মোদির রামরাজ্যে ঠিক কেমন আছেন সাধারণ মানুষ?
Ramrajya of Modi: দীর্ঘদিন ধরে ধুলোপড়া ইস্তেহারের গায়ে লিখে রাখা শব্দগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। যে ইস্তেহারে, গেরুয়া রঙে, লেখা আছে এক নতুন দেশের নাম─'রামরাজ্য'।
রেডক্লিফ লাইন সেলিম এবং সুমনকে ভাগ করে দেওয়ার পর, রুপাই এবং সাজুর ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর, আজ বহু বছর কেটে গিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার ছেঁড়া ক্যানভাসে ঝুলছে গোপাল পাঁঠার ছবি। 'অমর-আকবর-এন্টনি'তে দুপুর মাতাত যে বাঙালি, 'শুধুমাত্র রবিবার' খাসির মাংস কিনতে গিয়ে হিন্দিতে কথা বলত, তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে হিন্দি নাকি দেশের রাষ্ট্রভাষা!
দীর্ঘদিন ধরে ধুলোপড়া ইস্তেহারের গায়ে লিখে রাখা শব্দগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। যে ইস্তেহারে, গেরুয়া রঙে, লেখা আছে এক নতুন দেশের নাম─'রামরাজ্য'।
আমাদের মফস্সলে 'রাম' নামের একটা ছেলে ভালো লেগ স্পিন করত বলে বেশ কদর ছিল তার। আর 'লালা' নামের একটা ছেলেও মাঝেমধ্যে আসত মাঠে। তাকে আমরা মজা করে 'ল্যালা' বলতাম। কিন্তু এই 'রাম' এবং 'লালা' একসঙ্গে মিশে গিয়ে যে টিভি চ্যানেলের প্রাইমটাইম হতে পারে, তা সে'যুগে আমরা যদি জানতুম!
যাই হোক, দেখে এলাম সেই রামরাজ্য। লখনৌ থেকে ঝাঁ চকচকে রাস্তা দিয়ে বাস ছুটছে। দামি স্পিকারে বাজছে রাম-সংকীর্তন। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা আর কুয়াশামাখা রামপথে যখন গিয়ে থামলাম, তখন আমাদের সামনে একটি মেইনস্ট্রিম টিভি চ্যানেলের বাস দাঁড়িয়ে। যাতে লেখা, 'রাম ফির লৌট আয়ে'।
কেমন সেই রাজ্য? খায় না মাথায় দেয়?
হ্যাঁ, খায়। তবে পুরোদস্তুর নিরামিষ। আমিষ খাওয়ার বা বিক্রি করবার অনুমতি দেয়নি যোগী প্রশাসন। আর মাথায়? মাথায় শুধুই মোদি, যোগী আদিত্যনাথ। থুড়ি, রাম! যে'দিকে তাকাবেন, হোডিং-ব্যানার থেকে আপনার দিকে নজর রাখছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। গোটা রামরাজ্যে রামের কোনও ছবি আমার অন্তত চোখে পড়েনি। বিহার থেকে রামরাজ্য দেখতে আসা এক সাইকেল আরোহীর সাইকেলের সামনে অবশ্য দেখেছিলাম রাম–সীতার একখানি ছবি, তবে সেই ছবি দূরদর্শনের বিখ্যাত অভিনেতা অরুণ গোভিল-দীপিকা চিখিলার। আশ্চর্যজনক ভাবে অমিত শাহ থেকে লালকৃষ্ণ আডবানি, সকলের ছবিই মিসিং গোটা রামরাজ্যে।
আরও পড়ুন: মোদির রামরাজ্য এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষের কথাই বলে
লতা মঙ্গেশকর চক থেকে হজরতগঞ্জ (যার মধ্যিখানে পড়বে বাবরি মসজিদ! থুড়ি! রাম জন্মভূমি)─এই ১৩ কিলোমিটার বিস্তৃত রাস্তার দু'ধারে গেরুয়া রং করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মুসলমানের বাড়ি, হিন্দুবাড়ি─সবকিছুর রঙ গেরুয়া। দোকানের শাটারে এই ১৩ কিলোমিটার জুড়েই করা হয়েছে খয়েরী রং। তাতে আঁকা হয়েছে হনুমানের গদা, রামের তির-ধনুকের ছবি। লাইটপোস্ট থেকে চন্দননগরের স্টাইলে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে হনুমানের গা থেকে। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্বয়ং হনুমান, মুহুর্মুহু তিনি দিয়ে ফেলছেন প্রেস বাইট। খয়েরী-সবুজ-নীলচে-হলুদ-কমলা-কালো সমস্ত টিভি চ্যানেলেই রাম ফিরছেন, সে'টাই খবর। দামি ক্যামেরা, ভ্যানিটি ভ্যান তৈরি হচ্ছে সেই রাম ফিরে আসার খবর করতে। কিন্তু তিনি কোথা থেকে ফিরছেন, সে'টাই অজানা। জানতে বয়ে গেছে। তিনি ফিরে আসছেন সে'টাই অনেক!
তার জন্যই এত হাঁকডাক। তৈরি হয়েছে ফোর লেন রাস্তা। ১৮০০০ কোটি টাকা দিয়ে রামরাজ্য তৈরি করতে ভেঙে ফেলা হয়েছে একের পর এক মন্দির এবং মসজিদ। শুধুমাত্র একটি মন্দির তৈরি করতে কত মন্দিরকেও ওরা হত্যা করেছে তার খবর কেউ নেয়নি।
কিন্তু এই রাজ্য তৈরির আসল যারা কারিগর, সেই শ্রমিকদের খবর কী?
তারা বারো ঘণ্টা কাজ করে পাচ্ছেন মাত্র চারশ টাকা। তারপর আবার সেই কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই ২২ তারিখের পর। সকাল থেকে বিকেল শুধুমাত্র রামপথ ঝাঁট দেয়ার জন্য গুজরাট থেকে বিনয়, গোরখপুর থেকে স্বাতীরা এসেছেন চারশ টাকার টানে। মন্দিরগামী রাস্তা ধরে হাঁটলেই আপনার চোখে পড়বে হাজারো বুভুক্ষ মানুষ। বারো-পনেরো বছরের ছেলেমেয়েরা রাস্তার ধারে বসে ধূপ, ধুনো, হনুমানের পতাকা বিক্রি করছে। লাইন পড়ছে বিনে পয়সায় খিচুড়ি খাওয়ার। ইতিউতি খোঁজ নিলে জানবেন এই বিরাট রামরাজ্য তৈরি করতে যে'সব মানুষকে বেঘর করে দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই এখনও ঘর জোটেনি। যাদের চলে গিয়েছে চাষের জমি, যে জমিতে শোভা পাচ্ছে রাম-মোদি-যোগীর ছবি, তারা আজকাল চাষবাস ছেড়ে রামপথে গাছ পোঁতার কাজ করছেন।
কথা হচ্ছিল একবাল আনসারির সাথে। কে এই একবাল? ইনি হলেন প্রয়াত হাসিম আনসারির ছেলে। যিনি দীর্ঘদিন ধরে বাবরি মসজিদের হয়ে মামলা চালিয়ে গেছেন এতগুলো বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর, একবাল আনসারী নিজেও মামলা চালিয়েছেন শেষের দিকে। আজ যখন প্রশ্ন করলাম, কেমন লাগছে? সামনের ২২ তারিখ তো রাম মন্দির উদ্বোধন। হেসে জানালেন, তিনিও যাবেন সেই মন্দির উদ্বোধনে। তাঁকে ট্রাস্টের তরফে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। কোনও ক্ষোভ নেই সরকার এবং প্রশাসনকে নিয়ে। দারুণ কাজ হচ্ছে অযোধ্যায়। সর্বত্র বড় বড় রাস্তাঘাট। হাসপাতালের প্রসঙ্গ টানতেই খানিক মুখ ফসকে বলে ফেললেন 'শ্রীরাম হাসপাতালে' কোনও সার্জন নেই। রোগীকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লখনৌ নিয়ে যেতে হয়।
"মেয়েদের পড়াশুনো?”
"এ'খানে মেয়েরা খুব বেশি পড়ে না।"
সোজা উত্তর।
"মাছ-মাংস খান? নাকি আপনাদেরও নিরামিষ?”
"না না। খাই। ৪-৫ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ে আসতে হয়।"
ক্যামেরা বন্ধ হলে একটু সাহস পান, কিন্তু তবু কিছু বলেন না।
আরও পড়ুন : রামরাজ্যই সুখরাজ্য? বঙ্কিম থেকে আম্বেদকর, কী বলছেন ওঁরা?
রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম রাম জন্মভুমি থেকে প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার দূরে। মেনু চাইতেই নিরামিষ খাবারের ফর্দ। তারপর ডেকে বলতে, সম্পূর্ণ অন্য একটি মেনুকার্ড দেওয়া হল আমাদের। চারপাশে চেয়ে দেখলাম, আমরা বাদ দিয়ে প্রায় সকলেই ছানা, পনির, আলুরদমেই মধ্যাহ্নভোজ সারছেন। মাছ-মাংস খাওয়াটা একপ্রকার অপরাধ যেন রামরাজ্যে!
আরও কী দেখলাম?
দেখলাম হাইকোর্ট নির্বাচিত রাম মন্দিরের পুরোহিত 'মাহান্ত লাল দাসে'র খুন হয়ে যাওয়ার গল্প। যাতে প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। শুধুমাত্র সত্যি কথা ক্যামেরার সামনে বলার অপরাধে সে'দিন খুন হতে হয় "কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য" লাল দাসকে। কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে লাল দাসের পুত্রের। কোনও দিন ছায়া মাড়াতে চান না নবনির্মিত মন্দিরের, যে মন্দির আসলে গড়বার ইতিহাস রচনা করে না। বরং ঢেকে দেয় একটা বহমান ইতিহাসকে। যে ইতিহাস ভাঙবার। সে'টা মসজিদ কিংবা সেলিম-সুমনার। গণতন্ত্রের মাঝে এক অবাধ হীরক রাজার নাচন শুরু হয়েছে। বিরোধী-শূন্য একটা দেশ। রামের দেশ। যে দেশ তৈরি হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের গ্রাফিক্স আর প্রাইমটাইমে আর মন্দিরের উঁচু মিনারে। যে'খানে আর রোটি-কাপড়া-মাকানের খোঁজ করে না কেউ।
কে রাম?
রাম আসলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রামরাজ্যে তিনি যা চাইবেন সে'টাই হবে। সাফ কথা।