উচ্ছেদ হওয়া রেল হকারদের ভরসা দেবেন না ট্রেনে চা ফেরি করা মোদিজি?

Indian Railway Hawker Eviction : প্রাইভেট কর্পোরেশনের মুনাফার দ্বারা নির্ধারিত হবে টিকিটের দাম! পাঁচ টাকায় গড়িয়া থেকে শিয়ালদহ বা উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া যাওয়ার দিন ফুরোবে।

বিশ্বগুরু মোদিজি প্রথম জীবনে নাকি স্টেশনে চা বিক্রি করতেন, অর্থাৎ রেলের হকার ছিলেন। বছর দশেক আগে মোদিজিকে নিয়ে বিজেপির এই প্রচার নিশ্চিতভাবে সাড়া ফেলেছিল রেল হকারদের মধ্যে। রেল হকার বলতে এখানে ‘রানিং হকার’ বলা হচ্ছে যারা লোকাল বা কোনও কোনও এক্সপ্রেস ট্রেনে শারীরিকভাবে যতটা বহন করা যায় ততটুকু পণ্য নিয়ে ওঠেন। এই হকাররা রাষ্ট্রের চোখে ‘অবৈধ’, পেশার অনিশ্চয়তা রানিং হকারদের নিত্যসঙ্গী । রেল স্টেশন বা চলন্ত রেলগাড়িতে হকারি বেআইনি। ‘বেআইনি’ পেশার অষ্টপ্রহর চাপ আর ১৬৫০ টাকার ফাইনের ভয় নিয়ে ক্রমাগত এক কামরা থেকে অন্য কামরা বদলে চলেছেন তাঁরা- শিয়ালদহ, হাওড়া সহ ভারতের সব প্রান্তের ট্রেন যাত্রায় আমাদের অতিপরিচিত হকাররা।

প্রধানমন্ত্রীর ট্রেনে চা ফেরি করার আখ্যানটি ভারতবর্ষের কয়েক লক্ষ রানিং হকারদের মনস্তাত্বিকভাবে স্পর্শ করেছিল বলা যায়, ভরসাও জুগিয়েছিল। শুধু রানিং হকার কেন, উক্ত গল্পটি অন্যান্য তথাকথিত ‘অবৈধ’ পেশায় যুক্ত ভারতের কোটি কোটি অসংগঠিত দুর্ভাগা শ্রমিক, আধা-শ্রমিক, মুটে মজুরদেরও আশ্বস্ত করার মতো বিষয় ছিল বটে, নিরন্তর যাদের সংগ্রাম চলেছে পুলিশ-পেয়াদা, ছোট বড় আমলাদের সঙ্গে। আন্দাজ করা যায়, নিপুণভাবে নির্মিত ওই চা বিক্রির আখ্যান নির্বাচনী খাতেও ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।

মোদিজির সেইসব ভোজবাজি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন হাওড়া রেললাইনের রানিং হকাররা। এতদিন কখনও আরপিএফকে তোলা দিয়ে, কখনও লুকিয়ে চুরিয়ে, কখনও বা অধিকারের প্রখর দাবিতে জোটবদ্ধ হয়ে জীবন জীবিকা টিকিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে রেল কর্তৃপক্ষ চরম আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। হকারদের উপর আরপিএফ লেলিয়ে দেওয়া, বেধড়ক লাঠি চালানো, মালপত্র ফেলে দেওয়া ও নষ্ট করা, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণার মাধ্যমে হকারদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের খেপিয়ে দেওয়া, ফ্লেক্স লাগিয়ে হকারদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার সবই করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন- দামী টিকিট, রক্তঘাম করা টাকায় দেওয়া আয়কর; ভারতীয় রেলে কোথায় যাত্রীসুরক্ষা?

রেলের এই অতি সক্রিয় হকার নিধন অভিযান এমনি এমনি নয়। রেলের বেসরকারিকরণ মোদিজির আমলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে হকার উচ্ছেদ, ভবঘুরে হঠানো, রেলস্টেশনগুলিকে কর্পোরেট বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া। মোদিজির নির্দেশে ২০১৫ সালে নীতি আয়োগ সদস্য বিবেক দেবরায়ের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভারতীয় রেল ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করেছিল যার মূলমন্ত্র ছিল রেল ব্যবস্থায় বেসরকারি প্রবেশের পথ খুলে দেওয়া। রিপোর্টে বলা হচ্ছে,

It needs to be understood that this Committee does not recommend privatization of IR. It does, however endorse private entry, which is not ab initio (i.e., from the start) but ab hinc (i.e., henceforth) – as this is already part of the accepted IR policy – with the provison of an independent regulator. This Committee prefers use of the word liberalization and not privatization or deregulation, as both the latter are apt to misinterpretation.

বিবেক দেবরায়ের কমিটি সরাসরি প্রাইভেটাইজেশনের অর্থাৎ পাবলিক সেক্টর রেলের শেয়ার প্রাইভেট কোম্পানির বিক্রি করার কথা বলছেন না, ঘুরিয়ে নাক দেখানোর নিদান দিচ্ছে। রেলের পরিকাঠামো নির্মাণ, ওয়াগন উৎপাদন, লোকোমেটিভ রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া- রেলের জমি ও অন্যান্য স্থাবর সম্পদের উন্নয়নকল্পে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ সূচনা করার, রেলের অপারেশন ও মেনটেনেন্সের প্রক্রিয়াকে চুক্তিভিত্তিক ভাবে প্রাইভেট কোম্পানিকে অর্পণ করা; রেলের স্থায়ী সম্পদ, এমনকী মানব সম্পদকেও ঠিকা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা; প্রাইভেট ফার্মকে টিকিট বিক্রি, টিকিট চেকিং ও নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদি ছিল বিবেক দেবরায় কমিটির পরামর্শ। ওই কমিটি সরাসরি বাজার অর্থনীতি (নব্য উদারতাবাদী অর্থনীতি) এর স্বপক্ষে ভারতীয় রেল পরিচালনার কথা বলছে -

A market economy in a free, democratic society is based on the principles of choice, competition and autonomy. Choice enhances the lives of ordinary people by giving them freedom to choose between competing sellers. Competition between providers of services like the Railways, lowers costs and prices, improves customer service, spurs innovation and optimizes the resources of society. Autonomy leads to accountability and efficiency and improves the lives of employees…
In pursuit of these fundamental principles, country after country has broken the monopoly of its state-owned railways. The results of these efforts have been spectacular…

নয়া-উদারনৈতিক দর্শনের মার্কামারা ‘প্রতিযোগিতা, বাছাইয়ের স্বাধীনতা ও স্থায়ত্বশাসন’-এর গল্প পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। গত কয়েক দশক ধরে এই একই বয়ান শুনিয়ে, জনগণের সম্পদ দখল করে আকাশছোঁয়া মুনাফা বানিয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। ভারতীয় রেল ব্যবস্থা দৈনিক দুই কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছয়, ভারতের তিরিশ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় রেলের মাধ্যমে, চৌষট্টি হাজার কিলোমিটারের রেলপথ এই ব্যবস্থায় বিদ্যমান। এই নয়া-উদারনৈতিক যুগে এই সোনার হাঁসটিকে কর্পোরেটরা ছাড়বে কেন?

বিবেক দেবরায় কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হবার কিছুদিনের মধ্যেই পৃথক রেল বাজেট পেশ করার দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়, ইউনিয়ন বাজেটের সঙ্গেই রেল বাজেট মিলিয়ে দেয় মোদিজির মন্ত্রিসভা। ২০১৭ সালে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু প্রাইভেট অপারেটরের সহযোগিতায় চারশোটি রেল স্টেশনের পুনর্নিমাণ ঘোষণা করেন, বিমানবন্দরগুলির মডেলে– ঘোষিত হয় স্টেশনগুলিকে ওই প্রাইভেট অপারেটরদের পঁয়তাল্লিশ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হবে। ২০১৯-এ নীতি আয়োগের চেয়ারম্যান অমিতাভ কান্ট পঞ্চাশটি স্টেশন বেছে উপরোক্ত প্রকল্পের দ্রুত রূপায়ণের জন্য রেল বোর্ডকে অনুরোধ করেন। ২০২০-এর জুলাই মাসে রেল মন্ত্রক ১০৯ টি রুটে প্রাইভেট অপারেটর নিয়ন্ত্রিত প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালাবার প্রক্রিয়া শুরু করে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০২১ সালে রেল মন্ত্রক এই প্রাইভেট অপারেটর নিয়ন্ত্রিত প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালানোর টেন্ডার বাতিল করতে বাধ্য হয়, মাত্র দুইটি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছিল। ২০২১ সালেই মোদিজির সরকার ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন (NMP) উদ্যোগ শুরু করেছিল, যার মোদ্দা কথা হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি, জনগণের সম্পত্তি বেচেবুচে টাকা জোগাড় করা (মানিটাইজ করা)। ২০২২ থেকে ২০২৬ অবধি জাতীয় সম্পদ বেচে ছয় লক্ষ কোটি টাকা কোষাগারে ভরার লক্ষ্য নিয়েছেন মোদিজি, যার মধ্যে রেল বেচে ওঠার কথা পঁচিশ শতাংশ। দুঃখের বিষয়, ২০২২-২০২৩ অর্থবর্ষে রেল মাত্র ১০ শতাংশও লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। ২০২৩-এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাতান্ন হাজার কোটি টাকা তোলার, উঠেছে মাত্র চার হাজার নয়শো নিরানব্বই কোটি টাকা। এই মানিটাইজেশনের সিংগভাগ আসার কথা রেল স্টেশনের পুনর্নিমাণ প্রকল্প থেকে। কীরকম পুনর্নিমাণ হবে তার একটা রূপরেখা দিয়েছিল রেল ল্যান্ড ডেভলপমেন্ট বোর্ড ও ইন্ডিয়ান রেলওয়ে স্টেশন ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন। নয়াদিল্লি রেল স্টেশনের জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল যেখানে নতুন স্টেশনে কমার্শিয়াল, রিটেল ও হসপিটালিটি হাব থাকবে। আমাদের নবনির্মিত শিয়ালদহ স্টেশন দেখলে খানিক মালুম হয় কী হতে চলেছে ভবিষ্যতের স্টেশনগুলির চেহারা। স্টেশনগুলিকে চলমান শপিং মলের রূপ দিতে চাইছেন মোদিজি। শপিং মলে কি হকার থাকতে পারে?

লকডাউনের সময় একাধিকবার শোনা গেছিল যে, বেশ কিছু রুট অলাভজনক বলে তুলে দেবার কথা ভাবছে রেলমন্ত্রক, তার মধ্যে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখাও ছিল। অলাভজনক বলে রুট তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা, প্রাইভেট অপারেটর দিয়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালানো, রেলস্টেশনগুলিকে প্রাইভেট কোম্পানিদের ইজারায় দিয়ে দেওয়া ইত্যাদির একসঙ্গে পরিকল্পনা চলছে মানে, রেল মন্ত্রক একটা মডেল প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে যেখানে রেল ব্যবস্থা আর গণপরিবহন থাকবে না, একটি নয়া-উদারতাবাদী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে যেখানে প্রাইভেট কর্পোরেশনের মুনাফার দ্বারা নির্ধারিত হবে টিকিটের দাম! পাঁচ টাকায় গড়িয়া থেকে শিয়ালদহ বা উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া যাওয়ার দিন ফুরোবে। গরিব মধ্যবিত্তের অল্প পয়সায় চলাচলের উপায়টুকু বন্ধ করতে চাইছেন মোদিজি, প্রাইভেট কর্পোরেশনের স্বার্থে।

আরও পড়ুন- স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও বহাল ব্রিটিশ মালিকানা! দেশের একমাত্র ‘পরাধীন’ রেলপথ এটিই

হকাররা প্রাথমিক আক্রমণের লক্ষ্য হলেও লাইনেই রয়েছেন সাধারণ নিত্যযাত্রীরা। রেল কর্তৃপক্ষ একটি প্রচারপত্রে স্লোগান ছেড়েছে, ‘প্ল্যাটফর্মস আর ফর প্যাসেঞ্জারস, নট ফর হকারস’! অত্যন্ত চতুরির সঙ্গে বিভাজন করার প্রচেষ্টা। হকারদের রুজি-রুটির সমর্থনে যাত্রীদের মধ্যে প্রচার চালানো উচিত, কারণ পরবর্তী লক্ষ্য যাত্রীরাই।

ভারতীয় রেলস্টেশনগুলি ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার অসামান্য পরিচায়ক। কোটি কোটি মানুষ ছুটছে স্টেশনে, ক'জনই বা বন্দে ভারত আর শতাব্দীতে উঠতে পারেন? পরিযায়ী শ্রমিক, গ্রাম থেকে ফসল নিয়ে আসা চাষাভুষো, লালগোলা বনগাঁ লোকালে চাল তোলা ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি, ছানার ব্যবসায়ী, মুটে-মজুর, হরিপদ কেরানি, ডেইলি প্যাসেঞ্জার, ছাত্রছাত্রী, প্রিয়জনের চিকিৎসার জন্য অন্যরাজ্যে পাড়ি দেওয়া আত্মীয়, ভিখারি, তীর্থযাত্রী, ভ্রমণপিপাসু সাধারণজন, পাগল, ভবঘুরে, নেশাখোর, চিটিংবাজ, পকেটমার, কেপমার, প্লাস্টিকের বোতল কুড়ানি এবং এই সবাইকে পরিষেবা দেওয়া হকার – সব মিলিয়ে ভারতীয় রেল ও স্টেশন। এই ধোঁয়াটে অস্পষ্ট ঘামের গন্ধ ভেজা ভিড়কে একধাক্কায় সরিয়ে স্টেশনে ঝাঁ-চকচকে কমার্শিয়াল, রিটেল ও হসপিটালিটি হাব বসিয়ে দেওয়া সম্ভব না। প্রাইভেট অপারেটর দিয়ে চারশোটি রেল স্টেশনের পুনর্নিমাণ তাই এখনও পুরো দমে শুরু করতে পারেনি মোদিজিরা, ঠোক্কর খাচ্ছে। বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটাইজেশনের প্রাথমিক বাধা হকাররা, যারা রেলপথ অর্থনীতির অসংরক্ষিত অংশটির দাবিদার এবং আইনিভাবে ক্ষমতাহীন।

বছর আটেক আগে এই রানিং হকারদের ইন্টারভিউ নিতে ঘুরেছিলাম শিয়ালদহ দক্ষিণ লাইনের বহু স্টেশনে। বারুইপুর জংশনের হকারদের চায়ের আড্ডায় দোকানদার বোঝাচ্ছিলেন, সমাজে নারী পুরুষ যেমন আছে, তাদের মাঝে আছে হিজড়ে, তেমনই চাকরিজীবী আর শ্রমিক আছে, তাদের মাঝে আছে এই হকাররা। উপস্থিত হকারদের সমস্বর সমর্থন বয়ানটির রাজনৈতিক গলদ সত্ত্বেও ওঁদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। একজন প্রবীণ হকার বলছিলেন, স্বেচ্ছায় কেউ হকার হয় না। হকাররাও চান না তাঁদের সন্তান হকারি পেশায় নামুক। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, বাঁচার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ কিছু একটা নিয়ে ট্রেনে ওঠেন বিক্রি করার জন্য। আট থেকে আশি – বয়স কোনও বাধা নয় হকার পেশায় আসার জন্য।

হকাররা কী কী মাল নিয়ে ট্রেনে ওঠেন তার তালিকা বিরাট- ঝালমুড়ি, বাদাম, ডালমুট, ঘুগনি, হজমিগুলি, আচার, মরসুমি ফল, জল, গ্রীষ্মকালে পেপসি (রঙিন বরফের আইসক্রিম), কম দামি চকলেট, পেটের রোগ-ব্যাথার মলম, পেন, বই, মোবাইলের কভার, নিত্যপ্রয়োজনীয় হরেকরকম টুকিটাকি, মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রী, গামছা, শাড়ি- হেন জিনিস নেই যা রেলের কামরায় চোখে পড়ে না। লাইন অনুযায়ী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। শিয়ালদহ দক্ষিণ লাইনে ফটাস জল নামের লোকাল সুগন্ধি সোডা কোকাকোলা বা পেপসির পুরনো বোতলে বিক্রি হয়। ছিপি খোলার সময় ফটাস করে শব্দ না হলে ক্রেতারা সন্তুষ্ট হন না। ফটাস জল এই লাইন ছাড়া কোথাও বিক্রি হয় না। শিয়ালদহ মেন লাইনে গ্রীষ্মকালে আমপোড়ার টাটকা শরবৎ হাঁড়িতে করে নিয়ে ওঠেন হকাররা। কতরকমের যে বই, রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে খনার বচন, গাছগাছড়ায় রোগমুক্তি থেকে তিনমাসে ইংরেজি শিক্ষার মেড-ইজি, বাচিক শিল্পী হকারদের প্রপার নাউন, সিলেবেল, অক্সিলারি ভার্ব থেকে কোন গাছগাছড়ায় কোন রোগ জব্দ সব কণ্ঠস্থ। রেলের ঝমাঝম শব্দ আর লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের ক্যাকোফনির আবহে অবিচলভাবে পণ্যের গুনাগুণ বর্ণনা করে চলেছেন তারা। তুচ্ছ কিছু দৈনন্দিন বস্তু নিয়েও হকারদের স্ক্রিপ্ট থাকে। যেমন ধরুন পেন, সেটাকে বিক্রি করার জন্য পিয়ালি নিবাসী মহারাজ মণ্ডল যাত্রীদের বোঝান, ‘পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দামি অস্ত্র কলম অস্ত্র, আমাদের রাষ্ট্রপতিও ব্যবহার করেন, মুখ্যমন্ত্রীও ব্যবহার করেন কলম- দশ টাকা’। অন্য এক হকার, সুজল নস্কর একই পণ্য বিক্রি করছেন পেনটির উৎপাদক কোম্পানি গর্ভর্মেন্ট রেজিস্টার্ড বলে- ‘বাপ তৈরি করছে, ছেলে বিক্রি করছে’ এই স্থানিক তুচ্ছ উৎপাদন পদ্ধতি তখন তাঁর জোরের বিষয় নয়। এই হকারই যখন গাছ গাছড়ায় রোগমুক্তির বই বিক্রি করবেন, তখন ধনতান্ত্রিক বিজ্ঞাপনের মায়াজালের বিরুদ্ধে গ্রামবাংলার লোকায়ত চিকিৎসা পদ্ধতির পক্ষে দুর্দান্ত পালটা আখ্যান হাজির করবেন। ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে মুক্তি’ এই বলে কুইজের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করান তাঁরা। গ্যাস অম্বল বুকজ্বলাকে ভারতবর্ষের জাতীয় রোগ বলে প্রচার শুরু করলেন এক হকার। সাধারণ মানুষের মৌলিক সমস্যা ধরে সহজ ভাষায় কার্যকর গল্প করতে এঁরা ওস্তাদ। বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলি মার্কেট সার্ভে করে প্রচার অভিমুখ তৈরি করে, হকাররা জীবন থেকে তাদের রসদ সংগ্রহ করেন- শহরতলি, গ্রামাঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ কর্মসন্ধানী মানুষের সঙ্গে ওঠাবসার সুবাদে এবং তাদেরই গোষ্ঠীভুক্ত হবার কারণে সমস্যার রোজনামচা হকারদের কণ্ঠস্থ।

রেলের হকার তারাই হন যাঁদের পুঁজি সবচেয়ে কম, পাঁচশ টাকা জোগাড় করেও এই ব্যবসা শুরু করা যায়। রেলস্টেশন বা রাস্তার স্থায়ী হকাররা মহাজনের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকার মাল তুলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ব্যবসা করেন। রানিং হকারদের কাঁধের ব্যাগ ঢাউস হলেও হাজার-দু'হাজার টাকার বেশি মাল থাকে না। কিছু ক্ষেত্রে তারা স্টেশনের স্থায়ী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন বিক্রির পণ্য নেন। বেশিরভাগ হকার শিয়ালদহ আর বড়বাজার থেকে সাপ্তাহিক মাল কেনেন, মহাদেবদাকে দেখেছি তিন হাজার টাকার পেন কিনতে। সপ্তাহে তিন হাজার টাকার পেন বিক্রি করে যদি দুই হাজার টাকার লাভও হয়, তবে গোটা মাসে আট নয় হাজারের বেশি উপার্জন সম্ভব নয়। মহাদেবদা অত্যন্ত পরিশ্রমী, দুই পড়ুয়া সন্তানের অভিভাবক, সকালে ট্রেনের বিক্রির পর বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া করে ফের বেরোন, পিয়ালি বাজারে একটি চশমার দোকান চালান টিমটিম করে, হকারিতে সংসার চলে না বলে। অন্য এক তরুণ হকার বলেছিলেন, তিনি সন্তানকে বারুইপুরে ইংলিশ মিডিয়াম নার্সারি স্কুলে ভর্তি করে নাজেহাল, স্কুলের মাসিক খরচ দেড় দুই হাজার। ইংরেজি শিক্ষার সামাজিক আবেদনে এই হকার ভাইটি প্রভাবিত, সন্তানকে সরকারি স্কুল বাদ দিয়ে একটি ভুঁইফোড় ইংরেজির সাইনবোর্ড টাঙানো ব্যবসায়িক স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। গ্রামে শহরতলিতে সরকারি প্রাইমারি স্কুলকে 'খিচুড়ি স্কুল' বলে মানুষ। নিম্ন অর্থনৈতিক বিন্যাসের মানুষ দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি অতিরিক্ত বিশ্বাস রাখেন। খিচুড়ি স্কুলের বস্তুগত উদ্দেশ্যবিধেয় অস্পষ্ট হয়ে গেছে সরকারি অবহেলায়, জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের পরিষেবা দেওয়ার বাধ্যতার ধারণাও জনমানসে ক্ষয় পেয়েছে বহুগুণে।

বেশিরভাগ হকারদেরই কোনও ব্যঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। ব্যাঙ্কের চেয়ে বেআইনি লগ্নি সংস্থা অনেক বেশি ধরাছোঁয়ার মধ্যে, হকারদের মধ্যেই অনেকে সারদার এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে একজন এখনও উপার্জিত অর্থের একটা অংশ শোধ করে যাচ্ছেন। এমন একটি সিস্টেমে তারা বসবাস করেন যেখানে বিবিধ নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র কুড়িয়ে জোগাড় করে আবার সেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রমাগত কুস্তি লড়তে হয় কাজের স্বীকৃতির জন্য।

২০১৪-১৫ সাল নাগাদ মাঝেরহাট স্টেশনে অভিযান চালিয়ে হকারশূন্য করা হয়েছিল। ক্রমাগত রেল কর্তৃপক্ষের চোখ রাঙানির থেকে বাঁচতে হকাররা বিভিন্ন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ইউনিয়নের কার্ড করান। এক প্রবীণ হকার নির্লিপ্ত ভাবে বলেছিলেন, কংগ্রেসের সময় কংগ্রেসি ইউনিয়ন করেছেন, সিপিএমের সময় সিটু, এখন তৃণমূল আমলে আইএনটিটিইউসি করছেন- ‘জল যেদিকে গড়াবে ছাতা সেইদিকে ধরতে হয়’। এই আদর্শহীন নমনীয়তাকে খুব কঠোর অবস্থানে দেখলে মুশকিল, এটা ওঁদের বাধ্যতা। ৭০ বা ৮০-র দশকের নিম্ন-অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষমতাহীন শ্রমজীবী মানুষের জোট নিজেদেরকে ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দরকষাকষি করার কিছু সুবিধা পেয়ে থাকতে পারেন, বর্তমানে সে সুযোগ আর কতটুকু রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক টম ও জেরির মতো, কখনও সখনও মধুর উপাখ্যান, বিশেষত নির্বাচনের আগে বা উগ্র জাতীয়তাবাদের মুহূর্তে; নইলে বেশির ভাগ সময়ই তো তাড়া খেয়ে চলেছেন রেলের হকাররা।

More Articles