ফেলতে পারেননি বৃদ্ধার অনুরোধ, 'বিধর্মী' হয়েও যেভাবে সরস্বতীপুজো করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি!

Saraswati Puja 2023: পুষ্পাঞ্জলি শেষেই প্রসাদ আঁচলে বেঁধে ছাত্রীরা হাওয়া। ম্লেচ্ছ নিবেদিতার ছোঁয়া প্রসাদ গ্রহণ করতে তারা একেবারে ইচ্ছুক নয় পড়ুয়ারা।

"যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।"

১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত 'বাবু' প্রবন্ধে এমনটাই লিখেছিলেন সাহিত্য সম্রাট। হ্যাঁ, সেই নবীন কলকাতায় বিদ্যালয়ের চেয়ে বেশ্যালয়েই বাণীবন্দনার হিড়িক বেশি ছিল। উঠতি বড়লোক বাবুদের কাঁচা টাকায় করা সরস্বতী পুজোর দেমাকই ছিল আলাদা। আর সেই টাকার গরমেই পতিতাপল্লীতে সরস্বতীর আরাধনার বিরুদ্ধে সকল টিকি দুলুনি বোধহয় দেবীর বীণার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। যৌনপল্লীগুলোতে বাগদেবীর আরাধনা করেই পেশা সংক্রান্ত বিদ্যায় হাতেখড়ি হতো মেয়েদের। এমনকী এইদিন তাঁদের নতুন নামকরণও হতো। আর পুজোর আয়োজন যে কী বিশালভাবে হতো তার খানিক চিত্র পাওয়া যায় 'সমাজ কুচিত্র' নামক নকশা থেকে।

"এদিকে মাঘ মাস শেষ হয়ে এল। ফাল্গুন মাসের প্রথম দিনেই মা বীণাপাণি পৃথিবীতে আবির্ভূতা হবেন। দশ দিন থাকতেই শহর যেন অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করচে, সোনাগাজী, বাগবাজার, সিমলা, মেছোবাজার, গরাণহাটা, বাঁশতলা, মাথাঘষা, চোরবাগান, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চাঁপাতলা, হাড়কাটা, সেন্ট জেমস চর্চ্চ, বৌবাজার, গুড়ের মা, ইমামবাগ, চাঁদনী ও জানবাজার প্রভৃতি পীঠস্থান সকল যেন জম্ জম্ কচ্চে। দিন নাই, রাত নাই, ঝাঁক ঝাঁক পীল ইয়ারের দল ঐ সকল তীর্থে সমাগত হচ্চেন।"

নব্য বাবুরা তো তাদের উপগৃহিণী বা প্রেয়সীদের মন রাখতে এই পুজোর আয়োজন করতেন, সেই থেকেই সরস্বতী পুজোর দিনে অনাগত বসন্তের পরশ গায়ে মেখে প্রেমের উদযাপনে মেতে উঠতে শিখল নাকি বাঙালি কে জানে? বিত্ত প্রদর্শনের এই নমুনায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরস্বতী পুজোর আয়োজনে বাজার থেকে ফুল সন্দেশ গায়েব হওয়ার গল্প তো সকলেরই জানা। বরং এইসব বড়মানুষি সরস্বতী পুজোর কথা ছেড়ে কিছু সত্যিকারের বড় মানুষের সরস্বতী পুজোর অভিজ্ঞতা ঘেঁটে দেখা যাক।

সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার প্রতি বছর বাড়িতে সরস্বতী পুজোর বিরাট আয়োজন করতেন। পুজোর দিন তাঁর বাড়িতে সব ছাত্রদের দু'বেলা খাবারের নিমন্ত্রণের পাশাপাশি বিকেল ও রাতে বাড়িতে বসত গানের আসর। তবে সকল আয়োজনের পাশাপাশি তর্কালঙ্কার মশাইয়ের কড়া নির্দেশ থাকত, পদ্যে সরস্বতীর বর্ণনা লিখে আনতে হবে। তাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিমন্ত্রিত ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছিলেন একটি মাত্র শ্লোক -

"লুচী কচুরী মতিচুর শোভিতং
জিলেপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম্।
যস্যাঃ প্রসাদেন ফলারমাপ্নুনঃ
সরস্বতী সা জয়তান্নিরন্তরম্।"

মার্গারেট ততদিনে নিবেদিতা। বেশ কিছুদিন হলো ভারতবর্ষে এসেছেন তিনি। সারদা দেবীর উপস্থিতিতে শুরু হয়ে গেছে নিবেদিতার মেয়েদের স্কুল। বিদ্যালয়ে যখন বানিয়েছেন বিদ্যাদেবীর আরাধনার আয়োজন তো করতেই হয়। যথাবিধি পুজোর আয়োজন করে প্রসাদে দিলেন ফল মিষ্টি। কিন্তু পুষ্পাঞ্জলি শেষেই প্রসাদ আঁচলে বেঁধে ছাত্রীরা হাওয়া। ম্লেচ্ছ নিবেদিতার ছোঁয়া প্রসাদ গ্রহণ করতে তারা একেবারে ইচ্ছুক নয় পড়ুয়ারা। পরের বছর পুজোর আয়োজন থেকে সচেতনভাবেই দূরে রইলেন নিবেদিতা। ছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগেই পুজোর আয়োজন করে ভোগ দিলেন লুচি তরকারি। তবে এবার কিন্তু আর তারা অচ্ছুত করে রাখেননি তাদের সানদিদি-মুনদিদি অর্থাৎ নিবেদিতা-ক্রিস্টিনকে। আধুনিক শিক্ষার আশীর্বাদে একত্রে প্রসাদ ভাগ করে নিতে তাদের আর সংকোচ হয়নি।

আন্দাজ চল্লিশের দশকের এক সরস্বতী পুজোর সকালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলি গঙ্গার কোন এক ঘাটে গিয়েছেন, হয়তো শীতের রোদ খানিক গায়ে মাখার ইচ্ছে। প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ এক বৃদ্ধা, দশ-বারো বছরের একটি মেয়েকে সঙ্গে করে এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে। হঠাৎ বললেন, "আমার বাড়ির সরস্বতী পুজোটা একটু করে দাও না বাবা। সকাল থেকে পুরুত খুঁজে খুঁজে হয়রান। নাতনিটা সেই ভোর থেকে অঞ্জলি দেবে বলে উপোস করে আছে।"

সংস্কৃতে তাঁর পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। তাই নিখুঁত সংস্কৃত উচ্চারণে যথাবিধি শাস্ত্রমতে পুজো করতে মুজতবা আলির কোনও সমস্যাই হয়নি। তবে সেই নিষ্পাপ মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেননি সেই বৃদ্ধা হঠাৎ তাঁকে ব্রাহ্মণ ঠাওড়ালেন কেন। পরে তিনি লিখেছিলেন, "জানিনা মাতা সরস্বতী এই বিধর্মীর পূজাতে অসন্তুষ্ট হলেন কিনা, তবে আশা করি তিনি ওই উপোসী বাচ্চাটির শুকনো মুখের হাসি দেখে অন্তত এই অধমকে ক্ষমা করবেন।"

 

More Articles