সেলফির চোটে ১৫০ বছরের ঐতিহ্য খান খান! ছবি না তুললে কি পিছিয়ে পড়তে হয় সমাজে?
Selfie Obsession: মূর্তিটি ১৫০ বছরের পুরোনো। এই প্রাচীন মূর্তিটির বর্তমান মূল্য প্রায় ২০০,০০০ ইউরো।
যেখানে যা কিছু ঘটে যাক না কেন, সেই মুহূর্তটি যদি আপনি ক্যামেরায় না ধরে রাখতে পারেন, আপনার সাতদিনের ফাঁসি, আর তিন মাসের জেল হবেই হবে! বিবাহবাসরে যদি বর কনের সঙ্গে ছবি না তোলেন, যদি ক' পিস মুরগির ঠ্যাং চিবিয়েছেন তার ছবিসহ প্রমাণ না রাখেন, যদি শ্রাদ্ধবাসরে ছবি হয়ে যাওয়া মানুষটির সামনে ফুল দিতে গিয়ে হালকা হেসে ছবি না তুলে থাকেন, যদি বন্যায় ভেসে যাওয়া বাড়িঘরের সামনে আঙুলে ‘ভি’ মুদ্রা বা কাঁচকলা দেখিয়ে ছবি তুলে না রাখেন, ষোলো আনাই মিছা! আর যদি ঘুরতেই গিয়ে থাকেন, আপনার চোখের কোনও কাজই নেই, কাজল-মাস্কারা বা সানগ্লাস পরা ছাড়া। চোখে ইদানীং মানুষ আর কিছুই দেখেন না। দেখেন মোবাইলের স্ক্রিনে, দেখেন ফোনের পশ্চাতে উঁকি দেওয়া মারকাটারি সব লেন্সের মাধ্যমে। তা দেখতে গিয়ে প্রাণ চলে যাক, পা ফসকে যাক, তুলকালাম হয়ে যাক, ১৫০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে যাক... পরোয়া নেই। সেলফি তুলতেই হবে। এই সেলফিখ্যাপা মানুষের পাল্লায় পড়ে সম্প্রতি ভেঙে খানখান হয়েছে ঐতিহাসিক ভাস্কর্য!
'এখানে ছবি তোলা নিষেধ' লেখা যেমন চোখে পড়ে, তেমনই আজকাল নানা স্থানে সেলফি কর্নারও দেখা যায়। এই দুইয়ের কোনওটাই নেই মানে এই বিশ্ব আমাদের অবাধ সেলফিযোগ্যা ভূমি। যেখানে যা দেখবে, যাকে দেখবে জড়িয়ে, জাপটে, হেলে দুলে ছবি তুলে ইতিহাসের পাতায় প্রমাণ রেখে যেতেই হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে না হলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। আপনি কোথায় কোথায় গেছেন, কী কী করেছেন প্রতি মুহূর্তের আপডেট পাবে না আপনার ফ্যানমহল। এই আপডেট জোয়ারে ভেসে গিয়েই সম্প্রতি খান খান হয়ে গিয়েছে প্রাচীন এক ভাস্কর্য। পর্যটকের সেলফিপ্রেমে সর্বনাশ হয়েছে ইতিহাসের।
আরও পড়ুন- পৃথিবীর ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুতে ব্যবহৃত হতো চাকা! নারকীয় যে ইতিহাস অবাক করবে
একদল তরুণ জার্মান পর্যটক সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্যই ছবি তুলতে বেরিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন উত্তর ইতালির একটি ভিলায়। সেই ভিলা ভাড়া নিয়ে ছিলেন তারা। মহা মূল্যবান এক মূর্তি দেখে নিজেদের আর ধরে রাখতে পারেননি। মূর্তিকে জড়িয়ে, প্রায় ঘাড়ে উঠে ছবি তুলেছেন। এই করতে গিয়েই ঘটেছে মহা বিপদ। সেলফির ঠেলায় ভেঙে গিয়েছে ওই প্রাচীন মূর্তি, জানিয়েছেন ভিলার ম্যানেজার ব্রুনো গোলফেরিনি। এই গোটা ঘটনাটি আবার অনেক পর্যটক নিজেদের ক্যামেরাতে ধরেও রেখেছেন!
স্থানীয় প্রতিবেদন বলছে, শিল্পী এনরিকো বুট্টির তৈরি এই ভাস্কর্যের নাম ডোমিনা। এই ডোমিনাকে জড়িয়ে ধরতে গেছিলেন জার্মান পর্যটক দলের দুই ব্যক্তি। তার জন্য একটি ফোয়ারায় চেপে উঠে বসেন একজন। আরেকজন লাঠি দিয়ে ধাক্কা মারেন মূর্তিতে। ১.৭০ মিটার দৈর্ঘ্যের মূর্তিটি মাটিতে ভেঙে পড়ে নিমেষে। যখন ওই পর্যটকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়, তারা বলেন মূর্তিটি বালি দিয়ে তৈরি এবং মেরামতের জন্য ন্যূনতম একটি অর্থসাহায্যের প্রস্তাব দেন পর্যটকেরা।
আরও পড়ুন-কারা, কীভাবে তুলেছিলেন ভারতের প্রথম সেলফি? তাক লাগাবে ১৮৮০ সালের এই ইতিহাস
গোলফেরিনি জানাচ্ছেন, স্থানীয় পুলিশের কাছে সেই ১৭ জন জার্মান পর্যটকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে, ভাস্কর্যটির যা ক্ষতি হয়েছে তা সবটা মেরামত করা যাবে না আর। মূর্তিটি ১৫০ বছরের পুরোনো। এই প্রাচীন মূর্তিটির বর্তমান মূল্য প্রায় ২০০,০০০ ইউরো। ফোয়ারার টাইলসের যে অতিরিক্ত ক্ষতি হয়েছে তাও মেরামত প্রায় অসম্ভব।
স্রেফ একটা সেলফি তুলতে গিয়ে এই ভয়াবহ বিপর্যয়! ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, সামান্য নিয়ন্ত্রণ রাখাও কি সম্ভব নয় এই সোশ্যাল মিডিয়ার আগ্রাসনের উপর? প্রতি মুহূর্তকে ধরে রাখতে গিয়ে আসলে কি আদৌ কোনও মুহূর্ত থেকে যাচ্ছে মানুষের স্মৃতিতে আজীবন? শুধু তো ইতালি নয়, প্রতি গলি, চৌরাস্তা, বাসে, অটোতে, প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তে, অপার্থিব পাহাড় দেখার সময় হোক বা প্রেমের মুহূর্ত- সব কিছু ক্যামেরাবন্দি করার এই সর্বনেশে তাগিদ এল কীভাবে? এল মানুষেরই ক্ষণিকের যাপনের হাত ধরে, এল মানুষেরই চিরকেলে থেকে সাময়িকের প্রতি আকর্ষণ থেকে। এল, নিজের থাকাটিকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করতে গিয়েই। তাতে জলাঞ্জলি যাক নিভৃতি, জলাঞ্জলি যাক দু'চোখ ভরে দেখার টান, চুলোয় যাক শরীরের আলাপ। যা কিছু ব্যক্তিগত, সবটুকুই নিয়ন আলোর তলে, এসো, ভোগী হয়ে ওঠো!

Whatsapp
