কুস্তিগীরদের নাছোড় আন্দোলন থেকে কেন সরে দাঁড়ালেন সাক্ষী?

Sakshi Malik: কেন অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পরেই আন্দোলন থেকে সরে আসতে হল সাক্ষীকে?

'জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে'। না, সে কথাটা মিথ্যে নয়। আর মিথ্যে যে নয়, তা ফের একবার টের পাওয়া গেল কুস্তিগীরদের আন্দোলনের ময়দানেও। গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে খবরের কাগজের পাতা থেকে সংবাদমাধ্যম ভরে ছিল কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ-লড়াইয়ের শিরোনামে। 'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে' - দু'জনেই যে সমান অপরাধে দোষী। সেই শিক্ষা বুকে নিয়েই লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিলেন কুস্তিগীরেরা। কিন্তু সব শিক্ষা, সব আদর্শকে এ দেশে বরাবর মাথা নোয়াতে হয়েছে ওই পাকস্থলীর প্রশ্নে এসে। এখানেও ব্যতিক্রম হল না। আন্দোলন থেকে সরে এলেন স্বর্ণজয়ী কুস্তিগীর সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগটরা। কার্যত সরে আসতে বাধ্য হলেন।

এক নয়। একের পর এক যৌন হেনস্থা, ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। পদাধিকার বলে দিনের পর দিন মহিলা কুস্তিগীরদের সঙ্গে ওই আচরণ করে এসেছেন তিনি। হবে না-ই বা কেন! একে কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান, তার উপরে তিনি আবার বিজেপির হেভিওয়েট নেতা। তার সঙ্গে রয়েছে চড়া হিন্দুত্ববাদীর লেবেলও। ফলে ছ-ছ'বারের সাংসদের যে এমন আচরণের টিকিট রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। টিকিট রয়েছে বলছি, কারণ এত এত অভিযোগ, পদকজয়ী কুস্তিগীরদের আন্দোলন সত্ত্বেও নির্বিকার পুলিশ, নির্বিকার প্রশাসন, সর্বোপরি নির্বিকার সরকার।

আরও পড়ুন: মহিলা কুস্তিগীরদের দিনের পর দিন যৌন হেনস্থার অভিযোগ! কে এই বিজেপির বাহুবলী ব্রিজ ভূষণ?

আর এ সবের সামনেই মাথা নোয়াতে হয় সাক্ষী, ভিনেশদের মতো পদকজয়ী রেসলারদের। ধর্ষক, যৌনহেনস্থাকারীর গ্রেফতারি চেয়ে যন্তরমন্তরে ধর্না থেকে গঙ্গায় পদক ভাসাতে চাওয়াটুকুই সার হয়ে থেকে যায়। তার পর কোনও এক শনিবারের বিকেলে ডাক আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে। কথা বলেন, ভারতীয় জনতা পার্টির চাণক্য। আর সোমবারই তার ফল মেলে হাতে হাতে। সাক্ষী জানিয়ে দেন, আন্দোলনের মাঠ থেকে সরে আসছেন তিনি। ফিরে যান, সরকারের দেওয়া রেলের চাকরিতে। জানিয়ে দেন, এ একান্ত তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

এই ভাবে আস্তে আস্তে ময়দান ফাঁকা হতে থাকে। ধর্নাকারীদের ভিড় কমবে একে একে। সকলেই ফিরে যাবেন আপন কুলায়। ভাত মেখে খাবে, ঘাম মুছে ঘুমোতে যাবে। সকাল হলে দুধ কিনতে বেরোবে। জীবন চলবে জীবনের ধর্ম মেনে। এমনটাই হয়। এমনটাই হয়ে এসেছে। সমস্ত উত্তাপ, কণ্ঠস্বর প্রশমিত হলে উড়তে থাকবে শাসকের ধ্বজা। আসলে, কোন সুতোয় টান পড়লে কোন পুতুল নাচবে, কীভাবে নাচবে, তা ছকা আছে আগেই।

কেন অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পরেই আন্দোলন থেকে সরে আসতে হল সাক্ষীকে? কেন নিজের জায়গায় অনড় থাকতে পারেন না সাক্ষীর মতো আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদ, তার উত্তর ঝুলতে থাকে জীবিকা ও পেট নামক 'খুঁড়োর কল'-এর আগায়। মানুষ ছোটে, সাক্ষী-ভিনেশরা ছোটেন। ছুটতে হয়। কারণ ওই যে, জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত সহজেই যদি নতিস্বীকার করতে হয়, তাহলে সেই আন্দোলনের সারবত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে হয় বৈকি। কিন্তু এই ব্যর্থতা আদতে সাক্ষী বা ভিনেশের নয়। এই ব্যর্থতা সমাজব্যবস্থার, আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির। যেখানে সাক্ষীদের মতো পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদেরও শাসকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। পেট চালাতে বন্ধ রাখতে হয় মুখ। যে পদক একদিন নিজের ক্ষমতায় অর্জন করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন, সেই পদক নিয়ে গঙ্গার পারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। এ কার্যত সভ্যতার লজ্জা। যদিও সাক্ষীরা জানিয়েছেন, এর পরেও আন্দোলন চলবে। তবে সত্যিই কি চলবে! রামরাজ্যে প্রশ্ন জাগে বৈকি। 

আরও পড়ুন: নতুন সংসদ ভবন হোক বা কুস্তিগীরদের অবজ্ঞা— বিজেপির চাল তবে সফল?

সব আন্দোলন একদিন স্তিমিত হবে। ছাতি চওড়া করে ঘুরে বেড়াবেন ব্রিজ ভূষণেরা। বাবরি ধ্বংস মামলার প্রথম সারির নেতার পর আরও নয়া পালক এসে জড়ো হবে মুকুটে। ফের মিলবে সাংসদ পদ। আর যারা পরবর্তীতে আসবেন ভারতের হয়ে কুস্তি শিখতে। নাম লেখাবেন কুস্তি ফেডারেশনে। ভবিষ্যতে যাঁরা দেশ-বিদেশের প্রতিযোগিতায় ছিনিয়ে আনবেন পদক, তাঁরাও শিখে যাবেন। শিখে যাবেন, উঁচুতে উঠতে গেলে কীভাবে ক্ষমতাশালীর হাতে নিগ্রীহিত হতে হয়। কীভাবে যৌন হেনস্তা সহ্য করে নিতে হয় দাঁতে দাঁত চেপে। কীভাবে অন্যায় সহ্য করে নিতে হবে মুখ বুজে। তবেই মিলবে কুস্তিগীরের মর্যাদা, তবেই মিলবে সরকারি চাকরি। কারণ সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ শিখিয়ে দিয়ে যাবে, প্রতিবাদীদের পাশে প্রশাসন বা সরকার দাঁড়াবে না কোনও মতেই। বিশেষত অভিযুক্ত যদি হেভিওয়েট 'হিন্দুত্ব' ছাপ নেতা হন, তাহলে তো প্রশ্নই ওঠে না।

এই মহাদেশে বড় তাড়াতাড়ি বিস্মৃতির সন্ধ্যা নামে। এই সব অভিযোগ, প্রতিবাদ-আন্দোলনের কথা বেশিদিন মনে থাকবে না কারও। ঝাঁ-চকচকে সংসদভবন, জাঁকজমকের পুজোপার্বণ আর 'আজাদির অমৃত মহোৎসব'-এর ফাঁকে এসব তেতো-কথা হারিয়ে যাবে দেখো ঠিক..

More Articles