কেন হঠাৎ হারিয়ে গেছিলেন কবি রোজমেরি টঙ্কস??
‘No, this is not my life, thank God …’
ব্রিটিশ কবি রোজমেরি টঙ্কস এবং তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘অ্যাডিকশন টু অ্যান ওল্ড ম্যাট্রেস’- এর শুরুটা এভাবেই। এবং ৮৫ বছরের সুদীর্ঘ জীবনের অধিকারী রোজমেরি কিভাবে যেন একটা সেমিকোলন টেনে, সত্তরের দশকের শেষে হঠাৎই চলে গেছিলেন কবিতা ছেড়ে, তাঁর পাতার পর পাতা সেইসব মোহমায়া ছেড়ে। আকস্মিক নির্বাসন। কবিজীবনের সবকিছু, সমস্ত মুখ, কথা, চিঠি, স্মৃতি ছেড়ে ...
জন্ম ১৯২৮। ১৭ অক্টোবর। কেন্ট, ইংলন্ড। একটা সময়ে পরপর কিছু গল্প লিখে হাতেখড়ি রোজমেরির। ১৯৪৯-এ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মাইকেল লাইটব্যান্ডের সঙ্গে বিয়ে। ম্যারেজ সার্টিফিকেটে পেশার জায়গায় লেখা ছিল – ‘রাইটার’। টার্নিং পয়েন্ট। আসলে এই বিয়ে এবং পরবর্তী বিচ্ছেদ রোজমেরিকে শেপ করেছিল অনেকটাই। বিয়ের পর একসঙ্গে প্রথমে করাচী এবং কলকাতা এবং শেষমেশ প্যারিস হয়ে লন্ডনে ফিরে আসা। অবশ্য তার আগেই দুদুটি অসুখ কেড়ে নিল জীবনশক্তির অনেকটাই। করাচীতে পোলিও এবং কলকাতায় প্যারাটাইফয়েড – অন্তত প্রথমটি রোজমেরির ডান হাতকে অনেকটাই অকেজো করে দিয়েছিল। হ্যাম্পস্টেডে থাকার সময়ই মাইকেলের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ। অসুখের পরও এতটা ধাক্কা পাননি, যতটা বিচ্ছেদ দিল – গেঁথে নিলেন শোক, গেঁথে নিলেন পরম যত্নে, আদরে লালিত লাইটব্যান্ড পদবিটি। স্বামী অন্য এক নারীর সঙ্গে সামান্য কিছু ফ্ল্যাটের দূরত্বে থাকতেন। যন্ত্রণা বাড়িয়ে ...
কবিতায় ঝকঝকে স্মার্ট স্যাটায়ার, তীব্র ফেমিনিজম। ১৯৬৩ ও ১৯৬৭-তে যথাক্রমে ‘Notes on Cafes and Bedrooms’ এবং ‘Iliad of Broken Sentences’। ছ’টি উপল্যাস, যার প্রতিটিই আসলে হয়তো একটা গল্পেরই ছ’টা বিভিন্ন ভার্সন। তীব্র একা, ছটফট করা একটা মেয়ের ক্ষোভ, ব্যঙ্গ, যন্ত্রণা, চিৎকার। এর পর কী? আন্ড্রু মর্টনের কথায় – ‘She disappeared. What happened? Because I admire her poems. I’ve been trying to find out for years …. No trace of her seems to survive – apart from the writing she left behind.’ ২০০৯-এর ২৯ মার্চ বিবিসির একটি তথ্যচিত্র ‘দ্য পোয়েট হু ভ্যানিসড’-এ কবি ব্রায়ান প্যাটার্ন বলছেন, ‘She evaporated into the air like the Chesire Cat …’
এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। হ্যাম্পস্টেডে থাকার সময়ে লন্ডনে সেইসময় প্রকাশিত খুব হাতে গোনা কিছু মহিলা কবির অন্যতম রোজমেরির যোগাযোগ হিল এডিথ সিটওয়েলসহ লন্ডনের বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক বৃত্তের সঙ্গেই। অবশ্য এই বৃত্তের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে রাখতেই একটা সময় তীব্র বিতৃষ্ণা – তাঁর র্যাবো, তাঁর বোদলেয়ার – কবিতা। মনে পড়ছে ‘দ্য লিটল কার্ডবোর্ড সুটকেস’। রোজমেরি লিখছেন – ‘The mistakes, the wrong people, the half-baked ideas, /And their beastly comments on everything. Foul. / But irrestibly amusing, that is the whole trouble.’
১৯৬৮-তে মায়ের চলে যাওয়া, নিজের ঘরে চুরি হয়ে একদিন সবকিছু হারানো, পোলিওয় ডান হাতের পাশাপাশি ক্রমশ নিউরাইটিসে বাঁ হাতটাও অকেজো হতে শুরু করা এবং শেষমেশ মাইকেলের সঙ্গে বিচ্ছেদ – রোজমেরি সরে যাচ্ছিলেন। ক্রিশ্চিয়ান বিশ্বাসের প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণা ছিল, বরং ক্রমশ ঝোঁক বাড়ছিল চীনা এবং প্রাচ্য আধ্যাত্মিকতার প্রতি। চোখের সমস্যা, যার মূলে ছিল সেই চীনা তাও বিশ্বাস। একটা ফাঁকা তীব্র আলোর উজ্জ্বল দেওয়ালের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতেন। একটা সময় নিতে পারলেন না। দশ দশটা বছর এবং শেষমেশ মিডলসেক্স হাসপাতালে ১৯৭৭-এর নিউইয়ার্স ইভে জরুরি অপারেশনে দুটি রেটিনারই অস্বাভাবিক ক্ষতি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি। একটা অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন থাকা শুরু। আর তখনই বোর্নমাউথে এক আত্মীয়ার ঘরে থাকতে শুরু করা, যা বাইবেল এবং নির্বাসনের চিন্তা – দুদিকেই ক্রমশ ঝোঁকাতে থাকে রোজমেরিকে। লন্ডনের বাড়িটা বহুদিনের চেষ্টার পর বিক্রি করে দিলেন। প্রাচ্যদেশীয় অসংখ্য সংগ্রহ একটি বাক্সের ভেতর পুড়ে একটি ইন্সিনেরেটরে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে দিলেন, ওপরে নাম লিখে দিয়েছিলেন – ‘দ্য বার্নিং অফ সাম আইডলস’। চীন, কোরিয়া, জাপান, বালি, পারস্য, গ্রীস, আফ্রিকা – এবং সেইসমস্ত জায়গার মার্বেল, টেরাকোটা, পোর্সেলিন, প্লাস্টার, মাদার অফ পার্ল, আইভরি, উল, কাঠ – কত কত সংগ্রহ – সব শেষ। প্রকাশিত হতে চলেছে এমন বহু লেখাই মাঝপথে আর বেরোল না – প্রকাশকেদের নতুন ঠিকানা দিলেন না। ক্রমশ ক্রিশ্চান বিশ্বাসে ফিরে এসে জেরুজালেমে জর্ডন নদীর ধারে ব্যাপ্টিজম হল রোজমেরির - ৫৩তম জন্মদিনে এই দ্বিতীয় জীবনে রোজমেরি টঙ্কস থেকে নাম বদলে রোজমেরি লাইটব্যান্ড হলেন – নাহ, মাইকেলকে কোনওদিনই ভুলতে পারেননি রোজমেরি।
কবিতা, লেখালেখি, তাঁর সাহিত্যজীবন সংক্রান্ত সবকিছু থেকেই যোগাযোগ ছিন্ন করলেও কবিতাগুলো পুড়িয়ে দেননি, বা উইলেও কোথাও কবিতা পুনঃপ্রকাশ সংক্রান্ত কোনও বাধানিষেধও ছিল না সেভাবে। আসলে কবিতা থেকে একধরনের উদাসীনতা রপ্ত করেছিলেন, যায় আসত না সেসব থাকল, চলে গেল, এসবে। সেই যে লিখেছিলেন – ‘The idea of literature is hopeless./ Make them drink their own poetry/ Let them eat their grass novel, full of mud.’ তবু শেষদিকে কোথাও একটা কষ্টে গুমরোতেন। ২০১৪ সালে ওভারিয়ান ক্যান্সারে চলে যাওয়ার বছরদুয়েক আগে সালে এক আত্মীয়া হঠাৎ চিঠি পাচ্ছেন রোজমেরির – ‘I was boxed up, under the most frightful, frightful mental pressure. I was not myself. All my decisions were wrong, inhuman, appalling. Give me time, please, I long to explain it to you.’ অবশ্য দেরি হয়ে গেছিল অনেকটাই। তখন ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।
অবশ্য তাঁর রেক্লুশনের সেই বোর্নমাউথ না, বরং হ্যাম্পশায়ারে মায়ের সমাধির পাশেই শোয়ানো হয়েছিলেন রোজমেরিকে। কোনও ফিউনেরাল না, স্পিচ না। হেডস্টোনে ‘রোজমেরি ডেসমন্ড বসওয়েল লাইটব্যান্ড’। এবং মৃত্যুর কিছুদিন পরেই রোজমেরির পরিবারের মতামত নিয়েই কবিতা সংগ্রহটি প্রকাশ পায়, নাম - ‘Bedouin of the London evening’, যেখানে আরও অনেক কবিতার ভেতর জ্বলজ্বল করছে অসম্ভব প্যাশনেট একটি কবিতা ‘Oath’ –
‘I swear that I would not go back/ To pole the glass fishpools where the rough breath lies/ That built the Earth – there, under the heavy trees/ With their bark that’s full of grocer’s spice’
মনে হয় হঠাৎ চলে যাননি রোজমেরি, তাঁর যাপনের ভেতর, কবিতার ভেতর না ফেরার কথা, চলে যাওয়ার কথাই ছিল বোধহয়। কেউ বুঝতে পারেননি ...
তথ্যসূত্র-
https://www.theguardian.com/books/2014/may/31/rosemary-tonks-lost-poet
https://www.theguardian.com/books/2014/may/02/rosemary-tonks
https://www.poetryfoundation.org/poets/rosemary-tonks