কেন নিজের নাম রেখেছিলেন উত্তমকুমার? আত্মজীবনীতে উত্তর দিয়েছিলেন মহানায়ক
নিজের নাম বদল করে রাখলাম উত্তমকুমার। অর্থাৎ আমি হচ্ছি উত্তম-মানুষের পুত্র।... নিজের পিতাকে সব পুত্রই শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে করে।...
উত্তমকুমার যে লেখালিখি করতেন, সেটা হয়তো সেইভাবে আলোচনায় আসে না। আসলে তাঁর গায়ে তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়ালিজমের বর্মটা তো চাপানো ছিল না। তাই বোধহয় আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি না, বিশ্ব সিনেমাজগৎ তো বটেই, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যান্য অনেককিছু সম্বন্ধে তিনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন। এসব নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা ছিল তাঁর। উত্তমকুমারের লেখাগুলো পড়লেই যা বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, এর বেশিরভাগই তিনি নিজে লিখেছেন। কারণ, লেখাগুলোর গড়নপেটনে ধরনের একটা মিল চোখে পড়ে। পাশাপাশি পরিষ্কার হয়, বিষয়গত দিক থেকে তাঁর গভীর অনুভূতি ও ভাবনার দিকটিও। নিয়মিত লেখক যাঁরা হন, তাঁদের লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে এক ধরনের Writing Mode-এর প্রতিফলন। কিন্তু যাঁদের লেখালেখি করাটা অন্যতম প্রধান কাজ নয়, অথচ এঁদের মধ্যে যাঁদের আছে অনুভবের গভীরতা, পড়াশোনা ও একটি শিল্পী মন, তাঁদের ক্ষেত্রে মনের কথাগুলো যেন অনেকটা Speeching Mode-এর ভঙ্গি নিয়ে লেখায় প্রতিভাত হয়। যেখান থেকে প্রকাশ পায় এক ধরনের আন্তরিক এলোমেলো ভাব এবং সেই গঠনমূলক অগোছালোতা থেকেই জন্ম নেয় একটি অন্যরকম সুখপাঠ্য রচনা। উত্তমকুমারের বেশিরভাগ লেখায় এটাই চোখে পড়ে। যার উজ্জ্বলতম উদাহরণ তাঁর লেখা আংশিক আত্মজীবনী 'হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর'।
'নবকল্লোল' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা (বৈশাখ ১৩৬৭) থেকে শুরু হয়ে রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বৈশাখ ১৩৬৯ সংখ্যা অবধি। তখন ছবির দুনিয়ায় উত্তমকুমারের চরম ব্যস্ততার সময়। তাই বোধহয় তিনি আর লেখাটি নিয়ে এগোতে পারেননি। 'হারিয়ে যাওয়া...' প্রথম বই হয়ে বেরোয় এর অনেক বছর পরে― ২০১৩ সালের কলকাতা বইমেলায়। এই আংশিক আত্মজীবনীতে উত্তমকুমারের সাধারণ অবস্থা থেকে হার্টথ্রব হিরো হয়ে ওঠার মাঝখানের বৈচিত্র্যে ভরা কঠিন পথটা খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। যেখানে বারে বারেই তাঁর নিজের ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ও অনুভবী ধারণাকে দক্ষতার সঙ্গে মেলে ধরেছেন মহানায়ক। প্রসঙ্গত, এটা যে পুরোপুরি তাঁর নিজে হাতে লেখা, একথা বইয়ের নানা জায়গায় কয়েকবার বলেছেন তিনি।
শুরুতেই লিখছেন―
দ্বিজেন্দ্রলালের দিলদার এক জায়গায় বলেছেন, "আমি পারিষদ, দার্শনিকের পদে এখনও উন্নীত হইনি। তবে ঘাস খেতে খেতে মুখ তুলে চাওয়ার নাম যদি দর্শন হয়, তাহলে আমি দার্শনিক।" ঠিক তেমনই আমি অভিনেতা। অভিনয়ই আমার জীবন। সাহিত্যিক আমি নই। তবুও আমাকে অনুরোধ করেছেন লেখবার জন্যে।
আরও পড়ুন: টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল শহরে, মহানায়ককে শেষ দেখা দেখতে বয়ে গিয়েছিল জনস্রোত
প্রথমেই যেভাবে আরম্ভ করলেন, তা থেকে লেখকের রসবোধে ভরা লিখন-মুনশিয়ানার পরিচয় কি আমরা পাচ্ছি না? যে 'উত্তমকুমার' নামটা কয়েক যুগ ধরে আমাদের মধ্যে হৃৎকম্প তুলে চলেছে, কেন তিনি সেই নাম নিয়েছিলেন, তার কারণটিও তিনি লিখেছেন এই আত্মকথায়। আমরা জানি, উত্তমকুমারের পিতৃদত্ত নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। মামার বাড়ির দাদু ডাকতেন 'উত্তম'। এই নামটিই তিনি নির্বাচন করলেন অভিনয়ের দুনিয়ায় (একমাত্র তৃতীয় ছবি 'মর্যাদা'-য় অবতীর্ণ হয়েছিলেন 'অরূপকুমার' নামে)। এই বিষয়ে উত্তম লিখছেন,
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আমার ছেলে বয়সের অরুণকুমার নাম আমি কেন পরিবর্তন করলাম।... অরুণকুমার― অর্থাৎ সূর্যের পুত্র। সূর্যদেব হচ্ছেন সেই সে দেবতা যাঁর দয়ায়, জগৎ আর তার সৃষ্টি রক্ষা পায়। কিন্তু আমি তো তা নই। এ যুগের কবিগুরুর নামও তাই। মধ্যাহ্ন ভাস্করের মতন তিনি সাহিত্যজগতে বিরাজিত। তাঁর মৃত্যুতে আমার যতদূর স্মরণ আছে― Sir Morris Gayer বলেছিলেন― "গত দুহাজার বৎসরের মধ্যে এমনি প্রতিভাবান ব্যক্তির জন্ম হয়নি। আর আগামী দুহাজার বৎসরের মধ্যে এমন কবির জন্ম হবে কিনা সন্দেহ।" তাই আমি ভেবে দেখলাম তাঁরই সাজে 'রবীন্দ্র' নাম নেওয়া। কিন্তু আমি? আমি তো সামান্য মানুষ! ও নাম বা তাঁর পুত্র হবার যোগ্যতা আমার কোথায়? তাই আমার নিজের নাম বদল করে রাখলাম উত্তমকুমার। অর্থাৎ আমি হচ্ছি উত্তম-মানুষের পুত্র।... নিজের পিতাকে সব পুত্রই শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে করে।... কারণ বাবা-মা যে কোনও ছেলেমেয়ের উপাস্য দেবতা। তাই আমি নাম বদল করে হলাম উত্তমকুমার।
এতখানি উদ্ধৃতি থেকে দুটো দিক উঠে আসছে। প্রথমত এ নিছক একটি নায়কোচিত কুমার-খচিত নাম নিয়ে নেওয়া নয়, এর পিছনে তাঁর গভীর ভাবনা কাজ করেছিল। আর দ্বিতীয়ত, এই গোটা বিষয়টিকে অত্যন্ত সহজ, সাবলীল ভঙ্গিতে উপস্থাপন! আরও একটি কথা। এখানে যে Morris Gayer-এর কথা এসেছে, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। ১৯৪০ সালে ইনি নিজে শান্তিনিকেতনে এসে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডি.লিট সম্মান প্রদান করেছিলেন। নিজের নাম-গ্রহণের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ও Gayer-এর প্রসঙ্গটা যেভাবে আনলেন উত্তমকুমার, সেটাই লক্ষ্য করার মতো। এরকম আরও অনেক অভিনব ভাবনার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এই আংশিক আত্মজীবনীজুড়ে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি লিখেছেন বেশ কিছু ছোট ছোট নিবন্ধ। সেইসব টুকরো লেখা থেকেও উঠে আসে নানা বিষয়ে উত্তমকুমারের অভিনিবেশের দিকটি। তার মধ্যে থেকে কিছু দেখা যাক।
অনেকেই বলে থাকেন, স্টার হওয়াটাই উত্তমকুমারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সেটা হয়েই তিনি আজীবন থেকেছেন। কিন্তু আসলে কি তাই? অবশ্যই, তিনি এক অবিসংবাদিত স্টার। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যেটা হওয়া অত সোজা তো নয়ই, আরও কঠিন এই ইমেজ বজায় রাখা। উত্তমকুমার তাঁর জীবদ্দশায় তো বটেই, আজও সবার কাছে সেরা স্টার― মহানায়ক। কিন্তু তিনি স্টার সত্তার বাইরে গিয়ে যেসব অসামান্য চরিত্র-অভিনয়ের দৃষ্টান্ত বহু ছবিতে রেখেছেন, তাকে ভুলে গেলে চলবে কেন? আর এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য কী ছিল, তা তো তাঁর কিছু লেখা ও সাক্ষাৎকার থেকেই ধরা পড়ে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২-র সময়টাকে ধরলে, দেখা যায়, এই সময়জুড়ে উত্তমকুমারের ১৮টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। তার মধ্যে যদি চারটি ছবি বাছা যায়, সেই 'মায়ামৃগ' (১৯৬০), 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন'(১৯৬০), 'সপ্তপদী' (১৯৬১) ও 'কান্না' (১৯৬২)― এর মধ্যে একমাত্র 'সপ্তপদী' ছাড়া আর কোনওটাতেই তিনি তথাকথিত 'নায়ক' বা 'স্টার' নন। মনে রাখতে হবে, উত্তমের তখন তুঙ্গ মুহূর্ত চলছে। সেইসময় নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে। 'মায়ামৃগ' ছবি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি। যেখানে নায়ক বিশ্বজিৎ এবং উত্তমকুমার ছিলেন 'মহেন্দ্র' নামে একটি ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। ছবি মুক্তির কয়েকমাস আগে, ১৯৫৯ সালের একটি পত্রিকার পুজোসংখ্যায় 'মহেন্দ্র ও আমি' নামে একটি লেখা লিখেছিলেন উত্তমকুমার। যেখানে তিনি খোলা মনে আলোচনা করেছেন 'মায়ামৃগ'-তে তাঁর অভিনীত চরিত্রটিকে নিয়ে। এক জায়গায় লিখছেন―
মায়ামৃগ ছবি দেখতে দেখতে যদি একটিবারের জন্যও আপনাদের মনে হয়, যে এই চরিত্রের জন্য উত্তমকুমারের কী প্রয়োজন ছিল, তা হলেই বুঝব মহেন্দ্র চরিত্রের রূপায়ণ আমার সার্থক হয়েছে। এক হয়ে গেছে মহেন্দ্র আর উত্তমকুমার। আপনাদের অজস্র প্রীতি আমাকে যে ব্যক্তিত্বে ভূষিত করেছে, তা বিস্মৃত হয়ে আমি মহেন্দ্র চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছি।
১৯৬৮ সালে লেখা 'নায়ক ও চরিত্রাভিনয়' নামে একটি লেখায় উত্তম লিখছেন―
কোনটা ভালো লাগে― নায়ক চরিত্র না চরিত্রাভিনয়? এ ধরনের প্রশ্ন, সত্যি কথা বলতে কি মনেই আসেনি। একের পর এক রোল পেয়েছি। নায়ক, পার্শ্বচরিত্র, সহ-নায়ক, খলনায়ক সব কিছুই।... কোথাও রোমান্টিক, কোথাও সরল সাদাসিধে, কোথাও বা আবার ভারিক্কি চালের।... অবশ্য এটা অনেকটাই সত্যি যে, সাধারণের কাছে আমার ইমেজ রোমান্টিক নায়কের। কিন্তু সত্যিই আমি তাই? 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', 'জতুগৃহ', 'মরুতীর্থ হিংলাজ' ছবির চরিত্র কি রোমান্টিক?
জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার সময় যিনি এইসব কথা সাবলীলভাবে লিখতে পারেন, তারপরও বলা হবে এই মানুষটা শুধু স্টার হতে চেয়েছিলেন!
ভালো ও মনের মতো চরিত্র পাওয়ার জন্য কতখানি ব্যাকুল ছিলেন উত্তমকুমার, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর 'আমার অভিনয়ের মুক্তি' নিবন্ধে। শুরু করছেন এইভাবে―
ফিল্মে অভিনয় করার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেছি অতৃপ্তি, একই ধরনের ভূমিকায় পাঁচটা ছবিতে নাম বদলে পাঁচবার অভিনয় করতে হয়েছে।... আর ভালো লাগছে না একই ভূমিকা বারবার। এমন সময় সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' ছবিতে অভিনয় করবার ডাক পড়ল। আমি আমাকে এক নতুন ভূমিকায় খুঁজে পেলাম। মুক্তি হল আমার অভিনয়ের।
এই ছবির 'অরিন্দম' চরিত্রে কেন তিনি অসামান্যতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, তা বোঝা যায় এই নিবন্ধেরই কয়েকটা কথা থেকে―
ছবির পরিবেশে আত্মস্থ হলেই সম্ভবত আর কোনও জটিলতা থাকে না সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে। সেজন্যই শ্রীরায়ের চিত্রকল্পে স্বতন্ত্রতা। বাস্তবজীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে যার মূল্য অনেক। অরিন্দম আর উত্তমকুমার সম্পর্কে দুস্তর ব্যবধান কখনওই থাকত না। অরিন্দমের মানসিকতার সঙ্গে নিজেকে ভাবতে গিয়ে বিসদৃশ মনে হয়নি। মনে হয়নি আমরা ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ আর ব্যর্থতার গ্লানি জড়িয়ে রেখেছি শরীরে। মনে হয়েছে অরিন্দমের সুখ আমার সুখ, অরিন্দমের দুঃখ আমার দুঃখ। অরিন্দমের জটিলতায় আমিও ভাবিত। অরিন্দমের সরলতায় কখন আমিও মুগ্ধ।
অন্তরে থাকা শিল্পগত চাহিদাকে অপূর্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপনের এ এক অন্যতম নিদর্শন। এর পরে, 'নায়ক' ছবিকে কেন্দ্র করে সত্যজিতের সঙ্গে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে যাওয়া ও সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে উত্তম লিখেছিলেন 'বার্লিন সফর' নামে একটা লেখা। যা পড়লে বোঝা যায়, বিশ্ব-চলচ্চিত্র সম্পর্কে কতটা ধারণা তিনি রাখতেন। পোলানস্কির 'কুল দ্য সাক' বা গদারের 'ম্যসকুলা ফেমিনা' দেখে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি অকপটে। চার্লি চ্যাপলিনের অভিনেত্রী কন্যা জেরাল্ডিন চ্যাপলিন, অভিনেতা জাঁ পিয়ের লো প্রমুখের সঙ্গে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তবে একটি জায়গায় যে কথা লিখেছেন উত্তম, তা থেকে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়―
ডি ড্রামাটাইজেশন কথাটি আজকাল বেশ শুনতে পাই। বুঝলাম, এটি আসলে সিনেমার ক্ষয়রোগ। এর হাত থেকে উদ্ধার না পেলে চলচ্চিত্র বাঁচবে না। কয়েকটি ছবি তো বেশ মন দিয়ে দেখলাম। কই মন তো ভরল না। ওখানকার বেশিরভাগ দর্শকও কি তৃপ্তি পেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই নয়। ওরা যদি সত্যিই খুশি হতেন তবে পুরস্কার দেওয়ার সময় অত চেঁচামেচি হল কেন? যখন 'কুল দ্য সাক', 'ম্যসকুলা ফেমিনা' প্রভৃতি ছবির নাম ঘোষণা হল তখন দর্শকদের কী বিরক্তি! রাগে যেন সকলেই ফেটে পড়লেন।... বেশ বুঝতে পারলাম, একঘেয়ে পাপাচার আর যৌনবিকৃতির মাঝখানে 'নায়ক' বেশ একটা নতুন আস্বাদ, সজীবতা এনে দিয়েছিল। তাই বুঝি, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান মঞ্চে এসে দাঁড়াবার পর মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) এমন স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন পেলেন।
আরও নানা বিষয়ে লিখেছেন উত্তমকুমার। যেখানে কয়েকটি লেখায় এসেছে বাংলা চলচ্চিত্রজগতের বিভিন্ন রকম দুরবস্থার কথা। তা সে ছবির ধরন, স্টুডিয়োগুলোর বেহাল অবস্থা, প্রেক্ষাগৃহের অনুন্নত কাঠামো― যাই-ই হোক না কেন। সেইসময় ঘন ঘন লোডশেডিং-এর দৌরাত্ম্যের মধ্যে গরম আর মশার অত্যাচারে ভরা দুর্দশাগ্রস্ত স্টুডিও-ফ্লোরে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে উত্তম বলেছেন, তাঁরা অনেক ক্ষমতা ধরেন, যাঁরা এরকম প্রতিকূলতার ভেতরেও কাজ করে যাচ্ছেন। সেই জায়গায় বিশ্বখ্যাত অভিনেতাদের এরকম পরিবেশে যদি কাজ করতে বলা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তাঁরা পরেরদিনই পালিয়ে যাবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি রিচার্ড বার্টন, রবার্ট রেডফোর্ড, চেম টোপল প্রমুখ জগৎকাঁপানো অভিনেতাদের নাম করেছেন। বিশ্ব-চলচ্চিত্র সম্পর্কে উত্তমের এরকম আরও অনেক জ্ঞানের পরিচয় ছড়িয়ে আছে, তাঁর অন্যান্য অনেক লেখায়। ১৯৭৯ সালে আমেরিকায় গিয়েছিলেন উত্তমকুমার। লস অ্যাঞ্জেলস্-এ গিয়ে সেখানকার বাঙালিদের সংগঠনের একটি সভায় দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই বক্তব্যে উঠে এসেছিল বাংলা তথা ভারতের চলচ্চিত্র ও নাটকের অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, সংগীত পরিচালক ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রসঙ্গ। উত্তমের এই ভাষণের লিখিত রূপ, তাঁর প্রয়াণের কিছুদিন পরে প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়ের একটি বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকায়। এখানেও পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিস্তৃত ধারণার সম্বন্ধে। শুধু সিনেমাই নয়, খেলাধুলো, সংগীত ইত্যাদি নিয়েও তাঁর লেখা আছে। শিল্প-সংস্কৃতি জগতের অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লেখাও কিছু নিবন্ধ আছে তাঁর। এমনকি জাদুসম্রাট পি.সি. সরকারকে (সিনিয়র) নিয়েও একটি লেখা আছে উত্তমকুমারের।
লেখার পাশাপাশি নিয়মিত সাহিত্যপাঠের নেশাও ছিল উত্তমের। একটি লিটল ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনায় বাংলা কবিতা ও কবিদের নিয়ে তিনি নিজের মতামত বলেছেন। যেখানে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দিনেশ দাস, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিদের কথা বলে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবিতার লাইন উল্লেখ করে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন উত্তমকুমার। শেষে গিয়ে বলছেন,
কবিতাকে হতে হবে ভাবের দিক থেকে সর্বজনীন। চিত্রকল্পে আকর্ষণীয়।... কবিতা এভাবে অলঙ্কৃত হলে আরও জনপ্রিয় আরও পাঠক তৈরি করতে পারবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমরা কি সেভাবে অনুসন্ধান করলাম উত্তমকুমারের বৈচিত্র্যে ভরা এই চিন্তন ও মনন জগতের? এইসব লেখালেখি ছাড়াও, উত্তমকুমার যে তিনটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন, তার মধ্যে 'শুধু একটি বছর' (১৯৬৬) ও 'বনপলাশির পদাবলী'(১৯৭৩) ছবিদুটোর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। এছাড়াও, গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের অনুলিখনে 'আমার আমি' নামে তাঁর একটি আত্মজীবনীও আছে।
উত্তমকুমার অভিনেতা হিসেবে কত বড় মাপের ছিলেন, যত দিন যাচ্ছে, তা নতুন নতুন করে যেন আবিস্কৃত হচ্ছে আমাদের কাছে। এর মধ্যে আছেন চিন্তাশীল জগতের একাংশও। যাঁদের কাছে কয়েক বছর আগেও উত্তমকুমার সেইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে, ফিল্ম সংক্রান্ত অনেক আলোচনা বিশ্লেষণে উত্তমকুমারকে বিষয় করে তোলা হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামগ্রিকভাবে তাঁকে দেখার চেষ্টা সেভাবে সম্ভবত এখনও হচ্ছে না। একজন শিল্পীর জনপ্রিয়তা যখন তাঁর প্রয়াণের ৪২ বছর পরেও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তথাকথিত 'মূলধারা'-র (Mainstream) একজন অভিনেতা হিসেবে শুধুমাত্র তাঁকে দেখলে, সেই দেখার মধ্যে বোধহয় বড় একটা ফাঁক থেকে যায়। তাঁর লেখালিখি নিয়ে আলোচনা তো প্রায় চোখেই পড়ে না। উত্তমকুমারের প্রয়াণের পরে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োতে আয়োজিত স্মরণসভায় বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায় তাঁর দীর্ঘ ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে― 'উত্তমের মতো কেউ নেই, উত্তমের মতো কেউ হবেও না।' কথাটা বোধহয় শুধু অভিনয় নয়, আরও ব্যাপক অর্থে সত্যি মহানায়কের ক্ষেত্রে।
তিনি নিজে কতটা বড় মাপের শিল্পী, সে ব্যাপারে অবশ্যই স্পষ্ট ধারণা ছিল উত্তমকুমারের। যা সব প্রতিভাবানেরই থাকে। নিজের শিল্প-ক্ষমতা অনুযায়ী যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হওয়া, উত্তমকে যথেষ্ট পীড়া দিত বলেই মনে হয়। তাঁর লেখা বা কিছু সাক্ষাৎকার পড়লেই একথা পরিষ্কার হয়। ১৯৬৮ সালে একটি পত্রিকায় 'আলোর পিপাসা' নামে নিবন্ধে উত্তম লিখছেন,
এই যে এত আলো, এত রং― যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার চারপাশে ঘোর অন্ধকারের বৃত্ত। আমি জানি, এই অন্ধকারটুকু পেরিয়ে যেতে পারলেই পৌঁছে যাব আর এক আলোর জগতে― যেখানে কিছুই মেকি নয়, কিছুই কৃত্রিম নয়। চেষ্টা করছি সেই জগতে পৌঁছবার। কবে পারব জানি না।
লেখার সময়টা দেখলেই বোঝা যায় উত্তমকুমার তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে বিরাজ করছেন। অথচ লেখায় ঝরে পড়ছে এই হতাশা। আমরা কি তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষিত 'আলোর জগতে' পৌঁছনোর সুযোগ তাঁকে সত্যিই দিতে পেরেছিলাম? আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বোধহয় এটাই।
তথ্য ঋণ:
১) 'হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর'― উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়(সম্পাদনা : অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন, জানুয়ারি ২০১৩)
২) 'নায়কের কলমে'― উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদনা: অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন, জুলাই ২০১৫)
৩) 'সাতাত্তর বছরের বাংলা ছবি' (১৯১৯-১৯৯৫)/ সংগ্রাহক-গ্রন্থনা-সম্পাদনা: তপন রায় (বাপী প্রকাশনী, আগস্ট ১৯৯৬)