বিয়ে মানেই জোড়া ইলিশ! বাংলার সংস্কৃতিতে যেভাবে জড়িয়ে এই মাছ

পদ্মার ইলিশের স্বাদ ভিন্ন কেন? মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় জলের প্রবাহের ধরন আলাদা, যার ফলেই ইলিশের স্বাদেও পার্থক্য থাকে। পদ্মায় সাধারণত তিন রকমের ইলিশ পাওয়া যায়- পদ্মা ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, ও গুর্তা ইলিশ।

...নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস শর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।

বুদ্ধদেব বসুর কলম থেকে উৎসারিত ‘ইলিশ’ কবিতা যেন যথার্থই ইলিশপুরাণ। কলমের এক আঁচড়ে বর্ষার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ইলিশ উৎসবের অনুষঙ্গ।

পাতে ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত আর এক টুকরো ভাজা ইলিশ, সঙ্গে নুন, কাঁচালঙ্কার যোগ্য সঙ্গত। এই সামান্যর স্বপ্নে চিরকাল মশগুল লক্ষ লক্ষ বাঙালি। বর্ষায় খিচুড়ির সঙ্গে ভাজা ইলিশ হোক বা চ‌টজলদি বেগুন দিয়ে ঝোল, ইলিশ-সুখের তালিকা দীর্ঘ। মাছের বাজারে গেলে পকেটে রেস্তো থাকুক বা না থাকুক, তার চকচকে রুপোলি দেহসৌষ্ঠব চোখ টানবেই। আর কড়াইয়ে পড়লেই স্বর্গীয় আঘ্রাণ! চরম খাদ্যে বেরসিকেরও জিভের গোড়ায় জল আসতে বাধ্য। আসলে বাঙালির কাছে ইলিশ কেবল উপাদেয় মাছ নয়, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি।

বাঙালির ইতিহাস, বাণিজ্য এমনকী, শাস্ত্রেও জুড়ে রয়েছে ইলিশ। এককথায় বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের যুগলবন্দি বহুদিনের। বাঙালির সাহিত্যেও জায়গা করে নিয়েছে রূপে-গুণে সুন্দর এই মাছ। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতা 'ইলশে গুঁড়ি'-তে ইলিশ মাছের ডিমের কথাও উল্লেখ করেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘ইলশে গুঁড়ি’ কবিতায় ছন্দে ছন্দে বর্ষাকে আবাহন করেছেন। ইলিশকে রেখেছেন তিনি বৃষ্টির স্বরূপ বন্দনায়:

ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম।
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম। ...
নেবুফুলের কুঞ্জটিতে
দুলছে দোদুল দুল;
ইলশে গুঁড়ি মেঘের খেয়াল
ঘুম-বাগানের ফুল।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'ঘনাদা' থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি'-তেও রয়েছে ইলিশ প্রেমের উল্লেখ।

'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে স‌ংগত কারণেই পাঠকের অনুসন্ধিৎসা জাগে ইলিশ নিয়ে। কারণ ইলিশের প্রসঙ্গ এলেই আসে পদ্মার ইলিশ। 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসের কৈবর্তপল্লীর মাঝিদের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ শিকার। উপন্যাসে ইলিশ শিকারের প্রসঙ্গ অবশ্যই আছে; আছে ইলিশ শিকারের যন্ত্রণা, বিপণনের স‌ংকট, ইলিশের দাম নিয়ে মুৎসুদ্দি শ্রেণির প্রতারণা, মূল্যবোধের স্খলন- কোনওকিছুই বাদ যায়নি উপন্যাসে।

এত যার রূপের গমক, সে এল কোথা থেকে, কেনই বা তার এত আদর, সে খোঁজও চলছে কবে থেকে। এই মাছের নাম কে দিয়েছেন? নশো বছর আগে পণ্ডিত জীমূতবাহন ইলিশের নাম দিয়েছিলেন। তবে নামের পিছনে অর্থ রয়েছে। আমরা যে বানানটি লিখি, সেটা ঠিক নয়। আসল বানানটি হল 'ইলীশ'। 'ইল' মানে 'জলের মধ্যে', আর 'ঈশ' কথার মানে যিনি 'শাসক'। একসঙ্গে এর অর্থ দাঁড়ায়, যে জলজগতের কর্তা। তবে ব‍্যুৎপত্তির জন্য বানানটি এখন 'ইলিশ' লেখা হয়। এছাড়াও ইলিশ শব্দের অর্থ, তৈলাক্ত বা চকচকে। এলাকাবিশেষে নাম বদলেছে এই সুস্বাদু মাছের। ওড়িয়া ভাষায় ইলিশকে বলে ইলিশি। তেলুগুতে এই মাছকে বলে পোলাসা। গুজরাতে আবার স্ত্রী ও পুরুষ ইলিশের নাম আলাদা। স্ত্রী ইলিশকে বলা হয় মোদেন, পুরুষ ইলিশের নাম পালভা। পাকিস্তানের সিন্ধু ভাষায় এই মাছের নাম পাল্লা। বার্মিজদের ভাষায় এই মাছ সালাঙ্ক।

বাঙালির ইলিশ প্রেম আদি, অকৃত্রিম, চিরন্তন। ইলিশের পেটি, গাদা, ল্যাজা, মুড়ো, তেল, কানকো, কাঁটা, ডিম... জলের রানির কিছুই যে ছাড়া যায় না! ঝোল, ঝাল, তেল, অম্বল- যেমনভাবেই খান, খাওয়ান, সবেতেই সুখ! ইলিশ আর শুধুমাত্র একটা মাছে আটকে নেই! সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে! এখানেই শেষ নয়! ইলিশ মাছ ধরতে বেরনোর আগে ধূপধুনো দিয়ে নৌকায় ওঠেন জেলেরা। জাল পুজো করেন। নৌকার গলুইয়ে মিষ্টিবাতাসা বা চিনি দিয়ে, তারপর জাল তোলেন। এরপর, জালে যখন প্রথম ইলিশটা ওঠে, তাকে একটা থালায় করে, জালের ওপর রেখে, সিঁদুর-হলুদ মাখিয়ে বরণ করা হয়! অনেকে আবার ধূপধুনো, বাতাসাও দেন। তারপর, মাছের মাঝের খানিকটা অংশ কেটে নৌকার গলুইয়ে পুঁতে দেন। পরম্পরাগতভাবে এমনটাই চলে আসছে।

এ তো গেল জেলেদের কথা। বাড়িতে জেলে বউদেরও নিয়মের শেষ নেই। সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ এনে সিঁদুর-হলুদ মাখিয়ে ধানদুর্বা দিয়ে কুমিল্লা ও নোয়াখালির জেলেবউরা ইলিশ বরণ করেন। গলায় গান- ইলিশ মাছে কাটে বউ/ ধার নাই বটি দিয়া/ ইলিশ মাছ রান্দে বউ/ কচু বেগুন দিয়া।

রানি বলে কথা! তাঁকে নিয়ে এটুকু আদিখ্যেতা না করলে কি আর চলে?

ইলিশ বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ভাজা, ভাপা, ঝোল আর তরকারি— এই চার পদ্ধতিতে ইলিশ খায় বাঙালি। ইলিশ আমাদের জীবনের এতটাই গভীরে ঢুকে গেছে যে আমরা জোড়া ইলিশকে বানিয়ে ফেলেছি শুভ ও মঙ্গলের প্রতীক। বিয়ের মতো শুভ কাজে একসময় জোড়া ইলিশ দেওয়া হতো। বাঙালি যে পরিবারে ইলিশের যত বেশি আয়োজন, সে পরিবারের ততটাই খ্যাতি।

ইলিশেরও আবার রকমফের আছে- চন্দনা ইলিশ, খয়রা ইলিশ, জাইতকা ইলিশ, ফ্যাঁসা ইলিশ ইত্যাদি। তবে বাঙালির কথায়, বা তর্কে যে দুই ইলিশের নাম সবচেয়ে বেশি উঠে আসে তা হল পদ্মার ইলিশ ও গঙ্গার ইলিশ। পদ্মার ইলিশে তেল বেশি এবং দেখতেও উজ্জ্বল। তাই পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি পছন্দ করে মানুষ। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, নদীর ইলিশ সাধারণত একটু বেঁটেখাটো হয়। আর সমুদ্রের ইলিশ আকারে অনেকটাই লম্বা ও সরু। এছাড়া পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার হয় পটলের মতো, অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা হতে হবে। খাদ্যরসিকরা মনে করেন, নদীর ইলিশ আর সাগরের ইলিশের মধ্যে স্বাদে অনেক পার্থক্য আছে।

কিন্তু পদ্মার ইলিশের স্বাদ ভিন্ন কেন? মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় জলের প্রবাহের ধরন আলাদা, যার ফলেই ইলিশের স্বাদেও পার্থক্য থাকে। পদ্মায় সাধারণত তিন রকমের ইলিশ পাওয়া যায়- পদ্মা ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, ও গুর্তা ইলিশ। অন্যদিকে গঙ্গায় দুই ধরনের ইলিশ- খোকা ইলিশ ও ইলিশ। ছোট ইলিশগুলিকেই খোকা ইলিশ বলা হয়। আরও ছোটগুলিকে বলা হয় খয়রা ইলিশ। গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের মধ্যে বাহ্যিক পার্থক্য হল গঙ্গার ইলিশের গায়ে সোনালি আভা থাকে এবং পদ্মার ইলিশের গায়ে থাকে এক ধরনের গোলাপি আভা। বলা হয়, পদ্মার ইলিশে তেল এত বেশি যে রান্নার সময় কিছুটা তেল ফেলে দিতে হয়। তবে পদ্মা ও গঙ্গা ও দুই ইলিশের ক্ষেত্রেই ডিম ছাড়ার আগে মাছের স্বাদ বেশি থাকে। মৎস্যজীবীরা জানান, ভাদ্র মাসে ইলিশের পেটে ডিম থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যে যে ৩১টি মাছের তালিকা দিয়েছেন, তার সর্বশেষ মাছটি হলো ইলিশ। শেষ হোক বা শুরু, আদ্যোপান্ত বাঙালি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতে ইলিশের রসাস্বাদন থাকবেই। পকে‌টে যতই টান পড়ুক, যতই পদ্মার ইলিশ আর গঙ্গার ইলিশ নিয়ে তর্ক জারি থাক, কাঁটা বেছে খেতে গিয়ে অপরিসীম পরিশ্রমে খাবার টেবিলে ঘাম ঝরুক, বর্ষামুখর সকালে বাঙালির বাজারের থলি থেকে উঁকি দেবেই জলের রানির রুপোলি চোখ। যে রানিকে নিয়ে বাঙালির এত আদিখ্যেতা, সেই তো বাঙালি সংস্কৃতিকে পৃথিবীতে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।

More Articles