অক্ষরের দরগায়: একার লেখা, একার পড়া
Reading List : রহস্য, সৌন্দর্য আর উপাসনা। সামান্য একটা শিশুপাঠ্য পুস্তকের অন্তর্জগৎকে এত বিপুল একটা মাত্রা দেওয়ার ক্ষমতা শুধু রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব।
তোমায় পড়া শেষ হবে না মোর- ইদানীং এই একটা কথা প্রায়শই মনে হয় আমার। যে লেখে সে শেষ পর্যন্ত একলা মানুষ, আর যে পড়ে সে-ও নির্জন ব্যক্তিমাত্র। এমনটা কিন্তু হতো না পুঁথিপাঠের যুগে, এমনকি এ যুগের সিনেমা-থিয়েটারেও। সমবেত আস্বাদন, সমবেত আবেগমোচন। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিভৃত আলাপচারিতার সেতু হল বই! এই যে নানা অছিলায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক অচেনা মানুষের হাতে হাত রেখে তাঁর সৃষ্টিকে আস্বাদন, এ এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা! প্রমথ চৌধুরী মশাই একটি প্রবন্ধে (‘বইপড়া’) ‘সংসারের প্রতি বীতরাগ’ হয়ে ‘লাইব্রেরিতে আশ্রয়’ নেওয়া এক ‘গ্রন্থকীট’ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। (নেপথ্যে ছিল এক বন্ধুর মন্তব্য!)
আমি অবশ্য বৈরাগ্য সাধনে কোনোদিন মুক্তি খুঁজিনি। সম্ভবও ছিল না। আমি ছাপোষা মানুষ, নানা ঝামেলায় জড়িয়ে নাভিশ্বাস ওঠে। ফাঁকে-ফাঁকে বই পড়ি। আমার কাছে বই-পড়া হল ব্যক্তি বিশ্বের উদ্যাপন। ওই একটা কাজই করতে পারি। নইলে, অকম্মার ঢেঁকি। শুনেছি, আমার শিক্ষক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আর খ্যাতনামা লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে নাকি একটা প্রতিযোগিতা চলত কে কত বই পড়েছেন, বা নতুন কোন কোন বই পড়া হল, এসব নিয়ে। বাবা-মা ছিলেন শিক্ষক এবং পড়ুয়া। ফলে, বইয়ের সঙ্গ-সান্নিধ্যেই বড় হয়েছি। বাবা, প্রয়াত আশীষ মজুমদার প্রায়শই বলতেন, "বই পড়। ওর থেকে ভালো বন্ধু আর হয় না!" প্রকৃতপক্ষে, বাবা-মা দুপুরে কর্মক্ষেত্রে চলে গেলে, আমি বইয়ের সঙ্গে অবাধে মিশতে পারতাম। বাবার সংগ্রহ থেকে যথেষ্ট বই পড়তাম। বেশ কিছু বই যে-বয়সে পড়ার নয়, দুঃসাহসে ভর করে সে সব পড়েছি। বদহজম হয়েছে। তবে নানা বিষয়ে আগ্রহ জন্মেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতিই শুধু নয়, রান্না থেকে রাজনীতি, খেলা থেকে নেশা, মহাসাগরের অতলান্ত জগৎ থেকে ইতিহাসের হালহকিকত, সবই বই পড়ার সুবাদে জেনেছি। আর ছিল, আড্ডা। নিজের এবং বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে, নানা বৈঠক, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বৃত্ত, সিনিয়র এবং বিশেষজ্ঞ এমনকি উচ্ছন্নমার্কা-বখে যাওয়া প্রান্তজনের আখড়া– সব মিলিয়ে ‘ঠেক’-এ শেখা। বই হল প্রকাশ্যে বা অন্তরালে প্রধান বৈঠা!
বই মানে কিন্তু একটা গোটা বই! তার প্রচ্ছদ, তার বাঁধাই, তার অক্ষর, তার মুদ্রণ, তার অঙ্গসজ্জা, যদি অলঙ্করণ থাকে, এমনকি হরফের সাইজও। ‘বই পড়া’ বলতে কিন্তু তাকে সর্বস্বসমেত জড়িয়ে ধরা, অল্পবয়সে যেমন ক্রিকেট ব্যাটকে জড়িয়ে শুতাম! প্রতিটি বইয়ের আলাদা আলাদা ‘ব্যক্তিত্ব’ আছে, তার বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ সবই নিজস্বতায় ভরা। আবার, বই সংস্করণ ভেদে আলাদাও। গ্রন্থাগারের বিরুদ্ধে আমার একটাই অনুযোগ, সেখানে কালো, সবুজ, লাল, বাদামি– নানা রঙে বই একঢালা রেক্সিনে আপাদমস্তক ঢেকে বসে আছে। একে-অন্যে পার্থক্য নেই। বইয়ের আলাদা বিশিষ্টতাও, ফলে, উধাও। রঙহীন, বৈচিত্র্যহীন একদম বোবা জগৎ। ‘অগ্রন্থিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়’, বাদল সরকার ‘নাটক সমগ্র’, বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্যদর্পণ’, বঙ্গানুবাদ আর ওরহান পামুকের ‘Snow’– সবই একই কায়দায় বাঁধানো। বাইরে থেকে আলাদা করার জো নেই। আমি অস্থির হয়ে পড়ি। এসব পছন্দ হয় না। বইয়ের সঙ্গে অনেক সময় আড়ালে কথা বলি। কথা বলি চরিত্রের সঙ্গে। মতি নন্দীর প্রসূন ভট্চায, নবারুণের রণজয়, আনুইয়ের আন্তিগোনে, দস্তয়েভস্কির লাঞ্ছিত নিপীড়িত নায়ক-নায়িকা কিংবা মহাশ্বেতা দেবীর স্তনদায়িনী-র সঙ্গে আমার হামেশাই কথাবার্তা হয়। কথা হয় আরও কত শত লোকের সঙ্গে! বিভূতিভূষণ থেকে পরশুরাম বা মুজতবা আলি – সবার সঙ্গে কথা চলতেই থাকে। আমৃত্যু চলতেই থাকবে। আমার মা আয়ুর শেষদিন পর্যন্ত খুদি-খুদি অক্ষরের বই পড়েছেন। শেষ বইটি ছিল, হারুকি মুরাকামির ‘After the dark’। আমি অবশ্য কবিতা পড়তে পড়তে অবসান চাই। ‘পড়া’ থেকেই হোক শুরু আর শেষ। যাক সে কথা। জগৎ পারাপারের তীরে বই পড়ে আজও কাঁদি। হাসি। বই কতবার জীবন পাল্টে দিল। ফুটপাথ থেকে কিনেছিলাম ই এল ডকটরো-র উপন্যাস ‘র্যাগটাইম’ (১৯৭৫)– সত্যি বলছি, জীবন পাল্টে গেছে! তবে তার কথা এখন বলছি না, সে একাই একটা প্রবন্ধ দাবি করে! কী দুর্দান্ত একটা মায়াবী আখ্যান!
আরও পড়ুন- কী বই পড়ছি?
তার চেয়ে দুটো খুব চেনা বই নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। 'সহজ পাঠ ১' আর 'সহজ পাঠ ২' বহু-বহু বার বই দুটি পড়েছি। এখনও পড়ি। তবু তার তল খুঁজে পাই না। এমন দু-খানা বই আমার ‘বই পড়া’র প্রধান ভিত্তি এবং কারিগর। এটা ভাবলেই মনটা খুশি হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের লেখা আর নন্দলাল বসুর ছবি, দুয়ে মিলে এক জাদুভাণ্ডার তৈরি করেছে। এই জাদুভাণ্ডার নানা বয়সে নানা বার্তা এবং তাৎপর্য নিয়ে আসে। আসুন, বই দুটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখি।
প্রথমে তথ্য। সেদিকে যাবার আগে দ্রুত দেখে নিই, এই প্রাইমার বা ‘বুনিয়াদি কেতাব’ সম্পর্কে কী বলছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘যে বয়সে ক-খ চিনলেই যথেষ্ট সেই বয়সেই সাহিত্য রসে দীক্ষা দেয় “সহজ পাঠ”; এই একটি বইয়ের জন্য বাঙালি শিশুর ভাগ্যকে জগতের ঈর্ষাযোগ্য বলে মনে করি।’ (‘বাংলা শিশুসাহিত্য’) কোনো সন্দেহ নেই, ঘটনাটি ব্যতিক্রমী। নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত কোনো কবি, একেবারে শিশুদের পাঠ্য ‘বুনিয়াদি কেতাব’ কখনও, কোনো দেশে লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। বই দুটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩০ সালে। যদিও প্রথম খসড়া পাওয়া যাচ্ছে ১৩০২-০৩ বঙ্গাব্দের কোনো সময়। ওই সময়ে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ–
‘মীরাটাকে যখন আমার ভালো লাগে তখন তার মধ্যে আমি এমন একটা অসীম রহস্য অনুভব করি যে, সে কেবল আমার কন্যা মীরা থাকে না– সে বিশ্বের সমস্ত মূলরহস্য, মূল সৌন্দর্যের অঙ্গ হয়ে পড়ে, আমার স্নেহ-উচ্ছাস একটা উপাসনার মতো হয়ে আসে।’
(ছিন্নপত্র/ শিলাইদহ/ ১৩ অগাস্ট/ ১৮৯৪)
লিখতে–লিখতে দেখি আজই ১৩ অগাস্ট! ২০২৫! ১৩১ বছর আগে ফিরে গিয়ে আবার চিঠিটা পড়ি। তিনটে শব্দ তুলে নিই। রহস্য, সৌন্দর্য আর উপাসনা। সামান্য একটা শিশুপাঠ্য পুস্তকের অন্তর্জগৎকে এত বিপুল একটা মাত্রা দেওয়ার ক্ষমতা শুধু রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব।
সত্যিই, সহজপাঠ - ১, সহজপাঠ – ২ আকীর্ণ হয়ে আছে আশ্চর্য সব রহস্য, সৌন্দর্য আর উপাসনায়। শিশু তাকে একভাবে দেখে, পড়ে। অজান্তেই এই বিশ্বলোকের সঙ্গে সৌন্দর্যের মহাপৃথিবীর সঙ্গে একটা সংলাপ একটা বিনিময় শুরু হয়ে যায়। আমার বুকের মধ্যে, আমার রক্তকণিকায়, আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে, আমার ইন্দ্রিয়ের গভীরে মিশে থাকে সেইসব ইশারা ইঙ্গিত। এদের বহন করেই প্রৌঢ়ত্বে এসে পৌঁছলাম। বুড়ো হলাম।
‘কাল ছিল ডাল খালি,/ আজ ফুলে যায় ভ’রে।/ বল দেখি তুই মালী,/ হয় সে কেমন ক’রে/’
এই পঙক্তিতে সৌন্দর্য মিশে গেছে রহস্যে আর স্নেহ-উচ্ছ্বাস যেন উপাসনায় রূপান্তরিত। এ কি বিস্ময়? একি সমর্পণ? একি শিশুর সারল্য? একি দরবেশের আকুতি? এ কি অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো ঔপনিষদিক ঋষির সন্ধান?
লক্ষ করবেন, কোনো যুক্তাক্ষর নেই। কেননা, কবিতাটি প্রথম ভাগের। এত সহজ অথচ এত গভীর! রবীন্দ্রনাথ এই দুই কেতাবে প্রকৃতপক্ষে কবিতার নানা ছন্দ এবং অবয়বের একটা ধারণাও শিশুমনে চারিয়ে দিচ্ছেন। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ ছিল তাঁর শৈশবের মেঘদূত। তাঁর নিজের কীর্তিও কম মর্মস্পর্শী নয়। ছন্দের ঝংকারে, চিত্রকল্পের ভাস্বরতায় সে এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। প্রথম ভাগে আছে গদ্য-পদ্য মিলিয়ে দশটি পাঠ আর দ্বিতীয় ভাগে তেরোটি। বিশেষত কবিতাগুলিতে বাংলা ছন্দের তিন প্রধান কিসিম– মিশ্রকলাবৃত্ত, কলাবৃত্ত এবং দলবৃত্ত যেমন আছে, তার সঙ্গে-সঙ্গে প্রবহমান পয়ার, কলাবৃত্ত পয়ারও। প্রথম ভাগে এসব ছন্দ-প্রকৌশল যুক্তাক্ষরহীন অথচ গভীর সব উন্মোচনের সূচক। তিনটি দৃষ্টান্ত দিই –
ক) ‘বাঁশ গাছ/ করে নাচ/ ঝাউডাল/ দেয় তাল’
খ) ‘ওদের সে ঘরখানি/ যাবে কি মাটির কাছে?/ দাদা বলে, জানি জানি/ সে-ঘর আকাশে আছে।’
গ) ‘রোজ রোজ ভাবে বসে প্রদীপের আলো,/ উড়িতে পেতাম যদি হতো বড়ো ভালো।/ ভাবিতে ভাবিতে শেষে কবে পেল পাখা-/ জোনাকি হল সে, ঘরে/ যায় না তো রাখা।’
কল্পনার অত্যাশ্চর্য সব স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো এই কবিতা দ্বিতীয় ভাগে পৌঁছে নতুন নতুন বাঁক নেয় –
ক) ‘হারিয়ে-পাওয়া আলোটিরে/ নাচায় ভালে ফিরে ফিরে/ ঝুমকো ফুলের লতা’
খ) 'কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি/ অন্ধের কণ্ঠের গান আগমনী।'
দৃষ্টান্ত বাড়াব না। লক্ষ করতে বলব, কত অল্প কথায়, কত নির্মেদ ভাষায়, কত বহুমাত্রিক দর্শনদীপ্ত উচ্চারণ পাতায় পাতায় ছড়িয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে প্রতিটি পঙক্তির ধ্বনিসুষমা এবং রুদ্ধদল-মুক্তদলের সজ্জাজনিত উত্থানপতন বন্ধুর ঝংকার একেবারে তাক লাগিয়ে দেয়। সঙ্গে অনবদ্য ছবি এঁকেছেন নন্দলাল বসু। সাদা-কালো লিনোকাট আর চওড়া ফ্রেমের পটচিত্র স্টাইলের ছবিতে শিশুকে ক্রমাগত কল্পনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস। ঝগড়া করছে ‘তিনটে শালিক’ আর ছবিতে আছে দুটো। অনুমান করি, যুক্তি হচ্ছে একটা কবিতা পড়তে পড়তে উড়ে গেছে। নিছক বাস্তব কাব্যানুসরণ নয়, বরং একটু অভিধায় কল্পনা মিশিয়ে দেওয়া। গদ্যও যেন সংগীতের মতো স্পন্দনশীল, বহুস্তরিক অথচ সোজাসাপটা সারল্যময়।
‘বেলা হল। মাঠ ধূ ধূ করে। থেকে থেকে হূ হূ হাওয়া বয়। দূরে ধুলো ওড়ে।’
‘আঁধার হল। ঐ-যে চাঁপাগাছের ফাঁকে বাঁকা চাঁদ। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস উড়ে চলে।’‘পূর্বদিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো। পশ্চিম দিকের মেঘ ঘন নীল।’
‘এখনি রেভারেন্ড এন্ডার্সন আসবেন। পণ্ডিত মশায়েরও আসবার সময় হ’ল। ঐ শোনো কুণ্ডুদের বাড়ি ঢং ঢং ক’রে ছটার ঘণ্টা বাজে।’
শুধু সংগীত নয়, দৃশ্য-রং-শব্দ মিলে এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অটল ভুবন! কখন যেন স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, বাক্য, ছত্র, স্তবক, ছন্দ মিলে এক শিক্ষাপ্রকল্প হয়ে ওঠে ব্যক্তি মানুষের আত্মসন্ধানের প্রক্রিয়া! শিশু তার প্রাকৃতিক পরিবেশ আর সামাজিক পরিবেশ মিলিয়ে নিজের শিকড় খোঁজে। দৃশ্য থেকে জনপদ থেকে মহাকাশ সবই তার বিস্তারের ক্ষেত্র। ‘চলো ভাই নীলু। এই তালবন দিয়ে পথ। তার পরে তিলখেত। তার পরে তিসিখেত। তার পরে দিঘি। জল খুব নীল।’ অথবা ‘ঘন মেঘে সব অস্পষ্ট হয়ে এল। আর দৃষ্টি চলে না। বোষ্টমি গান গাইতে এসেছে। ওকে নিষ্ঠুর হয়ে বাইরে রেখো না।…’ ছবি আর লেখা যেন হাত ধরাধরি করে এক সুদূর দিগন্তের আভাস নিয়ে আসে। যতবার পড়ি, মনে হয়, নতুন নতুন উপলব্ধির জাদুজগতে প্রবেশ করছি। ‘মেঘ চলে ভেসে ভেসে আকাশের গায়,/ ঘন শেওলার দল জলে ভেসে যায়।’
দেশ-বিদেশের বহু প্রাইমার আমি দেখেছি। তাদের নিয়ে কাজ করার কিছু অভিজ্ঞতাও আমার আছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের একাধিক প্রাইমার আমি দেখেছি। কোনোটিতেই এত সাহিত্যগন্ধী অভিমুখ নেই। সে সব কেজো কথায় ভর্তি। 'সহজ পাঠ ১ ' এবং 'সহজ পাঠ ২' ক্রমাগত কল্পনার দরজায় ঘা দেয়। কেজো কথা, অনুশাসন কিংবা প্রাপ্তবয়স্কদের শাসনতর্জনের বাইরে এক আনন্দময় নাচনের ফুর্তি জাগিয়ে তোলে। এক ‘আমি’ তার কেন্দ্রে। ধর্ম, লিঙ্গ, অর্থনীতির বাইরে এক আশ্চর্য সর্বনাম। সে হল, এক অত্যন্ত সংবেদনশীল মন। যার ইচ্ছে ময়ূরপঙ্খী নৌকোর মতো উড়ে বেড়ায়।
‘ফিরিব বাতাস বেয়ে রামধনু খুঁজি,/ আলোর অশোক ফুল চুলে দেব গুঁজি।/ সাত সাগরের পারে পারিজাত-বনে/ জল দিতে চলে যাব আপনার মনে।’
দূরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা।
কথা যখন বলতে শুরু করেছি, আরও খানিকটা বলেই ফেলি। সহজপাঠের সঙ্গে আরও যে গোটা পঞ্চাশ প্রিয় বইপত্র আমি রোমকূপে বহন করি, স্নায়ু এবং মস্তিষ্ককোষে কণায় কণায় খোদাই করে রাখি, নিশ্চয়ই তাদের সবার কথা বলার পরিসর এখানে নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত বলতে হবে, ‘তবু ভরিল না চিত্ত!’ আরও একটা বইয়ের কথা না বললেই নয়। কেউ বলেন খ্রিষ্টপূর্ব কালের, কেউ বলেন কালিদাস পরবর্তী। সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিকম্’ বিষয়ে দু-চার কথা বলতে চাইব। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এটি ভরতের নাট্যশাস্ত্র পরবর্তী রচনা। হয়তো কালিদাস পরবর্তীও। নাট্যকারের নাম শূদ্রক। আমার বারংবার মনে হয়, এই জাত-পাত, ব্রাহ্মণ-দলিত, উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের তীব্র ঘৃণার ভারতবর্ষে, নারীর অবমাননা, নারী ধর্ষণ আর সংখ্যালঘু অত্যাচারের ভারতবর্ষে এই নাটক হতে পারে মানুষ আর মানুষের ভালোবাসা নামক অভিব্যক্তির এক প্রতিরোধ। আমি জানি না, এত নাট্যদল এখন অত্যন্ত উঁচু মানের প্রযোজনা করছেন বিভিন্ন মঞ্চে, তাঁরা কেউ কখনও ‘মৃচ্ছকটিকম্’ নাটকটিকে কেন প্রযোজনার কথা ভাবছেন না। এক সময়, ‘বহুরূপী’ এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিল, বহুল জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সঙ্কটের দেশকালে এ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা অসীম। কোন বিস্ময়কর ক্ষমতাবলে ভরতের নাট্যশাস্ত্রকে, তার নানান অনুশাসন এবং সে যুগের সমাজ সংসারকে তুচ্ছ করে এ নাটক লিখেছিলেন শূদ্রক, সে কথা আজ ভাবলে চমকে যেতে হয়!
আরও পড়ুন- বাদল সরকারের ‘প্রবাসের হিজিবিজি’-তেই ধরা আছে তাঁর তাবৎ কাজের নানা সূত্র
এ নাটকের কেন্দ্রে আছেন ধনবতী, রূপবতী, বারাঙ্গনা বসন্তসেনা, নায়ক (?) হিসেবে গরিব ব্যবসাদার ব্রাহ্মণ চারু দত্ত। দশ অঙ্কের এই প্রকরণের কাহিনি স্পষ্টতই লোকায়তিক। ফলে, সংস্কৃত নাটকের সাধারণ সূত্রের বাইরে। কোনো অতিলৌকিকের স্পর্শমাত্র নেই। সাধারণ মানুষের, সাধারণ জীবনের গল্প। নাম সেজন্য মৃৎ + শকটিক, অর্থাৎ মাটির গাড়ি। এ নাটকে অত্যাচারী প্রজাপীড়ক দুর্নীতিবাজ রাজার পতন আর মানুষের প্রিয় রাজার সিংহাসন প্রাপ্তি। রাজছত্র ভেঙে পড়ার এই গল্পে সারিবদ্ধ মানুষের মিছিল উঠে আসে মঞ্চে। গণিকা, শ্রেষ্ঠী, চোর, বৌদ্ধ শ্রমণ, বণিক, জুয়াড়ি, দেহপসারিণী, দাস-দাসী, মাহুত, প্রবঞ্চক, চণ্ডাল, প্রহরী, রাজশ্যালক, ক্ষমতার নানা পদলেহনকারী, পুরস্ত্রী, বিদূষক – উজ্জয়িনীর নানা স্তরের বিচিত্রবর্ণের মানুষ এখানে স্ব-স্ব ভূমিকায় আবির্ভূত। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, কায়স্থ, চণ্ডাল– সব ধরণের মানুষ উপস্থিত। আছে প্রবল হাস্যরস, উদ্বেগ, প্রেম এবং লোকায়ত জীবনের উৎসব-পরব। ব্যক্তি প্রেমের সংকট, ক্ষমতার নখদন্ত আর সেই ক্ষত থেকে উদ্ধারের পথ যুক্ত হয়ে গেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের সমবেত ঈপ্সার সঙ্গে! এ এক বৈপ্লবিক চিন্তাধারার অভিব্যক্তি।
একই সঙ্গে ভারতবর্ষে প্রচলিত বর্ণব্যবস্থাকে পদে পদে হাস্যে-ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেন শূদ্রক। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আর রাজতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্য মানববিরোধী নৃশংস মুখটিকে বারংবার উন্মোচিত করে দেন। এ নাটকের প্রায় দ্বিতীয় নায়ক শর্বিলক, এক ব্রাহ্মণসন্তান এবং চোর। সে পৈতের মাপে নানা শিল্পিত আকারের সিঁদ কাটে! বসন্তসেনার দুর্মর প্রেম এবং ক্ষমতার বিরুদ্ধে অসম লড়াই থেকেই জন্ম নেয় চারু দত্তের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। বারাঙ্গনার সঙ্গে ব্রাহ্মণের শুধু বিবাহই হয় না, নতুন রাজার কল্যাণে চারু দত্তই হয়ে ওঠে এক অঙ্গরাজ্যের নৃপতি।
এই নাটক যেন আমার রক্তে দোলা লাগায়। তার কারণ এর প্লট, এর চমৎকার কাহিনি গ্রন্থনা। বিশ্বের নানা দেশের, নানা ভাষার, নানা সমস্যার বিষয়ে লেখা নাটক আমি পড়েছি। গ্রিক নাটক থেকে সাম্প্রতিক বিশ্বনাটক বা বাংলা নাটক। এমন চমকপ্রদ ব্যক্তি-জনপদ-রাষ্ট্রকে এক সুতোয় এত রঙিন বাঁধনে বাঁধতে আমি কাউকে দেখিনি। এ নাটক একদা তর্জমা অর্জন করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, তর্জমা করেছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য বা শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত। রাষ্ট্রক্ষমতা আর সমাজদক্ষতার মুখে এমন এক জবরদস্ত হাস্যাঘাত – মনে হয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং জুড়িহীন।
কোনো নাট্যদল কি একবার ভাবতে পারেন ‘মৃচ্ছকটিকম্’ মঞ্চায়নের কথা? আমার প্রিয় নাটক বলে নয়, সময়ের দাবিতে!
Whatsapp
