শরীরে মারণ রোগ, মনে অবসাদ! কেমন ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ জীবন

Soumitra Chatterjee: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে ভালো না থাকার চুপকথা বাড়িয়েছিলেন যেন।

বসন্ত নয়, আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিলো অবহেলা,
আমাকে ভালোবেসে এসেছে অবহেলা,
আমাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলো
অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা।
–সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
(বসন্ত নয়, অবহেলা)

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ঠিক যা যা চেয়েছিলেন তিনি, সেই তাঁকে ঘিরেই ছিল ঠিক তার বিপরীতের সমারোহ। প্রতি মুহূর্তে যে ভালো থাকার রসদ নিয়ে যেতে চাইতেন তিনি, বয়স বাড়তেই সৌমিত্র-জীবনে সেই রসদ হচ্ছিল বেদনার-কষ্টের। পরিবার, স্ত্রী-কন্যা-পুত্র নয়, অনন্য এই অভিনেভার শেষ জীবন অতিবাহিত হয়েছিল এক অযাচিত অসুখে! মারণ-রোগ ক্যানসার তো ছিলই, সঙ্গে ছিল সৌমিত্রের পৌত্র-যন্ত্রণা ছিল মারাত্মক! এক যুবক চরিত্রের জীবনের ভয়ংকর অবস্থা দেখতে হয়েছিল দাদু সৌমিত্রকে! তবুও তিনি এগিয়েছেন। প্রতিদিন অভিনয়-মঞ্চ দাপিয়ে বারবার যেন বলে উঠেছেন ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’!

২০১৭ সাল। মার্চ মাস। প্রবীণ অভিনেতার জীবনে ফের ভয়াবহ পরিস্থিতি। সদ্য অবিনয় জগতে পা দেওয়া, সৌমিত্রর নাতি অর্থাৎ কন্যা পৌলমী-পুত্র রণদীপের জীবন তখন সংকটে। বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হলেন অভিনেতা রণদীপ। নিউ আলিপুর স্টেশন রোডের কাছে একটি রেস্তোরাঁর সামনে রণদীপের বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের দেওয়ালে ধাক্কা মারে। রণদীপ এবং তাঁর বন্ধু জয়দীপ গুরুতর আহত হন। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশনে ছিলেন রণদীপ। দুর্ঘটনার ঠিক আগে পরিচালক রিঙ্গো তাঁকে নিয়ে ‘মেসি’ নামের একটি ছবি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে রণদীপের অনুপস্থিতিতেই সে ছবি মুক্তি পায়। তারপর থেকেই যাদবপুরের দাদুর বাড়িতেই ছিলেন রণদীপ। নাতির শয্যাশয়ী অবস্থা কেটেছে প্রায় আড়াই বছর। ২০২০ সাল নাগাদ খানিকটা স্বাভাবিক হন রণদীপ। কিন্তু তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থা ভালে নেই খুব একটা।

সৌমিত্রর জীবনে তাঁর পুত্রসন্তানের প্রভাব এবং বাবা হিসেবে তাঁর যন্ত্রণা নিয়েও জল্পনা হয়। সেক্ষেত্রেও অভিনেতার মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিস্তর। এদিকে ১৯৬০ সাল থেকে সংসার জীবনে প্রবেশের পর স্তী, প্রিয় বন্ধু দীপা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংসারজীবন ঠিল অনবদ্য। কিন্তু একটা সময়ে স্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতাও চিন্তা বাড়ায় তাঁর। একদিকে নাতি, অন্যদিকে স্ত্রী আর সংসারের আবহ খুব একটা ভলো রেখেছিল তাঁকে, একথা বলেন না কেউ-ই। এদিকে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু’-র কাছের ছিলেন তাঁর কন্যা পৌলমী। বাবার ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি। একসঙ্গে নাটকে অভিনয় থেকে শুরু করে নানা কাজে একযোগে অংশগ্রহণ, বাবা-অন্ত প্রাণ ছিল তাঁর। সেই পৌলমীর একমাত্র ছেলের পরিণতি ভেঙে দিয়েছিল তাঁর প্রিয় বাবাকে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন অভিনেতা। মেয়ের দুঃখে আরও অবসাদ ঘিরে ঘরে তাঁকে।

একাধিক কাজের মধ্যেই সৌমিত্র আক্রান্ত হন মারণরোগ ক্যানসারে। আকাশ ভাঙে অভিনেতার পরিবারে। একাধিক টানাপড়েন সামলেও রোগজয়ে সচেষ্ট হন তিনি। কিন্তু ক্যানসারের প্রকোপ ব্যতিব্যস্ত করে তোলে তাঁকে। প্রস্টেটের ক্যানসারে আক্রান্ত হন অভিনেতা। কিন্তু শরীরের অসুস্থতা নিয়েও কাজ বন্ধ করেননি তিনি। শোনা যায়, ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলতেন, “কাজ না করলে খাব কী নয়, কাজ না করলে বাঁচব কি?”– এই বাঁচার তাগিদ শুধু নয়, কাজের তাগিদ ঠিল তাঁর মধ্যে বারবার। সৌমিত্র প্রকাশ্যেই একবার বলেন, “যতদিন বেঁচে আছি, যেন কাজ করতে করতেই চলে যায়!’’

অভিনেতা কখনও পিছপা হননি, বরাবর সাহিত্যের আঙিনায়-ও ছিল তাঁর অবাধ যাতাযাত। একের পর এক কবিতা, সাহিত্যের বিশ্লেষণেও ছুঁয়ে গিয়েছেন তিনি। কবিতা-আবৃত্তির কণ্ঠ সৌমিত্রের জনপ্রিয়তার আর একটি কারণও বটে।

অনেকেই বলেন, সৌমিত্র নাকি গম্ভীর স্বভাবের। বরাবর কাজের প্রয়োজন ছাড়া কম কথা বলতেন তিনি। তাঁর স্বভাবজাত এই গুণ হলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে এই ভালো না থাকার চুপকথা বাড়িয়েছিলেন যেন। নানা মনখারাপের গল্পে নিজেকে রাখতেন খানিকটা ভিন্ন করে। তবুও তিনি ছিলেন। ভিন্নতার আলোকে ছিলেন ক্রমশ। সৌমিত্র করোনাকালে ভেঙে পড়েন নাকি আরও। ক্যানসার, আর এক মারণ-ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভ্রুকুটি আর বেঁচে না থাকার একাধিক খবরের ভিড়ে খুব একটা মন ভালো থাকেনি অভিনেতার। একদিকে শুটিং বন্ধ। বাড়িতে অসুস্থ প্রিয়জন, সঙ্গে নিজের অসুস্থতা। দাপুটে অভিনেতাকে বিমর্ষ করে ফের। যে অবহেলার লড়াই তাঁকে করতে হয়েছে বারবার। সেই লড়াইয়ে নতুন করে নামেন পারিবারিক প্রবীণ। অবশেষে বিষাদসিন্ধুতে অবসান হয় এক প্রতিভার। অসময়ে না সময়ে চিরবিদায় ঘটেছে তাঁর একথা প্রাসঙ্গিক না হলেও আরও কিছুদিন কাজেই থাকতে পারতেন তিনি, একথায় উঠে আসে বারবার।

দু’বছর আগে করোনা-আক্রান্ত হন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর করোনা-পরবর্তী জটিলতায় তিনি মারা যান অভিনেতা। দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বাংলা সিনেমার এক সফল অভিনেতা ছাড়াও কবি, অনুবাদক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক ছিলেন সৌমিত্র। ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতার সূর্য সেন স্ট্রিটে জন্ম হলেও ছোটবেলার প্রায় ১০ বছর নদিয়ার কৃষ্ণনগরে কাটে তাঁর। তাঁদের আদিবাড়ি ছিল অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছের কয়া গ্রামে। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। হাওড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন ও পরে বাংলা নিয়ে করেন স্নাতক। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন বরাবরের মেধাবী সৌমিত্র।

কৃষ্ণনগরের বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশে সৌমিত্রের অভিনয় ও আবৃত্তিশিক্ষার শুরু। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক প্রবাবিত করতে থাকে তাঁকে। পরে অহিন্দ্র চৌধুরীর সৃষ্টি মোহিত করে সৌমিত্রকে। কলেজ জীবনেই তাঁর মঞ্চ অভিনয়ের শুরু। একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুড়ির নাটক দেখার সুযোগ হয় তাঁর। সেই অভিজ্ঞতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৫৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে। বহু প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে তাঁর। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি জাঁদরেল এই অভিনেতাকে। প্রথম ছবিতেই দেখিয়ে দেন আসল রূপ। যদিও তখনও জীবনের লড়াই তাঁকে করতেই হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে অভিনয় করে জনমানসে হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রিয় ‘ফেলুদা’। সত্যজিৎ রায়ের ২৮টি কাহিনিচিত্রর ১৪টিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র।

পরবর্তীতে মৃণাল সেন, অজয় কর, তপন সিংহর মতো পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেন। ৬০ বছরের অভিনয় জীবনে প্রায় ৩০০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সঙ্গে সাহিত্য-নাটকের আঙিনায় তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। রেডিওর ঘোষক হিসেবে কাজ তাঁর জীবন চালিত করে নয়া পথে। ‘এক্ষণ’ নামে সাহিত্য এবং সংস্কৃতি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন এই অভিনেতা। ছিলেন বামমনস্ক। রাজ্যের বামনেতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের একাধিক কাজের সমালোচনাও করেছেন সৌমিত্র। এছাড়াও ১৪টি কবিতার বই লিখেছেন। সঙ্গে নানা বিষয়ের একাধিক লেখাও ছিল তাঁর সাহিত্যের ঝুলিতে। তাঁর লেখা গ্রন্থ শ্রেষ্ঠ কবিতা, মানিকদার সঙ্গে, চরিত্রের সন্ধানে, প্রতিদিন তব গাঁথা, শব্দরা আমার বাগানে, মধ্য রাতের সংকেত, পরিচয়, নাটক সমগ্র-১, নাটক সমগ্র-২। অভিনয়ের জন্য অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২০১৭ সালে তিনি ফ্রান্স সরকারের দেওয়া ‘লিজিওন অব অনার’-এ ভূষিত হন, যে পুরস্কার একসময় পেয়েছেন তাঁর গুরু সত‍্যজিৎ রায়। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পদ্মভূষণ সম্মান, সংগীত নাটক আকাডেমি পুরস্কার এবং ভারত সরকারের দেওয়া সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র খেতাব ‘দাদাসাহেব ফালকে’-ও অর্জন করেন তিনি।

More Articles