আরএসএসের তৈরি জমিতে ব্যাট করে এখন সঙ্ঘকেই লাথি! BJP-RSS সম্পর্কে ইতি?
BJP-RSS Clash: গত বেশ কয়েক বছরে নিজস্ব কাজে মোদি আরএসএসের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে এগিয়েছেন এমন উদাহরণও বিরল।
বিজেপি বেড়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের ছায়ায়। বারেবারেই আরএসএসকে ভারতীয় জনতা পার্টির মতাদর্শিক সংগঠন বলা হয়ে এসেছে। তবে গত দশ বছরে, আরও স্পষ্ট করতে বলতে গেলে মোদি জমানায় বিজেপি যেভাবে তেড়েফুঁড়ে উঠেছে, যেভাবে সর্বময় হয়ে ওঠার প্রয়াস করেছে তাতে আরএসএসের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়েছে। বিজেপি নিজেই এতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে যে আরএসএসের আঙুল ধরে চলার মতো প্রয়োজন তার আর নেই। দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ইস্যুতে দুই সংগঠনের মতপার্থক্য প্রকাশ্যে এসেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শেষ হওয়া এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। খোদ বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডাই বলেছেন, বিজেপি এখন আরএসএসের ছায়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হয়ে উঠেছে। পিতৃপুরুষের হাত ধরে চলার আর কোনও দরকার নেই। খোদ বিজেপি সভাপতি যখন এত বড় কথা বলছেন, তাও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মাঝামাঝি, তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে একা একা তরী পার সম্ভব?
সাংগঠনিক কোনও সিদ্ধান্ত কীভাবে একজন প্রকাশ্যে আগেই বলে দিতে পারেন? বিশেষ করে এমন অবস্থায় যখন এই জাতীয় বিভাজনের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে বিরোধীরা, প্রতিপক্ষরা? আরএসএস থেকে বিজেপির পৃথক হয়ে যাওয়ার এই ভার্চুয়াল ঘোষণাটি নাড্ডা যে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছেন এমন না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে বিজেপি এই ভাগাভাগির কথাটি ভেবেচিন্তেই উপযুক্ত সময়ে বলেছে। নাড্ডা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আরএসএস এবং বিজেপির সুর আলাদা।
আরও পড়ুন- আরএসএস, বিজেপি নেতা, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে ৬২% সৈনিক স্কুল তুলে দিল বিজেপি!
তবে একথা সত্য যে বিজেপি এবং মোদির বিরুদ্ধে আরএসএসের অভিযোগ বা উদ্বেগের কিছু নেই কারণ মোদি সরকার আরএসএসের মূল এজেন্ডার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছে। তবে বিষয়টা এত সহজ না। আরএসএসের মৌলিক চিন্তা প্রক্রিয়ার গভীরে যেতে হবে এই ঘটনাটি বুঝতে গেলে। আরএসএসের আদর্শ বিজেপি এবং মোদি প্রচার করেছে তাতে সঙ্ঘ খুশি হতেই পারে কিন্তু এই খুশিই সবটা নয়। আরএসএস অবশ্যই নিজস্ব কর্মসূচির বাস্তবায়ন চায় তবে তা সাংগঠনিক কার্যকারিতা বা সঙ্ঘের মৌলিক চিন্তা প্রক্রিয়ার বিনিময়ে নয়। এই চিন্তা প্রক্রিয়া কী? তা হচ্ছে, সঙ্ঘই সবার উপরে। কোনও ব্যক্তির কাছে সঙ্ঘ খাটো হবে না। অথচ গত ১ দশকে মোদি সঙ্ঘকে ছাপিয়ে গেছেন।
মোদি আরএসএসকে হাতের মুঠোয় রেখে হিন্দুত্বের বাণী ছড়িয়েছেন। এই কাজে মোদিই সর্বেসর্বা। তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই, আরএসএসও না। গত বেশ কয়েক বছরে নিজস্ব কাজে মোদি আরএসএসের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে এগিয়েছেন এমন উদাহরণও বিরল। আরএসএসের অন্দরের খবর, সঙ্ঘের তরফে যখনই কেউ সরকারকে কিছু জানাতে চেয়েছে, মোদি সরাসরি সঙ্ঘের সঙ্গে দেখাই করেননি। এখানেই শেষ না। নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁকে এই আসনে বসানোর নেপথ্যে আরএসএসের কৃতজ্ঞতা স্বীকার তিনি করেননি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা কেবি হেডগেওয়ার এবং তাঁর উত্তরসূরি এমএস গোলওয়ালকরের নাগপুরে সমাধিতে যেতেও চাননি মোদি। আরএসএসের প্রতি তাঁর উদাসীনতা প্রতি পদে প্রমাণ করেছেন তিনি।
গত দশ বছরে মোদিই সঙ্ঘ পরিবারের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন। সবতাই যেন তাঁকে আবর্ত করেই। আর এই বিষয়টিই সঙ্ঘের নীতির বিরুদ্ধে। সঙ্ঘ বলে, কেউ সংগঠনের ঊর্ধ্বে নয়, এমনকী আরএসএস প্রধানও নন। অথচ মোদির কর্তৃত্ববাদী চরিত্র সঙ্ঘের নীতির তোয়াক্কাই করে না। এটাই মোদির সঙ্গে আরএসএসের মূল অস্বস্তির কারণ।
আরও পড়ুন- ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েমে আরএসএস-এর ভূমিকা
তবে আরএসএসের আদর্শেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। আরএসএস মতাদর্শগতভাবে কিন্তু হিতৈষী একনায়কত্বের ধারণাকেই প্রচার করে। কিন্তু কিছুতেই বৃহত্তর সঙ্ঘ পরিবার সংস্থার মধ্যে কারও একনায়ক হওয়া মেনে নিতে পারে না। সঙ্ঘ বিশ্বাস করে, আরএসএস কোনও ব্যক্তির অধীন হয়ে গেলেই সঙ্ঘের মৃত্যু। সরকার আসবে-যাবে, আরএসএস প্রধানও আসবে-যাবে কিন্তু সঙ্ঘকে টিকে থাকতে হবে। তাই নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এই বিভেদ হওয়া স্বাভাবিক।
মোদি ক্ষমতায় আসার পরে বেশ কিছু আরএসএস ক্যাডারকে বিজেপির উচ্চ পদে জায়গা করে দিয়েছেন। সঙ্ঘের সঙ্গে এখানেও দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সেই কারণেই আরএসএস ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি থেকে নিজেকে দূরে রাখছে। তাহলে, আরএসএস এবং বিজেপি যদি আলাদা হয়ে যায়, তার ফল কি মোদির পক্ষেই যাবে? রাজ্যে রাজ্যে জেলায় জেলায় যদি আরএসএস পড়ে না থেকে সংগঠন তৈরি না করত তাহলে বিজেপির পক্ষে এই ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতোই না। পিচ তৈরি করেছে সঙ্ঘ, তাতে ব্যাট করেছেন মোদি। এখন পিচস্রষ্টাকেই লাথি মারলে ভোটবাক্সে কি প্রভাব পড়বে না? মোদি যদি সত্যিই এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান তাহলে আরএসএস খানিক অস্বিত্ব সঙ্কটে পড়বে ঠিকই। আর যদি এমনটা না হয়, মোদির গ্যারান্টি যদি কাজ না করে তাহলে সঙ্ঘের পরোক্ষা চাপে বিজেপিরি অবস্থা হবে সঙ্গীন।