ভয়াবহ বন্যায় অস্তিত্বের সঙ্কটে তাজমহল, ৪৫ বছরে প্রথম সৌধ ছুঁল যমুনার জল

Tajmahal Yamuna River Flood: বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে যমুনার জল। ইতিমধ্যেই সে ছুয়ে ফেলেছে লালকেল্লা ও তাজমহলের মতো পৃথিবীর তাবড় দুই ঐতিহাসিক সৌধকে।

চিরন্তন প্রেমের স্থাপত্য তাজমহল। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য, যে শ্বেতশুভ্র স্থাপত্যের দৌলতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও একটু জাতে ওঠে দেশ, স্বাভাবিক ভাবেই দুধসাদা তাজমহলে কাদা লাগা বারণ। অথচ ৪৫ বছর পরে সেই শুভ্র তাজমহলের দেওয়াল ছুঁয়ে দিল কালো যমুনার জল।

যমুনা নদীর এক পাড়ে প্রিয় মমতাজের স্মৃতিতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন মোগল সম্রাট তাজমহল। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম, শ্বেতপাথরের এই স্থাপত্য দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। তার রূপের ছটায় মুগ্ধ হন। যদিও মাঝখানে তাজমহলে আদৌ তাজমহলই আছে, নাকি মুঘল আমলের তলায় আদতে চাপা পড়ে গিয়েছিল হিন্দু মন্দির তেজো মহালয়া, তা নিয়ে বিস্তর হইচই শুরু হয়েছিল। তবে সম্প্রতি জ্ঞানবাপী মসজিদের যে হাল হয়েছে, বছর তিরিশ আগে বাবরি মসজিদের যে দশা হয়েছে, পৃথিবীর সাত নম্বর আশ্চর্যের সঙ্গে তেমন ছিনিমিনি খেলায় মত দেয়নি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনও পক্ষই। তাই অচিরেই ধামাচাপা পড়েছে সে বিষয়টি।

আরও শুনুন: কী আছে তাজমহলের বিতর্কিত ২২টি ঘরে?

সেই অক্ষুন্ন মর্যাদা তাজমহলের গায়ে এসে ঠেকল কালো যমুনার জল। প্রবল বৃষ্টিতে জলমগ্ন দিল্লি, হিমাচল প্রদেশ-সহ একাধিক রাজ্য। জল বাড়ছে ক্রমশ। বাদ যায়নি যমুনা নদীও। গত সপ্তাহেই লালকেল্লার দেওয়াল ছুঁয়েছিল সে। এবার পালা তাজমহলের। গত ৪৫ বছরে প্রথম বার এমন ঘটনার সাক্ষী রইল আগ্রাবাসী। ১৯৭৮ সালে প্রথম বার যমুনা নদীর জল এসে ঢুকেছিল তাজমহল চত্বরে। তার পর এই ২০২৩ সালে।

সব দিক থেকেই দিল্লি যেন চরম অবস্থানে। যেমন শীত, তেমনই গরম। তার উপর বায়ুদূষণের চোটে দিল্লিতে নিঃশ্বাস নেওয়া দুরহ। প্রায়শই সামনে আসে জল দূষণের ভয়াবহ ছবি। সাদা ফেনাভর্তি যমুনার ছবি খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেননি এমন মানুষ বিরল। প্রকৃতি যেন সব দিক থেকে কোণঠাসা করে রেখেছে দিল্লিকে। এবার প্রবল বৃষ্টির মুখে পড়েছে বহু পুরনো এই শহরখানা। দিন কয়েক ধরেই লাগাতার বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত দিল্লি। দিল্লির রাজঘাট এবং তার সংলগ্ন এলাকায় ফুঁসছে যমুনার জল। মাঝখানে একদিন জলস্তর কিছুটা নামলেও ফের বৃষ্টিতে বাড়তে থাকে জলস্তর। যতদূর জানা যাচ্ছে, বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে যমুনার জল। ইতিমধ্যেই সে ছুয়ে ফেলেছে পৃথিবীর তাবড় দুই ঐতিহাসিক সৌধকে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে প্রতিদিন একটু একটি করে গলে যাচ্ছে হিমবাহ। যার ফলাফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আপামর বিশ্ববাসী। বাড়ছে গরম। তারই সঙ্গে বাড়ছে বন্যা পরিস্থিতি। এই ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে একের পর এক শহর, জনপদ। আর এ সব কিছুর পিছনেই অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণ যে আদতে কতটা ভয়ানক, তা হাড়ে হাড়ে জানে দিল্লিবাসী। প্রতিবছর শীতকালে কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় গোটা শহর। পরিবেশ দূষণের জেরে কঠিন হয়ে পড়ে শহরে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া। আর এবার দিল্লিবাসীর দিকে লাল চোখ দেখাচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি।

সাম্প্রতিক বন্যায় ইতিমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে দশেরা ঘাট ও তার সংলগ্ন এলাকা। প্লাবিত উদ দৌলার সমাধিস্থল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। এমনকী রামবাগ, জোহরাবাদ, মেহতাব বাগ এবং চিনা কা রৌজার মতো স্মৃতিস্তম্ভও জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা গিয়েছে। যদিও ভারতের পুরাতত্ব সর্বেক্ষণ বা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত জলের জেরে স্মৃতিস্তম্ভগুলির কোনো ক্ষতি হয়নি। জল ঢোকেনি তাজমহলের বেসমেন্টেও। যদিও তাজমহল সংরক্ষণের ভারপ্রাপ্ত এএসআই কর্তার দাবি, বন্যার প্রবল জলোচ্ছ্বাসেও তাজমহলের মূল স্মৃতিসৌধের ভিতরে জল ঢোকার কোনও আশঙ্কা নেই। বানানোর মধ্যেই ছিল সেই দুর্দান্ত কৌশল। ১৯৭৮ সালে যখন জলস্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাজমহল ছুঁয়ে ফেলেছিল যমুনা, সেবারও ভিজেছিল কেবল তাজমহলের পিছনের দেওয়াল। সে বছর যমুনার জলস্তর ছুঁয়েছিল ২০৭.৪৯ মিটার। এ বছর বন্যা শুরু হতে না হতেই সেই রেকর্ড ভেঙেছে। গত বৃহস্পতিবার যমুনার জলস্তর ছুঁয়ে ফেলে ২০৮.৬৬ মিটার।

অক্লান্ত বৃষ্টিতে জলমগ্ন আগ্রা, মথুরা-সহ উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির আশপাশের একাধিক এলাকা। ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় নামানো হয়েছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, পুলিশ। যমুনার তীরবর্তী এলাকার ৫০টি গ্রাম ও ২০টি শহর থেকে পাঁচশোরও বেশি বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগ্রা ও মথুরায় ডুবে গিয়েছে অসংখ্য কৃষিজমি। জায়গায় জায়গায় দেখা গিয়েছে পানীয় জলের জন্য হাহাকার।

প্রিয় স্ত্রীর স্মৃতিতে এই সৌধ বানিয়েছিলেন মোঘল সম্রাট শাহজাহান। কথিত আছে, তাজমহল বানানোর পর মিস্ত্রিদের একটি করে আঙুল কেটে নিয়েছিলেন সম্রাট। এমন স্থাপত্য যেন আর একটাও তৈরি হতে না পারে বিশ্বে। যমুনা নদীর পাশে ওই শ্বেতশুভ্র তাজমহলের ভিতরেই চিরঘুমে শাহজাহান-পত্নী মমতাজ। শাহাজাহানের মৃত্যুর পর তাঁকেও কবরস্থ করা হয় ওই তাজমহলে, মমতাজের পাশাপাশি। তবে কেউ কেউ বলেন, তেমন ইচ্ছা নাকি ছিল না শাহাজাহানের। বরং যমুনার অপর পাড়ে নিজের জন্য় কৃষ্ণপাথরের তৈরি আরেকটি তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখানেই চিরঘুমে আচ্ছন্ন হতে চেয়েছিলেন শাহজাহান। তবে সেই স্বপ্ন শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি আর।

আরও শুনুন: তাজমহল বনাম তেজো মহালয় || কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে

প্রকৃতি যেভাবে ভ্রুকুঞ্চিত করছে, আগামী কয়েক দশকে দিল্লি-আগরার মতো শহরগুলির অস্তিত্ব থাকবে কিনা, সে নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছেন অভিজ্ঞরা। ভয়ঙ্কর দূষণের প্রকোপ, অতিরিক্ত গরম-অতিরিক্ত ঠান্ডা, তার উপরে এই ভয়াবহ বন্যা। কিছুদিন আগেই তাজমহলের পিছনে পড়েছিল একদল হিন্দুত্ববাদী। শুধু তাজমহলই কেন, মোঘল আমলে তৈরি বহু সৌধ, মসজিদ, দরগা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তারা। এক তাজমহল সামলাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, দ্বিতীয় তাজমহল থাকলে কী হত বলা কঠিন।

More Articles