চন্দ্রবিন্দু ডট কম: অমৃতা ভট্টাচার্য
Bengali Short Story: এই মনে করো ইডিওলজি, এই মনে করো ব্ল্যাক হোল, এই মনে করো পোলিং বুথ, এই মনে করো কৃষ্ণচূড়া, এই মনে করো গেছোদাদা...
এবার বেশ উৎসাহ পেল চন্দ্রবিন্দু। এবার বোধহয়, একটু হলেও আমাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে ওর!
থাবা দিয়ে আমাকে আলতো করে টেনে বলল, “গেছোদাদার একটা নতুন গল্প বলি শোনো”–
আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, “ওসবে আর মজা পাই না, আমি। তুমি যখন মাটিতে আঁক কষে গেছোদাদার হদিশ জানাতে, তখনও সীমান্তজুড়ে যুদ্ধের স্মৃতি টসটস করত আর্দ্রতায়! অভিমান সজাগ হলে তখনও নির্জন দুপুরে, হাওয়ার গতি এড়িয়ে, কাঁটাতার আঁকড়ে বেঁচে থাকত একটা ফোঁটা! এখন সময় বদলেছে। গেছোদাদা এখন কাছে কাছেই থাকে সবসময়। অ্যালার্মের শব্দে রোজ সকালে দৃশ্যকল্প ছিঁড়ে আমাকে ডেকে তোলে এক ক্লীবখচিত জনারণ্যে! অনেক মুখ, মুখোশ– আলাদা আলাদা! এক নয়– লক্ষ কোটি গেছোদাদা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে। আলো নেই, শব্দ নেই, বোঝা– না বোঝা– কোনওটাই নেই। সিগন্যাল লাল হলে ইশারায় হেলমেট খুলতে বলি ওদের– কত আলাদা– কত চেনা তবু!”
আরও পড়ুন: গোটা শাড়ির গন্ধ: ঋভু চট্টোপাধ্যায়
চন্দ্রবিন্দু খুব বিরক্ত হচ্ছে মনে হলো। মুখ ব্যাজার করে তাকিয়ে রইল অন্য দিকে। পাত্তা না দিয়ে আমি বলেই চললুম, “আমার এই লতানে আঙুলগুলোর– বিশেষত তর্জনীর– যার কোনও লক্ষ্য ছিল না কোনও দিন– ছুঁতে চায় চেনা মুখ– তারপর, ধাক্কা খায় পাতলা কাচে। দেখি, শুধু আমার নয়, অবিকল এক দেখতে, শতসহস্র লতানে আঙুল– কাচ ছুঁয়েছে এখানে! জানো চন্দ্রবিন্দু, ওটার নাম আয়না– আমি বুঝি, আয়নাই ছিল ওখানে… আর যেই না বুঝে ফেললাম… অমনি আয়নাবাজির ভিড়ে– সকাল পেরিয়ে, কাচ ভেঙে শতসহস্র আঙুল সূর্য হয়ে, কুয়াশা ছিঁড়ে আমাকে নিয়ে গেল চকচকে একটা দুপুরে।"
চন্দ্রবিন্দু আমাকে থামিয়ে বলল, “ফের মিথ্যে! প্রমাণ কই? সকালের পর যে দুপুর আসে, তার প্রমাণ চাই।"
আমি মানুষ। বিরোধিতায় মাথার শিরা টনটন করে ওঠাই বেঁচে থাকার লক্ষণ। বললাম, “আলবাত হয়! ডেকে আনো বুড়োকে– সবুজ দাড়ি– কী যেন নাম!– জিজ্ঞেস করো ওকে, আতসকাচের নিচে ঘুমিয়ে থাকে কি না বৃষ্টি-অরণ্য! এগিয়ে দেখো ওই রাস্তা ধরে– ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত– পড়ে যাওয়া পাতা, ভিজতে পারার আগেই বিষাক্ত কামড়ে জ্বলে যাওয়া পাতার শিরা-উপশিরার থালাভর্তি খিদে সাজিয়ে অপেক্ষা করছে গেছোদাদা। উপশিরার রাস্তায় ফিরতি পথে ঝুপড়ি– কারা সব নোটিশ দিয়েছে জায়গা খালি করার– স্টোনচিপ, বালি, খুঁটি পড়ে আছে আকাশছোঁয়া অপেক্ষায়।"
হঠাৎ দেখি চন্দ্রবিন্দুর নজর আমার পকেটের ওপর। সর্বনাশ! বুঝে ফেলেনি তো, আতসকাচটা আসলে আমার পকেটেই আছে? ও বেশ চিন্তায় পড়েছে মনে হলো। বলল, “রাস্তা চিনব কী করে?”
-জিপিএস দেখো।
-দূরত্ব মাপব কীসে? গ্যালন না ফিট?
আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল চন্দ্রবিন্দু।
-কেন? কিলোমিটার তো বেশ চেনা! সেই কবে থেকে মেপে আসছি। আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম।
চন্দ্রবিন্দু ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসতে শুরু করল। মুশকিল! আমি মানুষ। ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল কান। বললাম, “কিছু বলার থাকলে বলো- ফালতু হাসির সময় নেই।“
ও বলল, “তোমার যেমন বুদ্ধি! গেছোদাদা ডানপাশে আছে, না বামপাশে– সামনে না পিছনে– ওপরে না নিচে– গভীরে না চূড়ায়– শিরা, উপশিরা, খিদে– না জেনে মাপবে কী করে? আর সমস্যা তো একটা নয়– গেছোদাদা চেনা হলে দূরত্ব এক, অচেনা হলে আর এক– চেনা না অচেনা বুঝতে না পারলে অন্য আর এক!"
আমি বললাম, "উপায় আছে। মাঝখানে আয়না বসালেই হয়।“
অমনি ওপর থেকে কে যেন বলে উঠল, “উত্তল না অবতল?” চেয়ে দেখি কাক্কেশ্বর। উত্তর না পেয়ে আবার বলল, “আয়নার কাচটা উত্তল না অবতল?”
আমি দুটোর মাঝে তফাত অতটা বুঝি না। বললাম, “অবতল হলে কি সমস্যা?”
-"সেলামি বেশি।“ চন্দ্রবিন্দু বলল।
আমি বললাম, “কীসের সেলামি? নিজেকে দেখব– তাতে আবার সেলামি কীসের?”
চন্দ্রবিন্দু বলল, “আছে আছে! নিজেকে কী দেখতে চাও, সেটা আগে ভাবতে হবে– মন্ত্রী, শুয়োর, ছবি-আঁকিয়ে, পদ্য-লিখিয়ে, মস্তান, মোসায়েব– সব সেলামী আলাদা।"
আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, “ক—" তারপর সামলে নিয়ে বললাম– “বেজায় গরম! তারপর গেছোদাদার বাকি গল্পটা তো শুনলে না।“
চন্দ্রবিন্দু উদাস হয়ে বলল, “বলতে থাকো।”
আমি আবার শুরু করলাম। “তারপর সকাল, সন্ধে, রাত ভরে রাখি যে ব্যাগটায়– সেই ভারী ব্যাগ কাঁধে তুলে গেছোদাদা আমাকে পৌঁছে দেয় বাইপাসের ওপাশে একুশতলায়– রাত সাড়ে আটটা বাজলেই যেখানে তুলোবীজ ভেসে বেড়ায় কফির ফেনায়– কাচের দেওয়াল ঘেঁষে ফুরফুরে শরীর যমজ শরীর খোঁজে ইতিহাস মেনে… আর রাত বাড়তে থাকে কাচের দু'পাশে– দু'দিকে অন্ধকার–”
-রাত মানে অন্ধকার? চন্দ্রবিন্দু বলে উঠল।
-নয়? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম।
চন্দ্রবিন্দু বলল, “আগে দেখতে হবে অন্ধকারটা সুবিধেবাদী, না অসুবিধেবাদী– অনেক অন্ধকার বেজায় সমস্যায় ফেলে, আবার অনেক অন্ধকার দিব্যি মোটাসোটা মই বানিয়ে দেয়– তরতর করে ওপরে উঠলেই হলো!”
আমি বললাম, “যতসব অদ্ভুত কথা– অন্ধকার নাকি মই বানায়!”
চন্দ্রবিন্দু বলল, “তোমার অন্ধকার আমার মই, আমার অন্ধকার তোমার মই– এ তো হামেশাই হচ্ছে। সব হিসেব অবশ্য আলাদা আলাদা। মেলা উদাহরণ পাবে।“
কাক্কেশ্বর বলল, “আমি একদিন বলে ফেলেছিলাম, 'বাঁচতে চাই'। গেছোদাদা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল আশ্চর্য সব মেলায়। বিনা পয়সায় রঙিন বুদবুদ, মুনিয়া আর ম্যাজিক পাওয়া যায় রাস্তার দু'ধারে। ওখানে অবশ্য হাততালিও কিনতে পাওয়া যায়। যেমন হাততালি তেমন দর।"
মনে হলো, এটা বেশ ঝুঁকিসম্পন্ন আলোচনা। প্রসঙ্গ পরিবর্তন দরকার। এদিকওদিক তাকিয়ে বললাম, “বাগানের বেড়াটা কি একইরকম আছে এখনও?”
-কোন বেড়া? চন্দ্রবিন্দু যেন খিঁচিয়ে উঠল।
আমি বললাম, “সে কী? একটাই তো বেড়া ছিল এখানে!"
কাক্কেশ্বর বলল, “অঙ্ক কিছুই জানো না দেখছি! ওখানে একটা বেড়া দেখলে যে বড়! ওখানে স্মৃতিগণিত যোগ দিতে হবে।"
আমি ভাবলাম, এই বুঝি আমার অঙ্ক না-জানা ধরা পড়ে গেল। ছটফট করে বললাম, “হ্যাঁ মনে রাখতে পারলেই হয়।"
কাকেশ্বর বলল, “এত সহজ নয়। যতবার বেড়া দেখবে, যতগুলো বেড়া দেখবে, তার সঙ্গে যোগ করে তারপর যতবার সেই যতগুলো বেড়া মনে পড়বে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করে তারপর সেই আংশিক মনে পড়ায় যা যোগ হল আর যা বাদ হল তা, একসঙ্গে যোগ করে তারপর ত্রৈরাশিক উপায়ে..."
আমি বললাম, “এ বড় অন্যায়! খামোকা হিসেব জটিল করা।"
চন্দ্রবিন্দু বলল, “তা কেন– সহজ করেও ভাবা যায়–”
আমি বললাম, “কী করে?”
কানটা একটু চুলকে চন্দ্রবিন্দু বলল, “তিনদিক খোলা আর বাকি দিক বন্ধ রাখলেই হয়।“
আমি বললাম, “বাকি সাতদিকের কী হবে?” চন্দ্রবিন্দু বলল, “সাত কেন– সত্তর হলেও সমস্যা নেই।“
আমি বললাম, “সত্তর কোথায়?”
চন্দ্রবিন্দু বলল, “ওই যে দৃশ্যকল্পে– সাতাত্তর হতে পারে– সাতহাজার কোটি হতে পারে– যে যত ভাবতে পারে।“
আমি বললাম, “তিনদিকের হিসেবটা কি যেন ছিল?”
চন্দ্রবিন্দু বলল, “একদিকে তুমি, একদিকে আয়না, আর একদিকে..."
মাঝপথে থামিয়ে কাক্কেশ্বর হাউমাউ করে বলে উঠল, “তোমাদের দেশে তো আর তিন দিয়ে গুণ করা যাচ্ছেনা। তিনের ভয়ানক মাগ্যি– বাড়তি কোথায় যে গুণ করবে?”
চন্দ্রবিন্দু বলল, “বাড়তি নয় কেন? এতগুলো যে তৃতীয় চক্ষু– সত্যি ধরছে, সত্যি মারছে, সত্যি বানাচ্ছে।"
আমি বললাম, “কক্ষনও না, গায়ের জোর নাকি? সব হিসেবমতোই হচ্ছে।“
চন্দ্রবিন্দু বলল, “কী করে?”
ওর হাত থেকে পুরনো কাঠিটা নিয়ে মাটির ওপর একটা আঁচড় টেনে বললাম, “এই মনে করো মিথ্যে...”
আবার আঁচড়, আবার আঁচড়–
-এই মনে করো ইডিওলজি, এই মনে করো ব্ল্যাক হোল, এই মনে করো পোলিং বুথ, এই মনে করো কৃষ্ণচূড়া, এই মনে করো গেছোদাদা, এই মনে করো খাবার নেই, জল নেই, শিক্ষা নেই, মানুষ মরছে, মানুষ বাঁচছে, মানুষ কাঁদছে, মানুষ হাসছে, মানুষ ভাবছে, মানুষ মানুষ মানুষ মানুষ…
চন্দ্রবিন্দু আমার থেকে একটু সরে গিয়ে সোজা হয়ে বসে গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ও কি ভয় পেল? মানুষের কথা বললাম বলে? এতবার ‘মানুষ’ উচ্চারণ করলাম বলে? শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কে যে ভয় পেল!
-গেছোদাদা কোথায় একবার জানতে পারলেই কেল্লা ফতে! কাকেশ্বর বলতে বলতে ফটাফট ডানা ঝাপটে উড়ে গেল।
শুকনো জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বললাম, “এভাবে হবে না। চোখ বন্ধ করো– হিসেব গুলিয়ে যাবে না হলে।"
চন্দ্রবিন্দু কী বুঝল, কে জানে! ঝুপ করে চোখদুটো বন্ধ করে কান খাড়া করে থাকল।
কাঠিটা তুলে কাঁপা কাঁপা হাতে মাটিতে আর একটা আঁচড় কেটে বললাম, “এই মনে করো কবি..."
পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার! বুঝলাম আর স্পর্ধা নেই ওর সামনে দাঁড়ানোর। কাঠিটা মাটিতে ফেলে আমি পা টিপে টিপে পিছু হঠতে লাগলাম– পৌঁছে গেলাম বেড়ার কাছে। তখনও চোখ খোলেনি চন্দ্রবিন্দু। হয়তো মানুষ নয় বলে সন্দেহ আসেনি ওর মনে। হয়তো মানুষ নয় বলেই ওর এখনও বিশ্বাস আছে বিশ্বাসে।
আতসকাচটা এখনও আমার হাতে। চন্দ্রবিন্দুর দিকে চোখ রেখে আমি সন্তর্পণে পেরিয়ে যাচ্ছি একটা একটা বেড়া… প্রত্যেক মুহূর্তে…