বাঘের নিরাপদভূমি গড়তে চেয়েছিলেন ভারতকে! বাল্মীক থাপারকে কেন ভুলবে না দেশ
Valmik Thapar: সংরক্ষণবাদী বাল্মীক থাপার বিশ্বাস করতেন যে সুরক্ষিত এলাকাগুলি মানুষের অলঙ্ঘনীয় হতে হবে; সেখানে কোনওভাবেই মানুষের প্রবেশ ঘটানো যাবে না।
বাঘের সংরক্ষণ, বাঘের বৃদ্ধির জন্য সঠিক পরিবেশ গড়ে তোলা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে মানুষটি কাজ করে গেছেন, ভারতের অন্যতম সেই ব্যাঘ্র সংরক্ষণবাদী, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ৩০টিরও বেশি বইয়ের লেখক বাল্মীক থাপার সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তবে এই দেশে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ নিয়ে যে চিন্তার বীজ তিনি বুনে দিয়ে গেছেন, সেই বৃক্ষের ফলেই সমৃদ্ধ হচ্ছে আগামীর পরিবেশ চেতনা।
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, রণথম্বোর টাইগার রিজার্ভ এবং জাতীয় উদ্যানের প্রাক্তন উদ্যান পরিচালক ফতেহ সিং রাঠোরের তত্ত্বাবধানেই প্রথম বাঘের প্রতি বাল্মীক থাপারের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এই জাতীয় উদ্যানে নিজের বেশিরভাগ সময় বাল্মীক কাটিয়েছেন, তিনি যেসব বাঘকে ভালোবাসতেন, তাদের উপর নজরদারি, পর্যবেক্ষণ এবং তাদের নিয়ে পড়াশোনা করার জন্যই। রাজস্থানের সাওয়াই মাধোপুরে বাঘ সংরক্ষণের জন্য ফতেহ সিং রাঠোর প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক সংস্থা টাইগার ওয়াচের সঙ্গেও কাজ করেছেন বাল্মীক।
১৯৮৭ সালে, বাল্মীক থাপার ওই জাতীয় উদ্যানের আশেপাশের স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে রণথম্বোর ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশনটি গ্রামে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের মতো বেশ কয়েকটি কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করেছিল যাতে মানুষকে জ্বালানি কাঠের জন্য বনে যেতে না হয়, যাতে বনে গিয়ে বাঘের মুখোমুখি না পড়তে হয়।
বাল্মীক থাপার সারা জীবনে প্রায় ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন। যার মধ্যে রয়েছে টাইগার্স: দ্য সিক্রেট লাইফ (১৯৮৯), দ্য লাস্ট টাইগার (২০০৬) এবং লিভিং উইথ টাইগার্স (২০১৬)-এর মতো অমূল্য সব রচনা। লেখক এবং সংরক্ষণবাদী হওয়ার পাশাপাশি বাল্মীক থাপার একজন দক্ষ চলচ্চিত্র নির্মাতাও ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বিবিসি-র সিরিজ ল্যান্ড অফ দ্য টাইগার-এ নিজস্ব ব্যারিটোনে কথকের ভূমিকায় কাজ করেছিলেন বাল্মীক।
গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাঘ সংরক্ষণের পক্ষে কাজ করেছেন বাল্মীক। ১৫০ টিরও বেশি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত সরকারের কমিটির অংশ ছিলেন তিনি, যার মধ্যে রয়েছে টাইগার টাস্ক ফোর্স - যা তৎকালীন ইউপিএ সরকার কর্তৃক গঠিত হয়েছিল, সারিস্কা টাইগার রিজার্ভ বাঘশূন্য হয়ে যাওয়ার পর। এর সদস্য হিসেবে ২০০৫ সালে বাল্মীককে নিযুক্ত করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন- ভারতে ঘন জঙ্গলে বাঘের প্রথম ছবি তুলেছিলেন কে?
প্রজেক্ট টাইগার যেভাবে পরিচালিত হয়েছিল এবং বাঘ সংরক্ষণের পথে আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলি যেভাবে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন বাল্মীক থাপার। সংরক্ষণবাদী বাল্মীক থাপার বিশ্বাস করতেন যে সুরক্ষিত এলাকাগুলি মানুষের অলঙ্ঘনীয় হতে হবে; সেখানে কোনওভাবেই মানুষের প্রবেশ ঘটানো যাবে না। সত্যিকার অর্থে বাঘ সংরক্ষণ করতে গেলে এই এলাকাগুলি থেকে মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে।
বাল্মীক থাপারের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, বিপজ্জনক বাঘগুলিকে হয় নির্মূল করতে হবে অথবা পার্ক থেকে সরিয়ে নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বাল্মীক অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, রণথম্বোরের একটি পুরুষ বাঘ T-24 ভয়ানক বিপজ্জনক ছিল। বনরক্ষী সহ অনেক মানুষকেই হত্যা করেছিল এবং আংশিকভাবে এই শিকারদের খেয়েও ফেলেছিল সেই বাঘটি।
আফ্রিকা সম্পর্কে চারটি সহ মোট ৩২টি বইয়ের লেখক, ১৬টি আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্রের উপস্থাপক এবং একজন চমৎকার বক্তা বাল্মীক থাপারের তীব্র প্রতিভাই ভারত এবং বিশ্বকে বাঘের গুরুত্ব, এর দুর্দশা এবং সংরক্ষণের তাগিদ স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল।
বাঘ বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ বাল্মীক থাপার কখনই সরকারি সংরক্ষণের ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারেননি। দীর্ঘদিন ধরে নানা কমিটিতে থাকার পর তাঁর নিবিড় জ্ঞানই হয়তো তাঁকে বলতে বাধ্য করেছিল যে, "গুলিতে যত না বাঘ মরেছে, আমলাতন্ত্র তার চেয়ে বেশি বাঘ হত্যা করেছে।"