠি।
আমেরিকা ইরাকের যুদ্ধের সময় আমি নেহাতই অপোগণ্ড শিশু। কাজেই যুদ্ধের ঠিক-ভুল, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এসব কিছুই বোঝার মতো বোধ আমার তৈরি হয়নি। শুধু রিহার্সাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর ছাদের কোণে চিলতে ঘরটা উত্তপ্ত থাকত বেশ টের পেতাম। কেউ মেঝে চাপড়ে তার তথ্য ও তত্ত্ব প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তো, আরেকজনের অস্ত্র তার অমায়িক গলা। ওই তর্ক থেকে টুকরো টুকরো নাম ছিটকে মগজে ঢুকে যেত। তার মধ্যে দুটো নাম আমার শিশু মগজেও গেঁথে গেছিল। জর্জ বুশ এবং সাদ্দাম হুসেন। বড়রা যখন চেঁচিয়ে তর্ক করছে আমি ছাদে গোল গোল করে সাইকেল চালাতে চালাতে বলতাম “সাদ্দাম হুসেন, বাদ্দাম খাবেন; জর্জ বুশ খায় খুব ঘুষ”। রীতিমতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। বুঝতেই পারছেন, যুদ্ধের গাম্ভীর্য তো বুঝতামই না, উল্টে খবরে মিসাইল, বন্দুকের ফুটেজ দেখতে রীতিমতো ভালো লাগতো। খেলতে খেলতে বল ড্রেনে ডুবে গেলে ব্যাটকে আর উইকেটকে স্টেনগান বানিয়ে আমি আর বুবাই দেওয়ালের আড়াল থেকে একে অপরকে গুলি করছি এমন ভাব করতাম, মুখে স্টেনগানের আওয়াজ করতাম “ডিগ্ ডিগ্ ডিগ্”। কখনও বুবাই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার ভান করত, কখনও আমি।
সব নিমেষে বদলে গেল একদিন খবর দেখার পর। ইরাকের তেল বোঝাই জাহাজ মাঝসমুদ্রে ডুবিয়ে দিল আমেরিকা। তাতে করে কী ক্ষতিবৃদ্ধি হল জানি না, সমুদ্র জুড়ে, সমুদ্রতট জুড়ে মরে গেল লক্ষ লক্ষ সামুদ্রিক প্রাণী, পাখি এবং সেই দৃশ্য বারবার দেখাতে লাগল খবর, World this week। আমার সাত-আট বছর বয়সী মন এই দৃশ্য দেখার জন্য একেবারেই তৈরি ছিল না। শুধু আমিই নয়, বয়স নির্বিশেষে কেউই এই দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত ছিল না। একটা দৃশ্য আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, পানকৌড়ির মতো দেখতে একটা পাখি জলে ঠোঁট ডোবাল, আর উঠল না। World this week হত শুক্রবার রাতে। ওই দৃশ্য দেখার পর খাবার টেবিলে আমরা কেউ সেদিন কথা বলিনি। ক্লাস সিক্সে পড়া আমার দাদা খাবারের মাঝপথ থেকে উঠে বমি করেছিল। বাথরুম অবধি পৌঁছতে পারেনি। রান্নাঘরের সিঙ্কেই...
আরও পড়ুন- ‘ওদিকে তাকালে চোখ খারাপ হয়!’ টুকি ও নব্বইয়ের সেই বৈশাখী বিকেল
রাতের খাবারের শেষে বাবা যখন চেয়ারে বসে বারান্দায় আয়েস করে সিগারেট খেত ওটা ছিল আমাদের দু’জনের, মানে আমার আর বাবার “us time”। তখন আমি আর কাউকে বাবার কাছে ঘেঁষতে দিতাম না। বাবা তারা চেনাত। ক্রিকেট নিয়ে মজার মজার গল্প বলত আর আমি কলকল করে অফুরন্ত কথা আর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতাম রোজ। সেদিন আমরা খাবার পরেও চুপ করে বসেছিলাম। অন্ধকার বারান্দায় একটা লাল বিন্দু বাবার আঙুল থেকে ঠোঁটে পৌঁছচ্ছে, তারপর কিছুটা ধোঁয়ার কুয়াশা তৈরি হচ্ছে আবার কেটেও যাচ্ছে– অনতিবিলম্বে।
নৈঃশব্দ্য ভাঙল বাবার গলায় – কী হয়েছে?
খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা। গলাটা হয়তো একটু বেশিই ভেজা ছিল আমার। বাবা টের পেয়ে গেল – কান্না পাচ্ছে? বাবা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ বাবা। আমি জানি লুকনোর চেষ্টা বৃথা।
বাবা বলল – আমারও। এইবার বাধ ভাঙল আমার – ওরা কী দোষ করেছিল বাবা। কেন এটা হল?
রাতের বারান্দা দেখল একটা সিগারেটের গন্ধওয়ালা হাত সাত বছরের শিশুকে বুকে টেনে নিচ্ছে। কিন্তু সান্ত্বনা দেবে যে তার জো নেই। নিজের কান্না থামলে তো। শুধু কোনওরকমে বাবা বলেছিল – এই দুঃখটা কোনওদিন ভুলবি না।
ভুলিনি।