২০২২ সালেই সতর্ক করেছিলেন! রাহুল গান্ধির কথায় আমল দিলে এড়ানো যেত পাক হামলা?

Pakistan-China relationship: পাকিস্তান ও চিনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে ২০১৫ সালে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর চালু হওয়ার পর থেকে।

সাল ২০২২। কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ রাহুল গান্ধি সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির বিদেশনীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। রাহুল গান্ধি স্পষ্ট অভিযোগ করেছিলেন, নরেন্দ্র মোদিই "চিন ও পাকিস্তানকে একত্রিত" করছেন। কাট টু ২০২৫। পহেলগাঁওয়ে পাক সমর্থিত জঙ্গিদের বর্বর আক্রমণ, সাধারণ মানুষের প্রাণহানি এবং ভারতের পাল্টা জবাব। ওদিক থেকে পাকিস্তানের আঘাত, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিরতিকে কাঁচকলা দেখানো। ভারত এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও রাশিয়াকে পাশে পেলেও, চিন ভারতের পাশে নেই সর্বতোভাবে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যে অস্ত্রগুলি প্রয়োগ করছে, তা অধিকাংশই চিন নির্মিত। অর্থাৎ, ভারতের দুই প্রতিবেশীই ভারতের প্রতিপক্ষ। সত্যিই কি এই দুই পড়শির বন্ধুত্বের কারণ ভারতবর্ষ? নেপথ্যে কি মোদির বিদেশনীতি?

যখন রাহুল গান্ধি এই অভিযোগ করেছিলেন, ব্যাপক 'ট্রোলড' হয়েছিলেন। বিজেপি-সরকারের সমালোচনা করে রাহুল বলেছিলেন, ভারত চারদিকে প্রতিপক্ষ বেষ্টিত। "দেশটি বাইরে এবং ভেতরে দুই দিক থেকেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল চিন ও পাকিস্তানকে আলাদা রাখা। কিন্তু আপনি যা করেছেন তা হচ্ছে এদের একত্রিত করা। আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি তা এড়িয়ে যাবেন না। এটি ভারতের জন্য এক গুরুতর হুমকি," বলেছিলেন রাহুল গান্ধি। তখন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর রাহুলকে জবাব দিতে এমন এমন উদাহরণ টেনে আনেন যেখানে তিনি প্রমাণ করতে মরিয়া ছিলেন যে, বিজেপি ক্ষমতায় না থাকাকালীনও চিন ও পাকিস্তান একসঙ্গে কাজ করেছিল।

এনডিটিভির ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, পাকিস্তান ও চিনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে ২০১৫ সালে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর চালু হওয়ার পর থেকে। এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। এখন দুই দেশ অস্ত্র চুক্তি করে, যৌথ মহড়া এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি করে। মোদ্দা কথা দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। করাচিতে পাকিস্তানের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও চিনের সহায়তায় নির্মিত। দুই দেশের মধ্যে এক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে।

 

চিন জানিয়েছিল, তালিবানরা ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আরও গভীর করতে প্রস্তুত চিন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, আফগানিস্তান দখলের প্রশিক্ষণ তালিবানরা পেয়েছিল পাকিস্তানের থেকেই।

আরও পড়ুন- সন্ত্রাসের সুতো আইএসআই-এর হাতে! পাক জঙ্গিদের কীভাবে মদত জোগায় গুপ্তচর সংস্থা?

তবে জয়শঙ্কর বলেছিলেন, কংগ্রেস যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল তখন চিন ও পাকিস্তান একযোগে কাজ করেছে। একগুচ্ছ উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন তিনি, যেমন-

১৯৬৩ সালে, পাকিস্তান অবৈধভাবে শাক্সগাম উপত্যকা চিনের হাতে তুলে দেয়।

১৯৭০-এর দশকে চিন পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরি করে।

১৯৭০-এর দশক থেকে, দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতাও বেড়েছে।

২০১৩ সালে, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের কাজ শুরু হয়।

রাহুল গান্ধি কিন্তু বারেবারে সতর্ক করেছিলেন চিন ও পাকিস্তানের সখ্য নিয়ে। চিন এবং পাকিস্তান অস্ত্র কিনছে, ভারতের বিরুদ্ধে ছক কষছে, এই সমস্ত ইঙ্গিত দিয়ে রাহুল বলেছিলেন, "আমরা জম্মু ও কাশ্মীরে একটি বিশাল কৌশলগত ভুল করেছি," ৩৭০ ধারা বাতিল করে সেই রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা লুপ্ত করে আখেরে ভারত বিপদ ডেকে এনেছে বলেই মনে করেছিলেন রাহুল।

রাহুল গান্ধির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, "ভারতের সীমান্ত পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সীমান্ত পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে... আমাদের আগে দু'টি শত্রু ছিল - চিন এবং পাকিস্তান এবং আমাদের নীতি ছিল তাদের আলাদা রাখা। চিন এবং পাকিস্তান এক হয়ে গেছে এবং যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কেবল একজনের সঙ্গে নয়, দুই দেশের সঙ্গেই হবে। দেশ বিরাট ধাক্কা খাবে।"

পাকিস্তান এবং চিনের বহু নেতাই পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাখা দিতে গিয়ে বলেছেন— ‘পাহাড়ের চেয়েও উঁচু' এবং 'সমুদ্রের চেয়েও গভীর'। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান ও চিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দু'টি কমিউনিস্ট-বিরোধী সামরিক চুক্তি, সিয়াটো এবং সেন্টোতে পাকিস্তানের সদস্যপদ থাকার কারণে পাকিস্তানকে অ-সোভিয়েত ব্লকের অংশ হিসাবেই দেখা হতো। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে চিনের কিন্তু বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। হিন্দি-চিনি ভাই ভাইয়ের মতো স্লোগান আজও রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্বের ইঙ্গিত দেয়। দুই দেশেরই উপনিবেশ-বিরোধী, জোটনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।

বুদ্ধা'স ওয়ারিয়র্স বইতে লেখক ও ইতিহাসবিদ মাইকেল ডানহাম লিখেছেন, ১৯৫০ সালে চিনের সেনারা আক্রমণ করার পর, পাকিস্তান তিব্বতি বিদ্রোহীদের সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য মার্কিন বিমান ব্যবহারের সুবিধা প্রদান করে।

 

১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের ফলে বেইজিং ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে চিনের সমর্থন পায়। এর আগে ১৯৬৩ সালে একটি সীমান্ত চুক্তিতে, পাকিস্তান শাক্সগাম উপত্যকা চিনকে দিয়ে দেয়। শাক্সগাম উপত্যকা বা ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট হচ্ছে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের হুঞ্জা-গিলগিট অঞ্চলের অংশ এবং ভারত এর নিয়ন্ত্রণ দাবি করে কিন্তু পাকিস্তানই এই অঞ্চল দখলে রেখেছে। এক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭০-এর দশকে চিন ও পাকিস্তান যৌথভাবে কারাকোরাম মহাসড়ক নির্মাণের ভিত্তি স্থাপনা করে।

প্রকৃত কূটনৈতিক সৌহার্দ্য শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। পাকিস্তানের শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান রিচার্ড নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের মাও এবং ঝো এনলাইয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কিসিঞ্জারের গোপন সফর হয় এবং মার্কিন-চিন নিজেদের মধ্যে বিভেদের কারণ ভুলে সহযোগিতার প্রচেষ্টা শুরু করে।

১৯৭০ এবং ’৮০-এর দশকে চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতা বাড়ে। চিন পাকিস্তানকে তাদের পারমাণবিক শক্তি প্রযুক্তি উন্নয়নে সাহায্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে, দুই দেশ বেসামরিক পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর সহজতর করার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

১৯৯১ সালে, চিন পাকিস্তানকে তাদের তৈরি কিনশান-১ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ দিতে সম্মত হয়। ১৯৯৩ সালে চাশমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র-১ নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ২০০০ সালের মে মাসে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চুল্লিটি কার্যকর হয়। ২০১১ সালে চাশমা, সি-২-তে দ্বিতীয় ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধির সফরের মাধ্যমে ভারত ও চিনের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটে। ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে মনোনিবেশ করেছিল চিন, অন্যদিকে সীমান্ত বিরোধ নিয়েও ভারতের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলছিল। বিষয়টি পাকিস্তানের জন্য মোটেই সুখকর ছিল না।

তবে পাকিস্তান সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় ১৯৯৬ সালে। চিনের রাষ্ট্রপতি জিয়াং জেমিন পাকিস্তান সফরে গিয়েও কাশ্মীরের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তান আগে বলত, কাশ্মীর ইস্যু দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে নয়, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত। অথচ চিনের এই বার্তা সেই ধারণাকে আঘাত দেয়।

আরও পড়ুন- বিশ্বাসঘাতকতার সাত দশক! কেন বালুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?

১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময়ও চিন পাকিস্তানকে সৈন্য প্রত্যাহার করার পরামর্শ দেয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে বলে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাতের সমাধানের উপদেশ দেয়। ২০০২ সালে সংসদ হামলা, অপারেশন পরাক্রম এবং ২০০৮ সালে মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার পর চিন সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামা হামলার পর বালাকোটে বিমান হামলার সময়ও চিনের প্রতিক্রিয়া ছিল সতর্ক। তবে চিন, ২০১৯ সালের মার্চ মাসে জৈশ-ই-মহম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারকে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করার বিষয়টি আটকে দিয়েছিল।

২০২২সালেরই দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি আসতে দেখে চিন পাকিস্তানের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে। মার্কিন-ভারত পারমাণবিক চুক্তি পাকিস্তানকে চিন্তিত করে তুলেছিল। ২০১৩ সাল থেকে, শি জিনপিংয়ের চিন দেপসাং, চুমার, দোকলাম এবং পূর্ব লাদাখে সীমান্ত শক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। আর ২০১৯ সালের অগাস্টে ভারতের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লুপ্ত করার পদক্ষেপ চিন এবং পাকিস্তানকে আরও কাছে নিয়ে আসে।

কাশ্মীরের বিষয়ে চিনের অবস্থান অনেক আগের থেকেই স্পষ্ট। জে এন দীক্ষিতের 'ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস' বইতে উল্লিখিত ১৯৬৫ সালে ভারতের কাছে পাঠানো একটি চিনা কূটনৈতিক বার্তায় বলা হয়েছে, "যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত সরকার কাশ্মীরি জনগণের উপর অত্যাচার চালাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত চিন কাশ্মীরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে তাদের সমর্থন করা বন্ধ করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত সরকার পাকিস্তানের প্রতি লাগামহীন আগ্রাসন চালিয়ে যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত চিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ন্যায্য সংগ্রামে পাকিস্তানকে সমর্থন করা বন্ধ করবে না।"

২০১৯-এর ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে চিন বেশ কয়েকবার কাশ্মীরের পরিস্থিতি তুলে ধরার এবং তা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিককালে চিনের উপর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নির্ভরতাও বেড়েছে। পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ওয়াশিংটন আফগানিস্তানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, তাই চিনই এই মুহূর্তে পাকিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিকল্প। ২০২০ সালে, চিন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। আর সাম্প্রতিক অপারেশন সিঁদুর পরবর্তী পাক হামলায় দেখা গেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে চিনে তৈরি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক, ড্রোন বা মনুষ্যবিহীন যুদ্ধ বিমান ব্যাপকহারে ব্যবহার করছে। রাহুল গান্ধি সতর্ক করেছিলেন ২০০২ সালেই। বিরোধীর বাসি কথা এমন অসময়ে ফলে গেল কি কেন্দ্রের ভ্রান্তিতেই?

More Articles