দলের মুখ তবে রাহুলই? ২০২৪ এর আগে ভারত জোড়ো যাত্রার সূচনায় মরিয়া কংগ্রেস
Bharat Jodo Yatra: তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত এই যাত্রা শুরু হল ৭ সেপ্টেম্বর থেকে। পাঁচ মাসের কর্মসূচিতে কংগ্রেসের শতাধিক শীর্ষনেতার সঙ্গে রাস্তাতেই রাত কাটাবেন রাহুল গান্ধি।
৩৭৫০ কিলোমিটার। ৫ মাস। ১৫০ দিন। দক্ষিণ থেকে উত্তর। ১২ রাজ্য। ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র মোড়কে এক বিশাল কর্মসূচি শুরু করল কংগ্রেস। তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত এই যাত্রা শুরু হল ৭ সেপ্টেম্বর থেকে। পাঁচ মাসের কর্মসূচিতে কংগ্রেসের শতাধিক শীর্ষনেতার সঙ্গে রাস্তাতেই রাত কাটাবেন রাহুল গান্ধি। বুধবার সকালে শ্রীপেরুমবুদুরে রাজীব গান্ধি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই যাত্রা শুরুর স্থলের দিকে রওনা দেন রাহুল। রোজ ২২ থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে এই যাত্রা। সকাল ৭টা থেকে ১০টা এবং বেলা ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলবে পদযাত্রা। একটি নির্দিষ্ট কন্টেনারে থাকবেন রাহুল। অন্য কন্টেনারে কংগ্রেস কর্মকর্তারা। রাতে তাঁবুর মধ্যেই রাত কাটাবেন রাহুল। সেখানেই থাকছে এলাহি ব্যবস্থা। এই যাত্রা নিয়ে ইতিমধ্যেই কটাক্ষ ছুঁড়েছে বিজেপি। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, “১৯৪৭ সালে কংগ্রেস দেশভাগ করেছে। ভারত জুড়তে হলে পাকিস্তানে গিয়ে এই যাত্রা করুক ওরা।”
কংগ্রেসের এই কর্মসূচি নিয়ে শোরগোল রাজনৈতিক মহলে। নির্বাচনকে মাথায় রেখে কেন এই কর্মসূচি? দীর্ঘপথের এই কংগ্রেসি যাত্রার আসল উদ্দেশ্য কী? কী রাজনৈতিক তাৎপর্য লুকিয়ে এর অন্তরালে! রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছেন।
প্রথমত, একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আর এক দিকে বিহারের নীতীশ কুমার। পূর্ব ভারতের দুই রাজ্যের দুই নেতা এবং কংগ্রেসকে গৌণ রেখে মোদি বিরোধী ঐক্যে শান; আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে খুব একটা স্বস্তি দিচ্ছে না কংগ্রেসকে। বিজেপি বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বা শক্তি হিসেবে এক এবং অদ্বিতীয় কংগ্রেস- এই ভাবমূর্তি বা জল্পনা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। রাজনৈতিক শত্রু বিজেপি শুধু নয়, একাধিক আঞ্চলিক দল বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেসের মতো কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া গোষ্ঠীর কাছে দিনের পর দিন নাস্তানাবুদ হচ্ছে কংগ্রেস। আর এই পরিস্থিতিতেই রাজ্যে রাজ্যে মোদি অথবা গেরুয়া বিরোধিতার অস্ত্রের কেন্দ্রীকরণ কংগ্রেস ছেড়ে চলে গিয়েছে অন্যদের হাতে। জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস কতটা প্রাসঙ্গিক, এই প্রশ্নও উঠেছে।
দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গেই যোগ হয়েছে একের পর এক রাজ্যে কংগ্রেসের ক্ষমতা হারানোর প্রভাব। ঠেকতে ঠেকতে কংগ্রেস এসে দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে। গত লোকসভার মতোই উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ একাধিক রাজ্যে বিধানসভার অলিন্দেও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে সনিয়া-রাহুল--প্রিয়াঙ্কার কংগ্রেস। উত্তর পূর্ব ভারতেও অবস্থা শোচনীয় হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেই। বিতর্ক বেড়েছে।
আরও পড়ুন-হাওয়াই চটি বনাম পল্টুরাম || দেশে বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে বেশি এগিয়ে কে?
তৃতীয়ত, এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আগামী বছর গুজরাত, হিমাচলপ্রদেশ, ত্রিপুরা-সহ একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। প্রসঙ্গত, এই সব রাজ্যে কংগ্রেস এক সময় ক্ষমতায় ছিল অথবা এখনও শক্ত বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই পরিস্থিতির মধ্যে ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেস, গুজরাতে অরবিন্দ কেজিওয়ালের আম আদমি দলের প্রভাব বিস্তার, বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। যার দরুন ধাক্কা খাচ্ছে কংগ্রেস।
চতুর্থত, দলের অন্দরের শান্তিরক্ষা নিয়েও শান্তি নেই কংগ্রেসের। কে হাল ধরবেন দলের? এই প্রশ্নের মধ্যেই বিদেশ গিয়েছেন সনিয়া গান্ধি। বারবার কংগ্রেসের হাইকমান্ডের বিদেশযাত্রা এবং কংগ্রেস সভাপতি কে হবেন, এই প্রশ্নে উত্তাল হচ্ছে কংগ্রেস-অন্দর। ফের কংগ্রেস সভাপতি হয়ে দলের হাল ধরতে রাহুল গান্ধিকে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন কংগ্রেসের গান্ধি পরিবার ঘনিষ্ঠ নেতারা, এই জল্পনাও জোরালো হচ্ছে। অথবা গান্ধি পরিবারের কাছের কাউকে সভাপতি পদে বসানো হতে পারে! এখানেই কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন শশী থারুররা। শোনা যাচ্ছে, কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন শশী। দলের সাংগঠনিক নির্বাচনে ভোটার তালিকা প্রকাশের আবেদন করেছেন এই কংগ্রেস সাংসদ। এই পরিস্থিতিতে দলীয় অন্দরের কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে আবার।
পঞ্চমত, কংগ্রেসের তথাকথিত জি-২৩ গোষ্ঠীর নেতাদের দলত্যাগ অস্বস্তি বাড়িয়েছে কংগ্রেসে। সম্প্রতি, গুলাম নবি আজাদের কংগ্রেস-ত্যাগ এবং পদত্যাগপত্রে প্রকাশ্য ক্ষোভপ্রকাশ বিড়ম্বনায় ফেলেছে সনিয়াদের। আবার জম্মু ও কাশ্মীরে কংগ্রেসের ভাঙনেও চিন্তিত কংগ্রেস।
ষষ্ঠত, রাহুল গান্ধির মাঝে মাঝেই দেশে না থাকা, বারবার বিদেশ-ভ্রমণ, একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণে বিধ্বস্ত হওয়া, কংগ্রেসের যুব মুখের প্রকাশে কঠিনতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি প্রিয়ঙ্কা গান্ধিও। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন উত্তরপ্রদেশে। তাহলে কংগ্রেসের মুখ কে, এই প্রশ্নেও উত্তাল হয়েছে কংগ্রেস-অন্দর।
সপ্তমত, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ক্রমশ কংগ্রেসের চলমানতা ‘হাইজ্যাক’ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। একই পথে হেঁটেছে আপ বা দক্ষিণ ভারতের কেসিআর-রা। এখানেই একের পর এক নির্বাচনী কৌশলে কংগ্রেস ক্রমশ অবনমিত হয়েছে। কংগ্রেসি হাতমার্কা তিরঙার হাত দুর্বল করেছে বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক কোনও কোনও দল। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রায় আঞ্চলিক হয়ে যাওয়ার পথ বিস্তারের আবহে আরও দুর্বল হয়েছে কংগ্রেস।
আরও পড়ুন- রাজনাথকে উপহারে টাট্টু ঘোড়া! যুদ্ধবিমানের নামে নাম দিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীই
এই পরিস্থিতিতেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে মহাত্মা গান্ধি-জহরলাল নেহেরুর দলের। যেখানে ন্যাশনাল হেরাল্ড কাঁটার মাঝেও ক্রমশ মোদি বিরোধিতার পাশাপাশি, কংগ্রেস যে ভারতে রয়েছে, কংগ্রেস যে এখনও প্রাসঙ্গিক, দল যে বিলীন হয়ে যায়নি, এই বিষয়টি স্পষ্ট করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তাদের, বলছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। দাবি, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে যদি বিপুল হইচই সৃষ্টি না করা যায়, ক্রমশ যদি নিষ্ক্রিয়তাকে বন্ধু করা হয়, তাহলে আরও খারাপ দিন আসবে কংগ্রেসের। বিদেশ সফররত সনিয়া, রাহুলের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন তুলতে পারেন বঙ্গের অধীর চৌধুরীর মতো একনিষ্ঠ কংগ্রেস সৈনিকরাই। দলের অভ্যন্তরে সভাপতি কে হবেন, এই কোন্দলের মধ্যেই কেন দলের দুর্দিনে গান্ধি পরিবার শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই অভিযোগও উঠবে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার প্রয়োজন ছিল। বিজেপির ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ ডাকের সার্থকতা বাড়তে দেওয়া প্রশ্ন তুলছিল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভাবে বেঁচে থাকার সদিচ্ছা নিয়েও। সামগ্রিকভাবে এই অবস্থান থেকেই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র ডাক বলেই মনে করছেন কেউ কেউ। কংগ্রেসের দাবি, এই যাত্রার সঙ্গে আগামী লোকসভা বা কোনও নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। যদিও এই দাবির বিপক্ষেই জোরালো হচ্ছে মত। পদযাত্রায় রাহুল গান্ধির উপস্থিতি, গ্রামে গ্রামে রাত কাটানো, রাহুলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং দিনের পর দিন মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়ার রাহুল-কৌশল- রাজনৈতিকভাবে অন্য তাৎপর্য বহন করছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, মোদি বিরোধিতায় রাহুলকে মুখ করে একেবারেই ভাল ফল করতে পারেনি কংগ্রেস। দেশজুড়ে কংগ্রেসের মুখ রাহুল, এই তত্ত্বে সাড়া দেননি জনতার একটা বড় অংশ। উত্তরপ্রদেশের প্রেক্ষাপটে প্রিয়ঙ্কা গান্ধিও যে বিকল্প হবেন, তা নিয়েও নিশ্চিত নন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। এর মধ্যে দলের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের মুখে কংগ্রেস। সেখানে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের সংগঠনের হাল যেই-ই ধরুন না কেন, মোদি বিরোধিতায় আগামী নির্বাচনের মুখ যে রাহুল গান্ধিই- এই বিষয়টিই দেশজুড়ে তুলে ধরতে চাইছে কংগ্রেস। গুলাম নবির মতো নেতা-অস্বস্তি ঠেকিয়ে মোদিকে আটকাতে রাহুলই যে দেশের মূল অস্ত্র, এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীতীশ কুমারের মতো নেতাদের প্রধান মুখ করে রাজনৈতিক অপমানের শিকার হতে চাইছে না কংগ্রেস।
জাতীয় সত্তার আলোকেই আলোকিত হোক নির্বাচন, যেখানে রাহুলই নেতা। রাহুলই বিরোধী ঐক্যের মুখ -এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাইছে কংগ্রেস। শুধু এক একটি রাজ্য নয়, গোটা দেশের বিরোধী মুখ রাহুল এবং মমতা-নীতীশের দলের সমর্থনে মোদি বিরোধিতায় প্রধান ভূমিকা থাকবে কংগ্রেসেরই, এটিই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে বারবার। কিন্তু সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এবং মমতা-কৌশল, নীতীশ-চাহিদা, প্রশান্ত কিশোর-ভাবনা এবং দক্ষিণ ভারতীয় রাজনৈতিক চালের কাছে কংগ্রেসের এই পন্থা টিকবে, না কি বাকিদের ছোঁয়ায় রাহুলের কংগ্রেস ক্ষীণ হবে আরও, এই প্রশ্নও উঠছে। যদিও বিপরীত এক অংশের দাবি, কংগ্রেসের প্রভাব দেশের সব রাজ্যে। এই পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস বা রাহুল গান্ধিকে ছেড়ে মোদি বিরোধিতার জোট শক্তিশালী করা কঠিন। দেশের অন্যতম বিরোধী শক্তিকে সরিয়ে, চাপে ফেলে মোদি হঠানোর দিবাস্বপ্ন সার্থক হবে না! এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে, গুরুত্ব দিয়ে বিজেপির সঙ্গে লড়াই হলেই শক্তিশালী যুদ্ধ হওয়া সম্ভব। যদিও বিরোধীরা কী করবেন, এই ভাবনার মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সামনে এসেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন। কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সূচনায় তিরুবনন্তপুরমে উপস্থিত তিনি। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কেরলের ওয়ানারের সাংসদ রাহুলের জন্য দক্ষিণের মোদি বিরোধীদের সমর্থন আদায় হলে সুবিধা পাবে কংগ্রেস। যা নিয়ে, এই যাত্রায় একাধিক রাজ্যের প্রায় ৩০০ জন বিশিষ্ট-যোগের বিষয়টির আলোকে বার্তাও দিতে চাইছেন রাহুলরা। শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসকে টিকে থাকতে যে মমতা-নীতীশের মতো আঞ্চলিক দলের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হবে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আর এই অবস্থায় কংগ্রেসের জাতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা ‘মিশন ২০২৪’-র জন্য প্রয়োজনীয়। এই যাত্রা রাহুলের এবং কংগ্রেসের ভবিষ্যত রচনার অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে বলেও বলছেন রাজনৈতিক কারবারিদের একাংশ।