ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে কেন শীতের অপেক্ষায় রয়েছে রাশিয়া

Russia Ukraine War: শীতের আগমনের অপেক্ষার সবথেকে বড় কারণ হলো, ইউক্রেন এবং সেই সঙ্গে সমগ্র ইউরোপকে শক্তি তথা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। হিটলারের নাৎসি-বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের রক্ষণ ভেদ করে এগিয়ে চলেছে দ্রুত। সেনার দক্ষতা, অস্ত্রের ধ্বংসক্ষমতা, সবদিক থেকেই নাৎসিরা এগিয়ে। ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে স্তালিনের বাহিনী। কিন্তু স্তালিন তাতে বিচলিত নন, কারণ রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আয়তন অভূতপূর্বভাবে বৃহৎ। যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন পোড়ামাটি নীতির কথা। আরও একটি বিরাট বড় কারণ ছিল, যা প্রবলবিক্রমে শুরু হওয়া নাৎসি অভিযানকে ব্যর্থ করে হিটলারের বাহিনীর পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। তা হলো শৈত্য। হ্যাঁ, পূর্ব ইউরোপের বিখ্যাত বা কুখ্যাত শৈত্য। এতটাই ঠান্ডা যে, সেই সময়ের সবথেকে ভয়ংকর সেনাবাহিনীও তার মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুত ছিল না।

সাত দশক পর, সেই পরাক্রমী সোভিয়েতের ধ্বংসস্তুপে বসে যুদ্ধ চালাচ্ছেন স্তালিনের মতোই আর একজন একনায়ক। যদিও যোগ্যতায় স্তালিনের রেড আর্মির ধারেকাছেও নেই বর্তমান একনায়ক পুতিনের সেনা। অন্য দেশের ভূমিখণ্ড দখল করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে রুশ সেনা। তাই এখন তাদের নায়ক শরণাপন্ন হয়েছেন তাঁর পূর্বসুরি স্তালিনের। শুরু হয়েছে শীতের জন্যে অপেক্ষা।

আরও পড়ুন: অবশেষে বন্ধু রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভারত! ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে কতটা কার্যকরী ভারতের অবস্থান?

শীতের আগমনের অপেক্ষার সবথেকে বড় কারণ হলো, ইউক্রেন এবং সেই সঙ্গে সমগ্র ইউরোপকে শক্তি তথা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া। রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার কারণে এমনিতেই বিপদের মুখে ইউরোপীয় দেশগুলি, বিশেষ করে জার্মানির মতো দেশ, যেখানে নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইন থেকে গ্যাস সরাসরি পৌঁছে যেত। কিন্তু জ্বালানির সমস্ত উৎস এখন রাজনীতির অস্ত্র। শত্রুপক্ষকে ধরাশায়ী করে দেওয়ার হাতিয়ার। সেই সঙ্গেই শীত আসার আগে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে ইউক্রেনের রাজধানী কিভের সমস্ত পরিকাঠামো, যা সেই শহরের বিদ্যুৎ পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত।

কিভের মেয়র কিছুদিন আগেই এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছেন যে, রুশ সেনাবাহিনী দেশের রাজধানী কিভকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চাইছে। চাইছে রাজধানীর মানুষদের তীব্র জলকষ্টর মুখে ঠেলে দিতে। ইউক্রেনের সেনাকে পরাজিত না করতে পেরে শাস্তি দিতে চাইছে সাধারণ মানুষকে, যাতে তাঁরা প্রবল শীতে নিজেদের বাড়িতে উষ্ণ না রাখতে পারেন।

সেই কারণে বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে একে একে ধ্বংস করছে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সরবরাহকারী পরিকাঠামোগুলিকে। সেই কারণে সমস্ত শহরবাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে যে-কোনও মুহূর্তে প্রশাসন শহর একেবারে খালি করে দিতে পারে। শীতের প্রকোপ যত বাড়বে, রাশিয়ার আক্রমণ ততটাই ধারালো হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

"এই পরিস্থিতি এড়াতে যা যা করণীয় সবই আমরা করছি। কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, আমাদের শত্রুরা নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে, যাতে রাজধানী কিভ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে এবং পানীয় জলের অভাবে শেষ হয়ে যায়। এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের সবার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আমরা এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তার ওপরেই আমাদের সবার ভাগ্য, আমাদের দেশের ভাগ্য নির্ভর করছে। পুতিনের ইউক্রেনের মানুষকে নিয়ে কিছু যায় আসে না। ওর জমি প্রয়োজন," সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন কিভের মেয়র ভিটালি ক্লিটস্কো।

অন্যদিকে এই ধরনের হামলার পিছনে রাশিয়ার যুক্তি হলো, তারা ক্রাইমিয়ার সেতুতে বিস্ফোরণের বদলা হিসেবেই এই আক্রমণগুলি করছে। ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের এহেন যুক্তি শুনলে অবাকই হতে হয়। যদিও অবাক হওয়ার হয়তো সত্যিই কিছু নেই। ইতিহাস সাক্ষী, স্বৈরাচারীরা কীভাবে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ভয়াবহ সব যুক্তি দিয়েছেন। ঠিক যেভাবে পুতিন ইউক্রেনের নাৎসিদের দমন করতে দেশটিকে আক্রমণ করেছিলেন। যদিও সেই অজুহাত মনে হয় তিনিই ভুলে গেছেন। আর পৃথিবীকে নাৎসি-জুজু দেখাচ্ছেন না তিনি। কোন মুখেই বা দেখাবেন? অতি-শক্তিধরের তকমা নিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের মতো একটি ছোট্ট দেশকে। আজ ন'মাস পর তাঁর নিজের সেনার কত হতাহতর সংখ্যা তিনি নিজেই হয়তো বলতে পারবেন না। তাই বিদ্যুতের পরিকাঠামো উড়িয়ে দিতে হচ্ছে, বিশ্বকে পরমাণু হামলার হুমকি দিতে হচ্ছে।

পুতিন জেনেভা কনভেনশনেরও আর পরোয়া করেন না। নিজের ক্ষমতা বাঁচাতে তিনি এতটাই তৎপর। সেই কনভেনশন অনুযায়ী, বেসামরিক ব্যবস্থাপনায় হামলা চালানো অন্যায়। কিন্তু যাঁর ক্ষমতার ভিত্তিই অন্যায় অপরাধের ওপর, তিনি কি জেনেভা কনভেনশনের কথা মান্য করবেন? যাঁর সেনা গণহত্যা চালায়, গণধর্ষণ করে, তাদের আবার কীসের মানবতাবোধ?

More Articles