প্লেনে দু'জনে দাঁড়িয়ে গল্প করেছিলাম, অপর্ণার মতো বন্ধু হয় না
একবার উড়ানে দেখা হলো অপর্ণার সঙ্গে। একেবারে অপ্রত্যাশিত দেখা হওয়া। দু'জনেই যাচ্ছি আমেরিকায়। অপর্ণা বিজনেস ক্লাস। আমি সাধারণ শ্রেণি। আমরা ক্লাসলেস হয়ে স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম। এই অপর্ণাকে কোনওদিন ভুলব না।
অপর্ণা, মানে অপর্ণা সেন, আমার অনেক দিনের বন্ধু। তবে একটা রোম্যান্টিক দূরত্বও মাঝখানে রেখে দিয়েছি। বেশ লাগে আমার এই মধুর দূরত্ব। এখনও অপর্ণার হাত ধরলে ভেতরে একটা তরঙ্গ তৈরি হয়। ওই তরঙ্গটার ভারি প্রয়োজন জীবনে। অপর্ণার সঙ্গে যতটুকু সময় কাটিয়েছি, নিঃসাড় সময় একটিবারও নয়। ঢেউ উঠছেই। আমি কি অপর্ণার প্রেমে পড়েছিলাম? এই প্রশ্নের সহজ এবং সত্য উত্তরটা হলো, ওই তরঙ্গ, ওই ঢেউ, ওই সাড়াটাই সব। অর্থাৎ, প্রেমে 'পড়েছিলাম' না। পাস্ট টেন্স নয়। নয় ঠান্ডা অতীত। প্রেমে পড়েই আছি।
এক সময় প্রায় রোজ অপর্ণার সঙ্গে দেখা হতো। তখন অপর্ণা সেন আমার বন্ধু থেকে বস। অপর্ণা 'সানন্দা'-র সম্পাদক। আমি সহ-সম্পাদক। আনন্দবাজার থেকে প্রকাশিত 'সানন্দা'-তে একেবারে পত্রিকার সূচনা পর্ব থেকেই আমরা দু'জনে কাজ করেছি। এই রোজ দেখা হওয়াটা আমার ভালো লাগত না। ভয় ঢুকল মনে। আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না তো? কিংবা বন্ধুত্ব থেকে সরে যাবে না তো ওই মধুর দূরত্বের রোমান্স? এসব আমার মনের কথা, একান্ত ব্যক্তিগত। অপর্ণাকে এই মনের কথার হদিশ দিইনি।
কিন্তু 'সানন্দা'-য় অপর্ণাকে নতুনভাবে, নতুন আলোয়, নতুন পরিসরে পেলাম। সেটাও কম কথা নয় কিন্তু। যেমন, অপর্ণার সঙ্গে অনেক নতুন নতুন ভাবনার আঁচ পুইয়েছি আমি। সেটা কিন্তু 'সানন্দা'-র জন্য কাছে আসা ছাড়া সম্ভব হতো না। অপর্ণার কিছু মৌলিক মনন, ভাবনাচিন্তার পরিচয় পেয়েছি ক্রমাগত। উত্তাপ পেয়েছি অপর্ণার প্রতিবাদী সততার। এবং পরিচয় পেয়েছি অপর্ণার মুক্ত সামাজিক বোধের। অপর্ণার প্রতি আমার অনুরাগে নতুন সংরাগ এসেছে 'সানন্দা'-র পরিবারে। কথাটা একেবারে সত্যি।
'সানন্দা'-র দফতরে সম্পাদক অপর্ণা সেন
আরও পড়ুন: মানহানির মামলার হুমকি দিয়েছিলেন উত্তমকুমার, কী ছিল সেই বিতর্কিত সাক্ষাৎকারে
একটি ব্যাপার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তা হলো অপর্ণার আত্মপ্রত্যয় এবং বিশ্বাসের জোর। আমার নিজের মধ্যে এই বিশ্বাসের জোরটা সবসময় থাকে না। সুতরাং, অনেক ব্যাপারেই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। দোলাচলে বাস করি। অপর্ণা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমার কখনও কখনও মনে হয়েছে, এরকম একজন বন্ধুকে পাশে পেলে ভালো হয়। আমার দোলাচল আমার অনেক ক্ষতি করেছে। হয়তো অপর্ণার পরামর্শ এবং সহজ স্বচ্ছ ভাবনা আমাকে দোলাচলের ক্ষতি থেকে অনেকটাই বাঁচাতে পারত।
অপর্ণা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন
অপর্ণার সঙ্গে কথা বলতে আমার চিরকালই খুব ভালো লেগেছে। তার কারণ, অপর্ণার সততা। অপর্ণার কৌতুকবোধ। অপর্ণার পরিমিতিবোধ। অপর্ণার সাহিত্যবোধ। এবং অপর্ণার সঙ্গ আমার ভালো লাগে আরও যে কারণে, তা হল অপর্ণা সেই বিরল মহিলাদের একজন, যাঁরা কখনওই বোরিং নন।
এবার আরও একটু গভীরে যাই। এবং সাহসেও। অপর্ণার সান্নিধ্য আমি উপভোগ করি ওঁর গাত্রবর্ণের জন্য। ওঁর হাসির জন্য। ওঁর দৃষ্টিপাতের জন্য। ওঁর সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব ও উপস্থিতির মাধুর্যর জন্য।
অপর্ণাকে ভালো লাগার, ভালবাসার আরও অনেক কারণ আছে: ওঁর রুচিশীলতা। ওঁর সাজপোশাক, যাপন, ব্যবহার, প্রাত্যহিকতা, সমস্ত ক্ষেত্রে ওঁর আন্ডার স্টেটমেন্ট। কম বলা। মিতভাষিতা। বাড়িয়ে বলা, কখনওই নয়। এই অপর্ণাকে ভালো না বেসে পারা যায় না।
দু'-একবার অপর্ণা আর আমি ডিনার করেছি একসঙ্গে। সময়টা যে কীভাবে কেটে গেল! খুব কম নারীর সঙ্গে জীবনে এমন হয়েছে।
একবার উড়ানে দেখা হলো অপর্ণার সঙ্গে। একেবারে অপ্রত্যাশিত দেখা হওয়া। দু'জনেই যাচ্ছি আমেরিকায়। অপর্ণা বিজনেস ক্লাস। আমি সাধারণ শ্রেণি। আমরা ক্লাসলেস হয়ে স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম। এই অপর্ণাকে কোনওদিন ভুলব না।
অভিনেত্রী অপর্ণার চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি পরিচালক অপর্ণাকে
অপর্ণা পরিচালিত প্রায় প্রতিটি ছবির প্রথম শোয়ে আমি আমন্ত্রিত হই। অপর্ণাকে কখনও এমন নার্ভাস দেখার সুযোগ পাই না। বেশ লাগে আমার। পাশে দাঁড়াতে। তখন অন্যভাবে ভালবাসি অপর্ণাকে। আমি পরিচালক অপর্ণার ফ্যান। অভিনেত্রী অপর্ণার চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধা এবং অ্যাডোর করি (আদরও করি) পরিচালক অপর্ণাকে। 'থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন' দেখে তো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ছুটে গিয়েছিলাম অপর্ণার কাছে! 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার' ভাবুন ! একে বলে ব্রিলিয়ান্স! 'পরমা'-র মতো ছবি জীবনে সত্যিই কি খুব বেশি দেখেছি?
'পরমা' ছবির পোস্টার
আচ্ছা, 'জাপানিজ ওয়াইফ'- এমন ছবিও হয়! আমাদের দেশে! কেমন যেন কবিতার মতো। আমার অপর্ণা-মুগ্ধতা আরও একবার নতুন মাত্রা ছুঁল 'পারমিতার একদিন'-এ ! ছবিটি নিয়ে আমি লিখেওছি। আমার প্রিয় পরিচালকের ছবিতে প্রিয় নায়িকা ঋতুপর্ণা। ডেডলি সমন্বয়।
'পারমিতার একদিন' ছবির পোস্টার
আর এক ডেডলি সমন্বয় রবীন্দ্রনাথ ও অপর্ণা। সেই সমন্বয় আমি ঘটিয়েছি। তখন একটি নিয়মিত শো করতাম একটি বিখ্যাত টিভি চ্যানেলে। অনুষ্ঠানটির নাম 'আমার রবীন্দ্রনাথ'। অপর্ণা এলেন সেই শোয়ে। এবং রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রাতিম্বিক মননের আলোয়।
নতুন করে অপর্ণাকে ভালো লাগল।
ভালবাসলাম।