অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসে ব্যাঙ্ক লোনের ফোন পেয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়
সুসেন: সময়টা সম্ভবত ২০১০ সালের মাঝামাঝি। নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার ক্যাবিনেট বৈঠকের আগে জরুরি প্রস্তুতি সারছেন তিনি। অসাবধানতা বশত হয়তো ফোনটা সুইচ অফ করে রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। আচমকা গুরুত্বপূর্ণ ওই বৈঠকের মধ্যে দেশের অর্থমন্ত্রীর ম্যোবাইলটা বেজে উঠল। অনেককাল আগের পুরানো ছোট্ট মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় শুধু বলতে পেরেছিলেন, হ্যালো। ফোনের ওপাশ থেকে চোস্ত হিন্দিতে ঝড় বইয়ে এক সুকন্ঠী টানা বলে গিয়েছিলেন, স্যার, আমি ------ ব্যাঙ্ক থেকে বলছি, আপনার কি হোম লোন, পার্সোনাল লোন বা কোনও এমার্জেন্সি লোনের প্রয়োজন আছে? পরে এই ঘটনাটি রসিকতার আকারে দিল্লি, কলকাতা সহ দেশের নানা প্রান্তে সাংবাদিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য হালকা চালে রসিকতার আকারে দেখলেও ঘটনার গুরুত্ব কিন্তু এক ফোঁটা কমে না। তথ্য পাচারের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকেও রেয়াত করে না। অথচ এই ঘটনার বছর চারেক আগে ২০০৬ সালের নভেম্বরে দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার পাঠায় দেশের সমস্ত ব্যাংককে। কি ছিল সেই সার্কুলারের সার সংক্ষেপ? ব্যাংকগুলির আর্থিক পরিষেবায় আউটসোর্সিং সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং পরিচালন সংক্রান্ত ঝুঁকির বিষয়ে নির্দেশাবলী ছিল ওই সার্কুলারের মূল আলোচ্য। সেই সার্কুলারে বারবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু অবস্থা যে বদলায়নি তার অকাট্য প্রমাণ আগের উল্লিখিত ঘটনা।
শুধু আমাদের দেশই নয়, তথ্য পাচারের মত গভীর অসুখে আক্রান্ত পাশ্চাত্য দুনিয়াও। আবার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা লিঙ্কডিনের মত তথ্য ফাঁসের ঘটনার কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কিভাবে হয় এই ব্যাঙ্কের বা আর্থিক ক্ষেত্রে তথ্য পাচার? গোয়েন্দারা বলছেন, ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া থাকে। তাঁরাই ব্যাংকের হয়ে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সংরক্ষণ-সহ নানা দায়িত্বে থাকে। সেই কর্মীরা মাঝে মধ্যেই চাকরি ছেড়ে অন্য সংস্থায় যোগ দেন। ফলে ওই কর্মীদের মধ্যে কেউ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকলে তথ্য পাচার হতে পারে।
সল্টলেক সাইবার সেলের সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিকের বক্তব্য, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে দুষ্কৃতীরা যে তথ্য জানিয়ে বিশ্বাস অর্জন করেছে, তা একমাত্র ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব। সল্টলেকে সাইবার থানায় বেশ কিছু ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে এমন বিষয় নজরে এসেছে। বিধাননগরের ফাল্গুনি আবাসনের বাসিন্দা নীলাদ্রি সরকার বলছেন, ব্যাঙ্কের কর্মীর পরিচয়ে ফোন করে তাঁদের অ্যাকাউন্ট, ঠিকানা, জন্মতারিখ-সহ এমন সব তথ্য বলা হচ্ছে, যাতে সে ভুয়ো কি না বোঝা দায়। গ্রাহকদের অভিযোগ, তাঁরা বিশ্বাস করে ব্যাঙ্কে ব্যক্তিগত তথ্য জমা রাখেন। ফলে তা অন্য কারও হাতে গেলে তার দায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের। অথচ তাঁরা কোনও দায় নিতে চান না।
দক্ষিণ কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের একটি শাখার সার্ভিস ম্যানেজার তনিমা চ্যাটার্জির পাল্টা দাবি, ব্যাঙ্কের কর্মী কখনওই এভাবে গ্রাহকদের কোনও গোপন তথ্য জানতে চান না। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকদের দায়িত্ব রয়েছে। গ্রাহকেরা গোপন তথ্য, যেমন পাসওয়ার্ড ইত্যাদি বলে ফেললে ব্যাঙ্কের কিছু করণীয় থাকে না। সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ অরিজিৎ চৌধুরীর পরাম র্শ, ‘‘গ্রাহকদের তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তা না হলে গ্রাহকরা অবশ্যই আইনের পথে যেতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা আইনি পথে সুফল পেয়েছেন।’’ আবার নিজেদেরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে ওটিপি শেয়ার না করলে নাকি ব্যাঙ্কের টাকা চুরি হয় না ? কিন্তু চোরেরা এখন বিলক্ষণ বুদ্ধিমান। তারা নানা ফন্দি বার করে চলেছে আপনার টাকা চুরি করতে। তাই ওটিপি যেমন শেয়ার করবেন না তেমনই মাথায় রাখবেন টাকা সরিয়ে ফেলার আরও অনেক কৌশল আছে। যেমন, আপনি হয়তো কোনওা শপিং মলে গিয়েছেন। সেখানে কোনও একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্মীটির কাছে দিয়েছেন ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড। ওই কর্মীর যদি কোনও দুরভিসন্ধি থাকে সে কিন্তু চাইলেই নিজের মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে চোখের নিমেষে আপনার কার্ডের দুই পিঠের ছবি তুলে নিতে পারে। লোকটি যদি কোনও অফশোর ই-কমার্স ওয়েবসাইটে কার্ডটি ব্যবহার করে, তাহলে কোনও ওটিপি কিংবা পিন-এর প্রয়োজনই পড়বে না। তাই আপনার যে কার্ডে বিদেশি লেনদেনের সুযোগ আছে সেটি সাবধানে ব্যবহার করুন।
অনেক প্রতারক অন্য উপায়ও কাজে লাগায়। বিভিন্ন অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে আপনার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারপরই ফোন চলে আসছে আপনার কাছে। ধরাধরা গলায় একজন আপনাকে জানাবে যে ভুলবশত আপনার অ্যাকাউন্টে সে টাকা পাঠিয়ে ফেলেছে, আর এই টাকা যদি এখুনি তাকে ফেরত না পাঠানো হয় তবে অফিসে অডিটর হিসেবের গোলমাল পাবে এবং ফল হিসেবে তার চাকরিটি যাবে। আপনাকে সেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সে প্রায় কাকুতিমিনতি করবে। আপনি রাজি হলেই সে কাজটা করার জন্য আপনাকে একটি কিউ-আর কোড স্ক্যান করতে বলবে। যে মুহূর্তে আপনি কিউ-আর কোডটি স্ক্যান করবেন, দেখতে পাবেন আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নিমেষে বেরিয়ে গেল ! তাই কিউ আর কোড স্ক্যান করার ব্যাপারে সাবধান থাকা অত্যন্ত জরুরি। আর মোবাইলে ব্যাঙ্কিং অ্যাপ যদি ডাউনলোড করে থাকেন তাহলে আরও বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
কোন কার্ড ব্যবহার করছেন তাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১২ সালের আগের এদেশে আমাজনতার হাতে যে ডেবিট কার্ড ছিল তা হয় ভিসা বা মাস্টার। কিন্তু এই দু’টি কার্ডই মার্কিন মুলুকের আর সেগুলির ব্যবহারের খরচও বেশি। এজন্য ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ২০১২ সালে প্রথম ভারতীয় ডেবিট কার্ড বাজারে আনে ‘রুপে’ নামে। যে হেতু রুপে কার্ডে ব্যবহারের তথ্য দেশের ভিতরেই থাকে, তাই অনেক আর্থিক বিশেষজ্ঞ দাবি করে থাকেন যে এই কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি কম। ভিসা বা মাস্টার কার্ডের বিষয়ে যা প্রযোজ্য নয়। রুপে কার্ড রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, কোআপরেটিভ ব্যাঙ্ক এবং গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি তাদের গ্রাহকদের দেয়। কিছু নির্দিষ্ট বেসরকারি ব্যাঙ্কও এই কার্ড দিচ্ছে। কিন্তু ভিসা বা মাস্টার কার্ডের খরচ বেশি বলে তা ছোট ব্যাঙ্কগুলিতে পাওয়া যায় না।এই কার্ডগুলির ব্যবহারগত সুবিধা একই। ফারাক ব্যবহারের খরচের আর লেনদেনের তথ্য কোথায় থাকছে সেখানেই। তাই আপনার সুবিধা মতো আপনার নিজের ডেবিট কার্ড বেছে নিলে হয়তো আপনার টাকাও আরও খানিকটা সুরক্ষিত থাকবে।
তথ্যসূত্র - আর্থিক অপরাধের নানা দিক - শ্যামল রায়, অর্থিক সমীক্ষা, নির্দেশিকাঃ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ৩.১১.২০০৬, আনন্দবাজার পত্রিকা - ১০.০৮.২০১৫