ভূস্বর্গ হয়ে উঠছে নরক! পরিবেশ ধ্বংস যে সর্বনাশ করছে কাশ্মীরের
উৎসাহ এবং ভালো কাজ করার তাগিদের চূড়ান্ত অভাব এই জলাভূমিগুলিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আচ্ছা ভূস্বর্গ কথার অর্থ কি? শব্দটা পড়েই নিশ্চয়ই আপনার মন চলে গেল কাশ্মীরে। কিন্তু একটা স্থানকে কেন বলা হয় ভূস্বর্গ? তার অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য? শুধু প্রকৃতির রূপের জন্য? না কি তার সঙ্গে যোগ হয় দুর্ধর্ষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য? শক্তিশালী বাস্তুতন্ত্র? এই দুয়ের মেলবন্ধন ছাড়া তো ভূস্বর্গ তৈরি হওয়া সম্ভবও নয়, তাই না? কিন্তু যদি পৃথিবীর স্বর্গের পরিবেশ ধ্বংস হয়? তখন?
২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার হোকেরসর নামের একটি জলাভূমি থেকে জল ছাঁচার কাজ শুরু করে। যাতে শ্রীনগরের বন্যার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের এই কাজ শুরু হয়।
কিন্তু পরিণাম একটু অন্যরকম হয়। হোকেরসর একটি রামসার সাইট। বিশেষ আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন এই জলাভূমি পরিণত হয় তৃণভূমিতে। ২০২২ সালে গ্রীষ্মে যখন আবার বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন এই তৃণভূমি অতিরিক্ত জল স্বাভাবিকভাবেই ধরে রাখতে অক্ষম হয়। সেই সঙ্গে ওই জায়গায় সরকার সঠিক সময়ের মধ্যে স্লুইস গেটও বসায়নি। বন্যাও আটকানো সম্ভব হয়নি, সেই সঙ্গে একটি জলাভূমির চরিত্র যাতে বদলে না যায়, তার জন্য যতটা জল থাকা প্রয়োজন ততটা পরিমাণ জল ধরে রাখাও যায়নি। ফলস্বরূপ আস্তে আস্তে শুকোতে থেকেছে এই রামসার সাইট। অথচ, ২০১৬ সালে এই সরকারই স্লুইস গেট বসানোর জন্য নির্দেশিকা জারি করে যাতে এই জলাভূমিতে সারা বছর অন্তত তিন থেকে চার ফুট জল থাকে। কিন্তু সেই নির্দেশিকা কাগজে-কলমেই থেকে গেছে।
আরও পড়ুন: করোনার পর কোন ভাইরাস? অতিমারীর ভয়াল দিন ফেরাচ্ছে জলবায়ুর ভোলবদল?
এই জলাভূমির মূল জলের উৎস হল দুধগঙ্গা নদী। এখানে সারা বছর ৬৮ ধরণের পরিযায়ী জলপাখির আগমন ঘটে বা ঘটত। যেমন, গ্রেট ইগ্রেট, গ্রেট ক্রেসটেড গ্রেব, লিটল করমোরান্ট, কমন শেলডাক, টাফটেড ডাক, এবং ফেরাঙ্গিনোয়াস ডাক। শীতে এদের আগমন হয় সাইবেরিয়া, চিন, মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ইউরোপিয়ান দেশগুলি থেকে। এদের মধ্যে অনেক প্রজাতির পাখিই আজ বিপন্ন। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো এই ধরণের জলাভূমির ধ্বংস হতে থাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, জায়গাটা এতটাই শুকিয়ে গেছে যে, তারা সেখানে ছোট ট্রাক নিয়েও ঢুকে যেতে পারছেন। শুধু তাই নয়, ড্রেজিঙের সময় যে মাটি খনন করা হয়েছিল, তার আশি শতাংশই এখনও সেই স্থানে পড়ে আছে। তাহলে ওই খননের মানে কী দাঁড়াল? পুরো কাজের উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে গেল। সরকার পক্ষ থেকে এখন মুখ বাঁচানোর জন্যে খালি বলা হচ্ছে যে, যত দ্রুত সম্ভব তারা স্লুইস গেট বসানো হবে। সেই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। কবে বসাবে, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই।
এই বিষয়ে যখন সাংবাদিকরা কাশ্মীরের ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে যান, তখন তাকে কোনওভাবেই পাওয়া যায়নি। প্রতিক্রিয়া তো অনেক দূরের বিষয়। যদিও তার অফিস থেকে জানানো হয়েছে যে, তিনি এই জলাভূমি সংরক্ষণের কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং নিয়মিত তিনি ওই স্থানে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন।
বিশেষজ্ঞরা কিন্তু এই জলাভূমি বাঁচাতে অনেক সুপারিশ করেছেন। তাঁরা বলছেন যে, একটি একটি করে রামসার সাইট ধরে পরিকল্পনা না করে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন এই রাজ্যের সমস্ত জলাভূমির জন্য। সেই সঙ্গে তাঁদের সুপারিশ, যে সমস্ত আধিকারিকরা এই জলাভূমিগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের যাতে নিয়মিত গবেষণা থেকে আশা রিপোর্ট দিয়ে সাহায্য করা যায়। জেলা পরিকল্পনার সঙ্গে যেন জলাভূমি সংরক্ষণের কাজকেও জুড়ে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে পর্যটন শিল্পে যুক্ত সকল মানুষ, এবং পর্যটকদেরও যাতে জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা যায়, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল, ভারতীয় সেনাকে যাতে এই কাজের অংশীদার করা যায়। ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়াও হয়েছিল, যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু জওয়ানকে নিয়ে লাদাখে গ্রিন ব্রিগেড তৈরি করা যায়। কিন্তু আমলাতন্ত্রের জটে এই সুপারিশগুলির বেশিরভাগই কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য নয়, এই আমলারা যদি পর্যটন নিয়েও একটু ভাবতেন তাহলে জলাভূমিগুলি রক্ষা পেত, রাজ্যের আয় হতো কোটি কোটি টাকা। কিন্তু তাঁদের উৎসাহ এবং ভালো কাজ করার তাগিদের চূড়ান্ত অভাব এই জলাভূমিগুলিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং সেই সঙ্গে চরম ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।