'প্রেম অতি হাস্যকর বস্তু', কেন এমনটা মনে করতেন রাজশেখর বসু
Rajsekhar Basu: রাজশেখর বসুর প্রেমের গল্পে নানা-কৌশলে পুরনো ভারতের প্রসঙ্গ উঠে আসে।
যতীন্দ্রমোহন সিংহ ‘সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা’ নামে একটি মোক্ষম বই লিখেছিলেন। তখনও হিন্দি গানের দৌলতে ‘লাভেরিয়া’ শব্দটি বঙ্গদেশে জনপ্রিয় হয়নি। তবে ম্যালেরিয়া, হিস্টিরিয়ার মতো প্রেম যে রোগবিশেষ সে বিষয়ে ১৯১৯ সালে যতীন্দ্রমোহন সিংহ নিশ্চিত। যতীন্দ্রমোহন সিংহ লিখেছিলেন,
আমার বোধ হয় কলেরা প্লেগ বসন্তের বীজ অপেক্ষাও এই প্রেমের বীজ সমাজশরীরে অধিকতর মারাত্মক। প্রেমের বীজ বলিলাম, শুনিয়া কেহ হাসিবেন না। পাশ্চাত্য দেশের কোন বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিত কলেরা বসন্ত প্রভৃতি রোগের বীজের (germ) ন্যায় প্রেমেরও (love) একটা germ আবিষ্কার করিয়াছেন।
এই প্রেমের জার্ম থাকে কোথায়? সিংহমশাই খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন সে জার্ম থাকে বাঙালির লেখা উপন্যাসে– বিধবার প্রেম, সধবার প্রেম, বারবণিতার প্রেম বাংলা গল্প-উপন্যাসে তখন ছড়াছড়ি যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র কেউ বাদ নেই। ফলে সামাজিক নর-নারীর মনের স্বাস্থ্য বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
যতীন্দ্রমোহন সিংহের এই লেখা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাহিত্য’ পত্রে, পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ পড়ে খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। সুরেশচন্দ্র তাই যত্ন করে প্রকাশ করেছিলেন যতীন্দ্রমোহনের লেখা। বিশ শতকের দুয়ের দশকের তখন শেষ। পরের দশকেই প্রকাশিত হবে ‘কল্লোল’। কন্টিনেন্টাল সাহিত্যপড়া যুবকেরা রবীন্দ্র-সাহিত্য ধারার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রেমের নতুন নতুন রকম আমদানি করলেন, বাংলা সাহিত্যে গেল-গেল রব উঠল। এরই একটু আগে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে রাজশেখর বসু পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর প্রথম গল্প ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ প্রকাশ করলেন। রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০) রসায়নবিদ। মনোবিদ গিরীন্দ্রশেখর বসুর সহোদর। সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। যুক্তিনিষ্ঠ মানুষটির মন রসোজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যে প্রেমের এই রকমফের নিয়ে হই-হট্টগোল নিবিষ্ট চিত্তে অনুধাবন করছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য সাহিত্যে যেমন প্রেমের বিচিত্র গতি তেমনি ভারতীয় সাহিত্যেও যে প্রেম বহুবর্ণ সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য থাকার ফলে তা জানতেন। শুধু জানতেনই না বেঙ্গল কেমিক্যালের ‘গোল্ডেন সান্ডেলউড’-এর বাক্সের গায়ে রাজশেখর বসু পরিকল্পিত যতীন্দ্রকুমার অঙ্কিত লাস্যময়ী ললনাদের ছবিতে প্রাচীন তপোবনরমণীর মূর্তির ব্যবহার যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন প্রাচীন ভারতের রূপমাধুরীকে আধুনিক ভারতের বিপণন বিদ্যায় কাজে লাগাতে তিনি দ্বিধা করেননি। পুরনো ভারত কেবল নিবৃত্তির নয়, প্রবৃত্তিরও। নিবৃত্তির মতো প্রবৃত্তিও অনুসরণযোগ্য মার্গ। চতুর্বর্গের মধ্যে অর্থ ও কামকেও ভারতবর্ষ সমর্যাদায় স্থান দিয়েছে। তাই তাঁর প্রেমের গল্পে নানা-কৌশলে পুরনো ভারতের প্রসঙ্গ উঠে আসে।
তাঁর প্রথম গল্পের বই 'গড্ডলিকা'। সেই বইতে প্রেমের গল্প দু'টি। বই পড়ে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ। জানিয়েছিলেন, ‘লেখার দিক হইতে বইখানি আমার কাছে বিস্ময়কর...’ এই বিস্ময়কর বইটির শেষ গল্প ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’। সে গল্পে পরশুরাম যতীন্দ্রমোহন সিংহের নাম নিয়েছেন। গল্পটি ইহলোকের নয়, পরলোকের। ভুশণ্ডীর মাঠে ‘শিবুর তিনজন্মের তিন স্ত্রী এবং নৃত্যকালীর তিনজন্মের তিন স্বামী’ একসঙ্গে হাজির। পরশুরামের প্রশ্ন ও মন্তব্য,
কে এই উৎকট দাম্পত্য সমস্যার সমাধান করিবে? আমার কম্ম নয় ... শ্রীযুক্ত শরৎ চাটুজ্যে, চারু বাঁড়ুজ্যে, নরেশ সেন এবং যতীন সিংহ মহাশয়গণ যুক্তি করিয়া একটা বিলি-ব্যবস্থা করিয়া দিন...
পরশুরামের গল্পে উৎকট দাম্পত্য সমস্যা ও প্রেম সমস্যার ছড়াছড়ি। 'কল্লোল', 'কালি-কলম', 'প্রগতি'-র মতো সাময়িকপত্রে দাম্পত্য ও প্রেম বিষয়ে তরুণ লেখকরা যা গম্ভীর বয়ানে লেখেন, তাই পরশুরাম লেখেন সরস বয়ানে। প্রেম বিষয়টির মধ্যে যে অনেক সময় অহেতুক কল্পনাবিলাস ও বিষাদ-বিরহপ্রীতি বড়ো হয়ে উঠে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায় এ-কথা আম পাঠককে বোঝাতে চান তিনি। তবে যতীন সিংহের মতো ভালোবাসার জার্ম-টার্মের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে পাঠক চিত্তকে বিরক্ত-বিরস করে তোলেন না। পরশুরামের প্রকল্পটি অন্যতর। তাঁর সহোদর গিরীন্দ্রশেখর বসু মনোবিদ। ফ্রয়েডের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ। ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বের সূত্রে গিরীন্দ্রশেখর লিখেছিলেন ‘স্বপ্ন’ নামের বই। ফ্রয়েড যে ভিষক তিনি যে নর-নারীর চিত্তবৈকল্য দূর করতে চান সে-কথা অবশ্য বাঙালি লেখকেরা ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁদের যৌনবিলাসে ফ্রয়েড মূল হোতা, ফ্রয়েডের নামের ঢাল ব্যবহার করে বাংলা গল্পে বিচিত্র গূঢ়ৈষা প্রকাশ করেন তাঁরা। পরশুরাম বাঙালির এই ফ্রয়েডিয়ানার প্রলাপ নিয়ে ঠাট্টা করেন। গল্পটির নাম ‘নিরামিষাশী বাঘ’। এক রায়বাহাদুরের শখ হলো তিনি নিরামিষাশী ব্যাঘ্র সম্প্রদায় তৈরি করবেন। সুতরাং, এক খাঁচায় বাঘ ও আরেক খাঁচায় বাঘিনী বন্দি হলো। মাংসের বদলে তাদের খেতে দেওয়া হল শাক-পাতা। প্রথম প্রথম না খেলেও প্রাণের দায়ে তারা নিরামিষ খেতে শুরু করল। একদিন রায়বাহাদুর ভাবলেন, এবার এই নিরামিষাশী বাঘ-বাঘিনীকে এক খাঁচায় ঢোকালেই কেল্লা ফতে। তাদের মিলনে জগতে নিরামিষাশী ব্যাঘ্র সম্প্রদায় থৈ থৈ করবে। সে আশা অবশ্য পূর্ণ হলো না। গল্পের শেষটি মোক্ষম। একই খাঁচায় নিরামিষখেকো বাঘ আর বাঘিনী। তারা কিন্তু মোটেই যৌনলীলায় লিপ্ত হলো না। তার বদলে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ের মাংস খুবলে নিল। এ বাঘেদের ক্যানিবলিজম। পরশুরামের মন্তব্য,
ফ্রয়েডের শিষ্যরা যাই বলুন, প্রাণীর আদিম প্রেরণা ক্ষুৎপিপাসা। রামখেলাওন আর রামপিয়ারী হিংস্র শ্বাপদ, নামের আগে রাম যোগ করে এবং অনেক দিন নিরামিষ খাইয়েও তাদের স্বভাব বদলানো যায় নি।
পরশুরামের লেখা পড়লে বোঝা যায়, প্রেম জিনিসটিকে তিনি দৈবী, চিরায়ত ইত্যাদি ভাবার চেষ্টাই করছেন না। তাঁর মতে প্রেমের নানা রূপ ও নানা মুহূর্ত। শরীর বদলায়, মন বদলায়। শরীর-মন বদলে বৃদ্ধরা নতুন কালের প্রেম কেমন তা চাখার কথা ভাবতেও পারেন। ‘ধুস্তুরী মায়া’ গল্পে জলে ডুব দিয়ে বুড়ো থেকে তুলনায় ছোকরা হওয়া গেল কিন্তু নতুন প্রেম সইল না। স্পন্দচ্ছন্দার কাঁচপোকা নৃত্য উদ্ধবের হজম হলো না, তার পুরনো কালিদাসীই ভালো। পরশুরাম দেখান, একজনের কাছে প্রেমবিলাস ও বিরহ চূড়ান্ত বলে প্রতিভাত হলে অপরের কাছে তা নাও হতে পারে। আবার যিনি ভাবছেন, প্রেমে দাগা খেলেন তিনি এমন অবস্থায় পড়তে পারেন, যা বুঝিয়ে দেবে তাঁকে দাগা খাওয়া আসলে দাগা খাওয়া নয়- তা কল্পনা।
'উপেক্ষিতা’ গল্পের প্রেমিকা বর্ষার দিনে প্রেমিককে সহসা দ্রুত চলে যেতে দেখে যখন বিরহ-ব্যাকুল ও হতাশ তখনই সত্য উন্মোচিত হলো। যে চেয়ারখানি ছেড়ে গিয়েছেন প্রেমিক সেখানে বিরহকাতরা উপবেশন করে প্রকৃত কারণ টের পেলেন– ছারপোকা, ছারপোকা। ক্লাইম্যাক্সে যা ঘটার কথা ঘটছে, তার ঠিক বিপরীত– কল্পরাজ্য থেকে বাস্তবে পতন। প্রেমের গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে পরশুরামের বিজ্ঞানবুদ্ধি গাণিতিক কলাকৌশলের প্রয়োগ ঘটাতে পিছপা হয় না। ‘প্রেমচক্র’ গল্প তার মোক্ষম প্রমাণ। সাময়িক পত্রে ‘পঁচিশজন নামজাদা লেখকের সঙ্গে কনট্রাক্ট’ সম্পন্ন। পাঁচটা সোজা প্রেম, দশটা বাঁকা প্রেম, চারটে লোমহর্ষণ। প্রথম সংখ্যা প্রায় ছাপা শেষ। শেষ ফর্মার গল্প আসেনি। সেই গল্প ‘প্রেম চক্র’। বাঁকা-সোজা-লোমহর্ষণ কোনওটাই নয়– সে গল্প অমীমাংসিত ঘূর্ণাকার প্রেম। কুশীলব তিন ছেলে তিন মেয়ে। নামগুলি সত্যযুগীয় – হারিত, জারিত আর লারিত তিনজন ছেলে। সমিতা, জমিতা, তমিতা তিনজন মেয়ে। তাদের হৃদয়-সংবাদ কী?
হারিত ভালোবাসে সমিতাকে, কিন্তু সমিতা চায় জারিতকে। আবার জারিত চায় জমিতাকে, অথচ জমিতার টান লারিতের ওপর। আবার লারিত ভালোবাসে তমিতাকে, কিন্তু তমিতার হৃদয় হারিতের প্রতি ধাবমান।
সন্দেহ নেই ভয়ংকর গোলমেলে প্লট, মনে রাখা শক্ত। অঙ্কের ভাষায় এ হলো ‘হোপলেস হেক্সাগন’।
পরশুরাম প্রেমকে হাস্যময় করে তুলছেন কেন? তাঁর হাসি আসলে অ্যান্টিডোট। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যে বাঙালি সাহিত্যিকরা পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়ে নানারকম প্রেমের জোয়ার-ভাঁটায় সাঁতার কাটতে উদ্যত তাঁদের পাশাপাশি পরশুরামের দাওয়াই হলো ‘প্রেম অতি হাস্যকর বস্তু’ একথা প্রতিষ্ঠা করা। প্রশ্ন হলো, এ দাওয়াই নিয়ে আমরা কী করব? এককথায় উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে ভাবা যেতেই পারে পরশুরামের কাছে বাঙালি জীবনের পক্ষে প্রেমের থেকে অন্য অনেক কিছুই গুরুত্বপূর্ণ– তা না বুঝে বাঙালি কাঁচা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। স্বাধীনতার পর খণ্ডিত ভারতেও পরশুরামের কলম সচল। সেই ভারতে রাজশেখর বসু নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন আর পরশুরাম দেখান প্রেমের ‘হোপলেশ’ দশা। পরশুরামের ‘নিরামিষাশী বাঘ’ গল্পটি স্বাধীনতার পর পাঁচের দশকের গোড়ায় লেখা। তখন বাঙালি জীবনে সত্যি যৌনতা ও প্রেমের চাইতে খাদ্য-সংকট গভীর। জীবনের আদি চাহিদা খাদ্য, তা মর্মে মর্মে বোঝা যাচ্ছে।
তবে পরশুরাম পড়তে পড়তে মনে হতে পারে পরশুরামের প্রেম-দাম্পত্য প্রসঙ্গে কোথাও সাবেকি পিতৃতন্ত্রর তুলনায় কম ক্ষতিকর সামাজিক রূপটি গুরুত্ব পাচ্ছে। দাম্পত্যের বিশেষ উপযোগবাদী চেহারা তাঁর রচনায় এক দিক দিয়ে আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। তবু হাসিটি চেপে রাখা অসম্ভব। সামাজিক দিক দিয়ে তিনি ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ কি না সে প্রশ্ন মুলতুবি রেখে হাসতে ইচ্ছে করে। পরশুরাম প্রেমকে নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান– প্রেমের নানা রূপের হাস্যকর সংজ্ঞা দেন। প্লেটোনিক প্রেম কী? পরশুরাম লেখেন,
প্লেটনিক লভ বা রজকিনী প্রেম তারই একটা রকম ফের, যেমন পাহাড়ী রাক্ষুসে লংকা, ঝাল নেই, শুধু লংকার একটু গন্ধ আছে।
‘দ্বান্দ্বিক কবিতা’ গল্পে শংকরী দেবীর প্রেমের কবিতায় পুরুষ শরীরের উন্মুক্ত বিবরণ, ‘সিল্কমসৃণ শ্যাময় লেদার তোমার চামড়া,/ ওই নির্লোম বুকে ঠাঁই চাই ঠাঁই চাই।’ পড়লে রোম্যান্টিকতার সাড়ে-সর্বনাশ।
১৯৬০-এ প্রয়াত হলেন রাজশেখর। স্বাধীনতার ভাঙা-স্বপ্ন তখনও প্রাত্যহিক বাস্তব। তাঁর গল্পে প্রেমের হাস্যকর রূপ এই ভাঙা-সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্তদের অপ্রাপ্তিকে শমিত করত। প্রেমের ঘোরে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চাইতে প্রেমকে হাসির খোরাক করে নিজেকে জাগিয়ে রাখা বাঙালি পাঠকের কাছে তখনও বেশ গ্রহণযোগ্যই ছিল।