জাতগণনার সিদ্ধান্ত বিজেপির কাছে ব্যুমেরাং হবে না তো?
BJP Caste Census: নরেন্দ্র মোদি সরকারের জাতগণনার সিদ্ধান্ত অনেককেই অবাক করেছে কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বর্ণব্যবস্থার ঘোষিত সমর্থক।
নির্বাচন বড় বালাই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের দেশব্যাপী জাতগণনা করার সিদ্ধান্তের পেছনে বিহারের আগামী বিধানসভা নির্বাচনের ভূমিকা থাকলেও, একথা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই যে, এই সিদ্ধান্ত এত দিন পর্যন্ত মোদি সরকার জাতগণনার প্রশ্নে যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিল, তার থেকে সোজা ডিগবাজি। একইসঙ্গে একথাও স্বীকার্য যে, বিরোধী জোটের নেতা হিসাবে রাহুল গান্ধি গত কয়েকবছর ধরে যে ধারাবাহিকতায় জাত গণনার পক্ষে সওয়াল করছিলেন, এই সিদ্ধান্ত তার এজেন্ডাকেও মান্যতা দিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে, মোদি জমানায় এই প্রথম বিরোধী শক্তি কোনও রাজনৈতিক এজেন্ডা স্থির করে, ক্ষমতাসীন সরকারকে তার প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য করল। এক্ষেত্রে অবশ্য সমস্ত বিরোধী পক্ষ একইভাবে সরব হয়নি, বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস ও আপ এক্ষেত্রে ইস্পাতকঠিন নীরবতা পালন করেছে। এমনকী বামপন্থীরা নীতিগতভাবে এই দাবিকে সমর্থন করলেও, রাস্তায় নেমে জাতগণনার দাবিতে আন্দোলন করার কোনও প্রয়াস নজরে পড়েনি। এনডিএ জোটের মধ্যে একমাত্র বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এই দাবিকে এক সর্বভারতীয় রূপ দিয়েছেন এবং নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বিহারে জাতগণনা করিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদির এই সিদ্ধান্তকে ডিগবাজি বলার কারণ, কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই দাবিকে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা, গৃহযুদ্ধ করার নীল নকশা, আর্বান নকশালদের এজেন্ডা বলে মোদি সহ বিজেপির শীর্যনেতারা নাকচ করার চেষ্টা করেছেন। এই ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত দেশে সামাজিক ন্যায়ের প্রবক্তাদের কাছেও এক বড় জয়। দেশজোড়া জাতগণনা একদিকে যেমন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করবে, তেমনই সরকার বিজ্ঞাপিত পৃথিবীর তৃতীয় বড় অর্থনীতিতে এই মানুষদের অংশীদারিত্ব, দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে তাদের অবস্থান, রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের ভূমিকা নিরূপিত হবে। সরকারের জনকল্যাণ প্রকল্পের বিন্যাস, লক্ষ্যমাত্রার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব হবে জাতগণনার সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে। তাই জাতগণনার ন্যায্যতা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না। একদা দলিত রাজনীতির অন্যতম তারকা কাঁসিরামের বিখ্যাত স্লোগান 'জিসকি জিতনি সংখ্যা ভারি, উতনি উসকি হিসসাদারি' নতুন রূপে শোনা যাচ্ছে রাহুল গান্ধির গলায়, "জিতনি আবাদি উতনা হক"।
আরও পড়ুন- পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নেই! দাবির আড়ালে লুকিয়ে যে আসল সত্য
ঔপনিবেশিক ভারতে জাতভিত্তিক গণনার কাজ শুরু হয় ১৯১১ সালে। বি আর আম্বেদকর তাঁর 'Untouchables or the children of India's ghetto' প্রবন্ধে এই জাতগণনার তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই জাতগণনার তথ্য পরবর্তীতে ১৯২১ ও ১৯৩১ সালের আদমসুমারিতে উল্লিখিত হয় এবং গোলটেবিল বৈঠকে এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। মার্ক গ্যালেনটারের মতে, 'দলিত শ্রেণির এই সংখ্যা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নিপীড়তদের অংশ গ্রহণের প্রশ্নে ও রাজনৈতিক কাঠামোতে তাদের অংশীদারি নিয়ে এক নতুন মাত্রা যোগ করে"। কিন্তু ৪৭' পরবর্তী ভারতে জাতগণনার দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালের আদমসুমারিতে আর্থ-সামাজিক সমীক্ষায় তথ্য সংগৃহীত হলেও সেই জাতভিত্তিক সমীক্ষার তথ্য কখনও প্রকাশিত হয়নি। এমনকী উত্তরপ্রদেশে 'সামাজিক ন্যায় সমিতি'-র নামে জাতভিত্তিক সমীক্ষা করা হলেও সেই সমীক্ষার ফলপ্রকাশ আটকে রাখা হয়েছে। মনে করা হয়, উত্তরপ্রদেশের দলিত নেতা ওমপ্রকাশ রাজভরের দল এই কারণেই এনডিএ জোট পরিত্যাগ করেছে। একমাত্র বিহারেই জাতগণনা সফল হয়। তেলঙ্গানাতে ২০২৩ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয়ী হবার পর সেখানেও রাহুল গান্ধির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মতো জাতগণনা হয়।
এই জাতগণনার প্রয়োজনীয়তা বহুমাত্রিক। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও জাত-পাত আজও এদেশে এক সামাজিক, আইনি, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। আজও জাত, পদবি নানাভাবে মানুষের জীবন, তাদের রাজনৈতিক পছন্দ ও সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে অর্থনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। ২০১১-১২ জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা গেছে তথাকথিত 'জেনারেল কাস্ট'-দের তুলনায় তপশিলি জাতি, উপজাতি ও ওবিসিদের গৃহস্থালির খরচ অনেক কম। ২০১৫-১৬ সালে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের সমীক্ষা অনুযায়ী, জেনারেল কাস্টের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫.৬%, ওই একই সমীক্ষা অনুসারে দারিদ্র্যের পরিমাণ আদিবাসীদের মধ্যে ৫০.৬%, তপশিলি জাতি ৩৩.৩% এবং ওবিসিদের (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) মধ্যে ২৭.২%। এই ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই সমীক্ষা হয়নি কারণ ভারতের শাসকদলের মধ্যে উচ্চবর্ণ তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের অপরিসীম নিয়ন্ত্রণ। কেন এই প্রস্তাবিত জাতগণনা ভারতের রাজনীতিতে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করতে পারবে তা বোঝার জন্য আমাদের কয়েক দশক পিছিয়ে যেতে হবে। ওবিসিদের সংরক্ষণের দাবিটি যখন মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টে সমর্থিত হয়, তখন তার অভিঘাত ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছিল। সেই আলোড়নের ফল হিসাবে দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে আসে এবং গো-বলয়ে তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজনীতি সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের রাজনীতির এক বিপরীত চেতনা হিসাবে উপস্থিত হয়। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা একে 'মণ্ডল বনাম কমণ্ডুলু'-র রাজনীতি বলে চিহ্নিত করেন।
প্রস্তাবিত জাতগণনা এতদিনকার চলে আসা দলিত ও ওবিসির রাজনীতির ন্যারেটিভকেও বদলে দিতে পারে। সেই সংখ্যাতত্ত্ব বুঝতে হলে ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর প্রকাশিত বিহারের জাত সমীক্ষার ফলাফলের দিকে নজর ফেরাতে হবে। এতে দেখা গিয়েছিল:
* বিহারের ১৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে অতি অনগ্রসর শ্রেণি (extreme backward class/ EBC) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) মোট পরিমাণ ৬৩%।
* ওবিসি, ইবিসি, তফশিলি জাতি (এসসি) এবং তফশিলি জনজাতিকে (এসটি) যুক্ত করলে সংখ্যাটা হয় ৮৫%।
* অসংরক্ষিত (জেনারেল কাস্ট) জনসংখ্যা ১৫.৫%।
বিহারের এই চিত্রটি আমাদের একটি বৃহত্তর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়— ভারতে এই প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যাটা ঠিক কত? জাতগণনা অন্তত এই সংখ্যাটার বিষয়ে আলেকপাত করতে পারবে।
আরও পড়ুন- নরম হিন্দুত্ব দিয়ে বিজেপিকে রোখা যাবে না : পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা
এই জাতগণনা কেন প্রচলিত ন্যারেটিভকে পাল্টে দেবে তা শুধু উপরিউক্ত পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে না। বিহারের রিপোর্টের ফলাফলকে সামনে রেখে বিহার রাজ্য মন্ত্রিসভা সংরক্ষণের মাত্রা ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং অতি অনগ্রসর শ্রেণির (ইবিসি) জন্য আর্থিক সহায়তা প্রকল্প ঘোষণা করেছে। একইভাবে রাহুল গান্ধির দাবি হলো সংরক্ষণ কোটার উর্ধ্ব সীমা তুলে দেওয়া। আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতগণনার সিদ্ধান্ত সামাজিক ন্যায়ের প্রবক্তাদের কাছে সুবিধাজনক হলেও তাদের সমস্যাও কম নয়। এই সমস্যা লুকিয়ে আছে অতি অনগ্রসর শ্রেণির হিসেবে। এতদিন পর্যন্ত ওবিসি রাজনীতির অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তাদের রাজনীতির প্রাধান্যকারী অবস্থায় আছে দু-একটি শ্রেণি। বিহারের ক্ষেত্রে যেমন যাদব ও কুর্মিরা। কিন্তু বিহারের সমীক্ষা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দিয়েছে মাল্লা, নাই, নুনিয়ার মতো অতি পিছড়ে বর্গের মানুষদের — সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে যাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ভারতের রাজনীতিতে এই অতি পিছড়ে বর্গের গুরুত্বের কথা বলেছিলেন বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরি ঠাকুর। আজ তাই ওবিসিদের মধ্যে ইবিসিদের জন্য আলাদা সংরক্ষণের (quota within quota) দাবি জোরালো হয়ে উঠে আসছে। ২০১৭ সালে এই বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষার জন্য রোহিণী কমিশন গঠিত হয়েছে। ইবিসিদের ক্ষমতায়নের দাবি আবার বৃহত্তর ওবিসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন ক্ষমতাবিন্যাসের দাবি তুলেছে। তাই আপাতভাবে সামাজিক ন্যায়ের ধ্বজাধারী দলগুলো লাভবান হলেও ভবিষ্যতে তা নতুন লড়াইয়ের সৃষ্টি করবে।
নরেন্দ্র মোদি সরকারের জাতগণনার সিদ্ধান্ত অনেককেই অবাক করেছে কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বর্ণব্যবস্থার ঘোষিত সমর্থক। এমনকী বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক ভিত্তি হলো সাবর্ণদের নিরঙ্কুশ সমর্থন। সেই রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই বিজেপি এতদিন জাতগণনার বিরোধিতা করে এসেছে। একদা তারা মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে গোবলয়ে হিংসাত্মক আন্দোলনকে মদত দিয়েছিল। এইজন্য আমরা দেখতে পাই, বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদবানির দেশব্যাপী সফল রথযাত্রার পরেও হিন্দত্ববাদীরা একক শক্তিতে ক্ষমতা পায় না কিন্তু দলিত রাজনীতির মধ্যেকার বিভাজন, দু-তিনটি জাতের প্রাধান্যকারী ভূমিকায় উঠে আসার বিষয়টি পরিস্থিতির বদল ঘটায়। সেই সুযোগ নিতে এগিয়ে আসে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। ভারতীয় বর্ণব্যবস্থার অন্তর্বিরোধকে দূরে সরিয়ে রেখে সংঘ পরিবার ভারতীয় রাজনীতিতে 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান'- এর এক নতুন ন্যারেটিভ হাজির করে যার পোস্টার বয় অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি। এমনকী নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়া আসলে ওবিসিদের ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসাবে প্রচার করা হয়। তাই আমরা দেখতে পাই, উপুর্যুপরি নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের ক্ষেত্রে ওবিসিরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কিন্তু জাতগণনার দাবির উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বিজেপিকে বাধ্য করছে এই ঝুঁকি নিতে। বিজেপির সমস্যা হলো, তারা যদি জাতসমীক্ষা ও তার ফলে উঠে আসা অধিক সংরক্ষণের দাবিকে মান্যতা না দেয় তাহলে তাদের মধ্যেকার দলিত মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা বিদ্রোহী হবে। আবার যদি তারা দলিত তথা সামগ্রিকভাবে প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের দাবিকে মেনে নেয় তবে তাদের রাজনীতির মূল অক্ষ উচ্চবর্ণের মানুষদের সঙ্গে অনিবার্য বিরোধ উপস্থিত হবে। এতদসত্বেও এই ব্যাপক সংখ্যার 'পিছড়ে বর্গ'-এর সমর্থন ব্যতীত হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনা সাকার হওয়া সম্ভব নয়। আবার সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি যদি জাতগণনার মাধ্যমে এক নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের জন্ম দিতে পারে তাহলে তা সংবিধান বাঁচানোর লড়াইকে নতুন মাত্রা দেবে। তাই শুধু সিদ্ধান্ত ঘোষণায় থেমে থাকা নয়, জনগণণা ও জাতগণনার তারিখ ঘোষণার দাবিকেও জীবন্ত রাখতে হবে কারণ 'জুমলা' শব্দটির মাহাত্ম্য আমরা আচ্ছে দিনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।