নর্তকী সেজে ঘোল খাইয়েছিলেন পুলিশকে, ভারতের প্রথম মহিলা গুপ্তচর সরস্বতীকে জানুন
পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে গোপনে পালাচ্ছে দুই তরুণী। পরনে পুরুষের পোশাক। একজনের বয়স খানিক বেশি হলেও অন্যজন তখনও নাবালিকা। অন্যদিক থেকে শোনা যাচ্ছে ক্রমাগত গুলির শব্দ। হঠাৎই ব্রিটিশ ক্যাম্প থেকে ছুটে আসা একটা গুলি এসে লাগে নাবালিকা মেয়েটির পায়ে। রক্ত ঝরতে থেকে গুলিবিদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত পা থেকে। কিন্তু সে দৌড় থামাতে নারাজ, কারণ সে জানে একবার ইংরেজদের হাতে ধরা পড়া মানে অবধারিত মৃত্যু অথবা ফাঁস হয়ে যেতে পারে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কোন গোপন খবর। অগত্যা কাছেই থাকা এক গাছ বেয়ে, সেই গাছে উঠে পড়ে তাঁরা। দুদিন গুলিবিদ্ধ এবং অভুক্ত অবস্থায় গাছেই আশ্রয় নেয় সে এবং তাঁর সঙ্গী। দুদিন পর যখন ইংরেজরা তাঁদের খোঁজ পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়, তখন তাঁরা আট ঘণ্টা বাসের দীর্ঘ সফর অতিক্রম করে পোঁছে যায় আইএনএ-র বেসক্যাম্পে। এই বিদুষী মহিলা দু'জন হলেন দুর্গা এবং সরস্বতী রাজামণি। সরস্বতী ছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা গুপ্তচর। আর এই উপাধি তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস।
১৯২৭ সালের ১১ জানুয়ারি বর্মাতে (বর্তমানে মায়ানমার) রাজামণি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নিজেই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর পিতা জীবনের প্রথমদিকে থেকে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড চালানোর পর, ব্রিটিশদের নিশানা থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে পরবর্তীতে রেঙ্গুনে বসবাস স্থাপন করেন এবং ক্রমেই রেঙ্গুনের অন্যতম ধনী ভারতীয় পরিবার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। নিজের জীবিকার পরিবর্তন ঘটালেও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং সমর্থন অক্ষতই ছিল। এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে রাজামণীর মনেও যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠবে, তা বোধহয় অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আরও পড়ুন-বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট যান জেটে চড়ে, জেনে নিন গৌতম আদানির সম্পত্তির পরিমাণ
১৯৩৭ সালে যখন মহাত্মা গান্ধী নিজেই রাজামণীর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন, তখন পরিবারের সকলে সেখানে উপস্থিত থাকলেও খোঁজ মেলে না রাজামণির। অনেক খোঁজার পর দেখা যায় বাগানে খেলার বন্ধুক হাতে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গান্ধীজী তাঁকে বন্ধুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে, উত্তরে দশ বছরের বাচ্চা মেয়েটি সেদিন জোর গলায় বলেছিল, ব্রিটিশরা আমাদের লুটেরাদের মতোই লুট করছে প্রতি মুহূর্তে, আমি জীবনে অন্তত একবার হলেও একজন ব্রিটিশকে গুলি করতে চাই। বোঝাই যায়, ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে সেই ছোট বয়স থেকেই তাঁর মনে এক তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহার জন্ম নিয়েছিল। এরপরেই তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের বিখ্যাত সেই স্লোগান ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন এবং ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের লেলিহান শিখা তাঁর মনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শিখরে পৌঁছেছে, তখন স্বয়ং নেতাজি রেঙ্গুনে আসেন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে তহবিল সংগ্রহের কাজে। ইতিমধ্যেই আই এন এ গঠিত হয়েছে। রাজমণী নেতাজীর এই তহবিলে নিজের সমস্ত সোনা এবং হিরের গয়না দান করে দেন। নেহাতই এ এক ছেলেমানুষি ভেবে নেতাজি তাঁর সমস্ত গহনা ফিরিয়ে দিতে চাইলে তিনি এবং তাঁর পরিবার তা ফেরত নিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে অলংকার ফিরিয়ে নেওয়ার শর্ত হিসাবে রাজমণি, নেতাজির কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন তাঁকেও আইএনএ-তে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নেতাজি তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন এবং রাজামণিকে রেঙ্গুনে আইএনএ-তে একজন নার্স হিসাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ‘সরস্বতী’ নামটি তাঁরই দান। আইএনএ-তে যোগদানের প্রথম দিনগুলিতে রাজামণী আহত সৈন্যদের সেবা করতেন কিন্তু এতে তাঁর মন ভরে না। তিনি দেশের জন্য আরও বেশি কিছু করতে চাইতেন। হঠাৎই একদিন তাঁর নজরে আসে, বেশি কিছু সদস্য টাকার বিনিময় ইংরেজদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করছে। তিনি শীঘ্রই তা নেতাজিকে জানান, যিনি সেইসময়ে রেঙ্গুনের থেকে ৫ কিমি দূরে এক বেস ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন।
তাঁর এই দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে, বোস রাজামণিকে আইএনএ রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টে নিযুক্ত করেন এবং এখানেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। এই পর্বে তিনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেগালের নেতৃত্বে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে মিলিটারি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণ চলাকালীন তাঁর পরিচিতি ঘটে দুর্গা নামক এক মহিলার সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে গুপ্তচরবৃত্তিতে তাঁর সহচরী হয়ে ওঠেন। আজাদ-হিন্দ-ফৌজ যখন ইম্ফল এবং কোহিমার উত্তর-পূর্ব দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিল তখন ঝাঁসি রেজিমেন্টকে রেঙ্গুন থেকে ৬৮০ কিমি দূরে বার্মার উত্তরে মায়মোতে পাঠানো হয়। এখানেই দূর্গা এবং রাজামণীকে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহের মূল ভার দেওয়া হয়। দুজনেই পুরুষদের পোশাকে মিলিটারি অফিসারদের বাড়িতে খুঁটিনাটি কাজ করার ছুঁতোয় প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন গোপন তথ্য পাচার করতে থাকে। এইসময় তাঁদের হাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এবং কিছু অস্ত্রও আসে। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় তাঁরা এই গুপ্তচরের কাজ করেছিলেন। অবশেষে একদিন খবর পাচার করার সময় দুর্গা ধরা পড়ে যায় এবং নিজের প্রাণের পরোয়া না করেই রাজামণী এক বার্মার প্রচলিত নর্তকীর বেশে জেলে প্রবেশ করেন। জেল কর্তৃপক্ষকে তিনি, তাঁর নাচের মধ্যে দিয়ে আকর্ষণ করেন তাঁদের মদের মধ্যে আফিম মিশিয়ে পরিবেশন করতে সক্ষম হন। জেলরক্ষীরা যখন আফিমের নেশায় বেহুশ হয়ে পড়ে, তখন রাজামণি তাঁর সহচরী দুর্গাকে উদ্ধার করে জেল থেকে পালিয়ে যান। এরপরেই তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে আহত হন।
স্বাধীনতার এতো বছর পরেও রাজামণীর কথা আমরা খুব কম লোকই হয়তো জানি, এই পোড়া দেশে বহুদিন যাবৎ কোন পেনসনের সুযোগও তিনি পাননি। বাধ্য হয়ে নিজের খরচ চালানোর জন্য তাঁর রেঙ্গুনের বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হন। ২০০৪ সালের সুনামিতে তিনি যথাসাধ্য দান করেছিলেন। ২০১৮ সালে জানুয়ারি মাসে নব্বই বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
তথ্যসূত্রঃ
1. livehistoryindia
2. feminisminindia
3. betterindia