স্টারডমের দুনিয়া ক্ষমাহীন, পল্লবীদের দুঃখ বেড়ে বেড়ে ক্যানসার হয়ে ওঠে সেখানে
We are sad generation of people with happy pictures. আমরা প্রত্যেকে আমাদের আনন্দ উদযাপন করি দুঃখকে যথাসম্ভব রেখেঢেকে।
পল্লবীকে আমি চিনি না। ৭ এপ্রিল চিনি। এমন একটা তারিখ, যা জ্বলজ্বল করবে আমার কবরে। স্টোন স্টিকারের মতো। শুটিংয়ের দৈনন্দিনতা অনুসারে পৌঁছে গিয়েছিলাম ফ্লোরে। তৈরি হচ্ছিলাম সেদিনের শটের জন্য। হঠাৎ প্রযোজক ফোন করে জানালেন, আমার সহ-অভিনেতা, যার সাড়ে দশটায় শুটিংয়ে পৌঁছে যাওয়ার কথা, সে আর নেই। নেই! যে গতকাল আমার 'ক্যান্ডি ক্রাশ সাগা'-র নতুনতম ধাপ পার করে দিল, সে আর নেই? যার হাতে ট্যাটু করা 'ড্যাডিস প্রিন্সেস', সে আর নেই! দিশা গঙ্গোপাধ্যায়, এক আশ্চর্য সম্ভাবনার অকারণ যতিচিহ্ন। যে যে কারণে দিশা প্রত্যক্ষভাবে আত্মহত্যা করেছিল, তার কোনওটাই আজ আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে প্রেম ছাড়া বাঁচবে না ভেবেছিল, সেই প্রেম ওকে ছাড়া দিব্যি আছে। এবং বিশ্বাস করুন, কোনও জাজমেন্ট ছাড়া কথাটা বলছি। কারণ, ওই কয়েক মিনিট যদি দিশার পাশে কেউ থাকত, কে জানে গল্পটা কী হত! কেউ যদি একবার ওকে ঝাঁকাত, বলত, "অ্যাই, ভুল ভাবছিস!" কেউ ছিল না সেদিন। দিশার বাবা কর্মসূত্রে আফ্রিকা-প্রবাসী, সেই অমোঘ সময়ে দিশার মাও সেখানে ছিল, যেখান থেকে মহাদেশ পার করে মেয়েকে ছোঁয়া যায় না। আমি কে এটা বোঝার যে, "যে মেয়েটা আইপিএল দেখতে ইডেন গেল, পরের দিন সকাল সে কেন দেখবে না?" কেন দেখবে না?
আসলে আত্মহত্যা জিনিসটাই খুব 'আজিবো গারিব কিসসা'! যে লোকটা জমিয়ে বাজার করল খাসির মাংস, খাবে বলে, সেইই যখন রান্না হওয়ার আগে নিজেকে সিলিং ফ্যানে সমর্পণ করে, তখন লজিক আশ্চর্যের কাঁচা বাজারে হারিয়ে যায়।
সবার আগে আমি আবার মনে করতে চাই, পল্লবী আমার চেনা নয়। তার প্লে লিস্টে হানি সিং বেশি চলে না জগজিৎ সিং, সেটাও আমি জানতাম না। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ বছর সাফল্য এবং ব্যর্থতার সঙ্গে ঘর করার পর আমি স্টারডমের বায়বীয়তা কিছুটা হলেও জানি। সেখান থেকেই কিছু শব্দের অবতারণা। শুরুতেই বলি, স্টারডম শব্দটাই বায়বীয়, বিশেষত, তা যদি টেলিভিশনের দরুন হয়, তা পোট্যাটো চিপসের চেয়েও বেশি ক্ষণস্থায়ী। আপনি সন্ধে সাড়ে সাতটায় একটি সিরিয়াল করলেন, ইনস্টা, এফবি-তে আপনার গুচ্ছ গুচ্ছ ফ্যান পেজ তৈরি হল। দারুণ মজার ব্যাপার! কিন্তু আপনি যদি এই সত্যিটা না জানেন যে, আপনার অতীতে সাড়ে সাতটায় অন্য কেউ ছিল, এবং আপনার ভবিষ্যতেও সাড়ে সাতটায় কেউ থাকবে, তাহলে মুশকিল। এই সত্যিটা ভুলিয়ে দেওয়ার অবিরাম চেষ্টা হবে। স্টারডম একটা রূঢ় পৃথিবী, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তা আরও বেশি রূঢ়। স্বয়ং অমিতাভকে আপনি ট্যুইটারে গিয়ে বলে আসতে পারেন, “এ বাবা, তোর ছেলে ফ্লপ”, কে ধরতে যাবে? আপনি তো মেঘনাদ! সোশ্যাল মিডিয়া নামক মেঘের আড়াল থেকে আক্রমণ করছেন। সেখানে কেই-ই বা অমিতাভ, কেই-ই বা পাড়ার পঞ্চু। বরং অমিতাভকে অপমান করতে পারলে আপনার জীবন ধন্য, পাড়ার পঞ্চু তো এমনিতেই অপমানিত।
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
সিনেমা, সিরিয়ালের পৃথিবী অত্যন্ত ক্ষমাহীন। আপনার বসার জায়গা, আপনার চায়ের কাপ কী হবে... সবটা নির্ধারণ করে আপনার শেষ কাজের ব্যবসা। এই ক্ষমাহীন পৃথিবীকে কাউন্টার করার জন্য একেকজন একেকটা রাস্তা আপন করে নেয়। আমার ক্ষেত্রে সেটা পড়াশোনা, লেখালিখি, অন্য কারও কাছে অন্য কিছু। কিন্তু আমাদের মধ্যে অধিকাংশ এই রাস্তা খুঁজে পায় না। বিশেষত আজকের যুগে, যেখানে ইনস্টা ফলোয়ার্স থেকে অভিনয়ের বিচার হয়, সেখানে একটা সুন্দর দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়াটা বিষয় নয়, তার সামনে তুমি নাচতে পারলে কি না সেটাই আসল। কাজেই নিজের পৃথিবী খুঁজে পাওয়া সহজ বিষয় নয়। তুমি দৌড়ের ঠেলায় দেখতেই ভুলে গেছ নিজের চারপাশ, জানবে কী করে কোনটা তোমার স্টপ ছিল? তুমি শুধু ক্রমাগত ক্ষয় দেখেছ। নামী চ্যানেল থেকে কম-নামী চ্যানেল। মুখ্য চরিত্র থেকে পার্শ্ব চরিত্র। চিনেমাটির কাপ থেকে কাগজের কাপ। এই এত ক্ষয়কে সরিয়ে নিজের পৃথিবী গড়বে কী করে?
তুমি যদি অভিনয়ের ছাত্রী/ছাত্র হও তাহলে বিষয় আলাদা। তাহলে ফাঁকা, মুক্ত অঙ্গণ হোক বা ঘরভর্তি টিআরপি, তোমার কিছু এসে যাবে না। কিন্তু তোমার অভিনয় যদি জনপ্রিয়তার আকাঙ্ক্ষার বাই প্রোডাক্ট হয়, তুমি চোট খেতে বাধ্য। আবারও বলছি, পল্লবীকে আমি বিন্দুমাত্র চিনি না। কিন্তু এই ইনস্টাসর্বস্ব প্রজন্মকে কিছুটা চিনি। বুক ফেটে গেলেও যারা 'হায় চকাচক চক চক হ্যায় তু' বলে নাচে এবং দুঃখকে বাড়তে বাড়তে ক্যানসার হয়ে যেতে দেয়, আমি তাদেরকে চেনার চেষ্টা করছি মাত্র। We are sad generation of people with happy pictures. আমরা প্রত্যেকে আমাদের আনন্দ উদযাপন করি দুঃখকে যথাসম্ভব রেখেঢেকে। সেলিব্রিটিদের এই দায় আরও বেশি। শ্মশানে একজনকে বডি ছুঁয়ে থাকতে হয় জানেন তো? আমি আমার বাবার বডি ছুঁয়ে থাকা অবস্থায় সেলফি তুলতে বাধ্য হয়েছি। পরে ভেবে দেখেছি, যিনি আমার সঙ্গে সেলফি তুলতে আগ্রহী, তিনিও কিন্তু শ্মশানেই এসেছেন। শ্মশান কোনও গোলাপবাগান নয় যে, ইচ্ছেমতো পায়চারি করব। কিন্তু সেলিব্রিটি দেখে তার শ্মশানে আসার হেতু তরল হয়ে গেছে। আসলে আমাদের হেরে যাওয়ার অনেক কারণ আছে, কিন্তু জেতার জন্য রয়েছে একটা উদাহরণ। ওই যে, যাকে বুক শেলফে রেখে দিয়েছি ঘরের রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে বলে, কিন্তু তাক ফোকলা লাগবে বলে নামিয়ে পড়িনি কক্ষনও। আমাদের একশোটা দুঃখের হাজারটা অভিযোগ পেরিয়ে তিনি জেগে থাকেন, কারণ 'এই আকাশে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়'।