চরিত্রে অহিংস দেশ, প্রমাণ শাহরুখের ছবি-জীবন

Shah Rukh Khan Secularism India : ভোর হতে না হতেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সবাই। সেখানে কোনও হিন্দুত্ব নেই, কোনও ইসলামি ছায়া নেই। সেখানে নাম একটাই – ‘শাহরুখ খান’।

ষাটের দশকের শেষ দিকের কথা। খুব বেশি হলে সময়ের জল গড়িয়ে যেতে পারে সত্তর দশকের প্রথমার্ধের দিকে। সেন্ট্রাল দিল্লির রাজেন্দ্রনগর তখন জনবহুল হলেও, এত আধুনিক, বড় দোকানপাট ছিল না। চারদিকে হিন্দু বাড়িগুলির মধ্যে ছোট্ট একটি ভাড়াবাড়ি, সেখানে বসবাস করেন মীর তাজ মহম্মদ। মহল্লার একমাত্র মুসলিম পরিবার। একেবারে সাদামাটা, মধ্যবিত্ত সংসার। তাঁরই ছোট্ট ছেলে ‘মাইলা’ – পাড়ার ছেলেরা এই নামেই ডাকত ওকে। দুরন্ত, ছটফটে, শ্যামলা এই ছেলেটা বীভৎস জোরে দৌড়তে পারে। একেবারে ট্রেনের মতো… সেজন্যই এমন নাম। একমাত্র মুসলিম পরিবার হলেও কখনও সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়নি তাজ মহম্মদদের। আর মাইলা?

প্রতি বছর রাজেন্দ্রনগরে ঘটা করে জন্মাষ্টমী পালন করা হতো। আর সেই উৎসবে বারবার ‘ছোট্ট কৃষ্ণ’ সাজত মাইলা। ফুটফুটে, মিষ্টি, শ্যামলা রঙের ছেলেটা যখন কৃষ্ণ সাজত, মায়েরা যে কি খুশি হতো! ঠিক যেন গোকুল বৃন্দাবন নেমে এসেছে দিল্লির ওই অঞ্চলে। কেবল কি জন্মাষ্টমী! দশেরার দিন রামলীলার অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকত ‘মাইলা’র। রাম রাবণকে বধ করবে, এই দৃশ্য দেখার জন্য সবার আগে তৈরি থাকত সে। কখনও রামের সেনার ভূমিকায় অভিনয়ও করত, আবার সুযোগ পেলে মাইকের সামনে নিজের লেখা কবিতাও পড়ত। সমস্ত হিন্দুদের উৎসবে ছেলেটির উৎসাহ সবচেয়ে বেশি থাকত। আজও ‘মাইলা’র ছোটবেলার বন্ধুরা এসব কথা মনে করেন। ওহ, কথায় কথায় বলাই হয়নি, সেদিনের ‘মাইলা’ আজ গোটা দেশে রাজত্ব করছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশে। তিনি এখন জেন্টলম্যান, তিনি এখন ‘পাঠান’। তিনি আজ শাহরুখ খান! তবে বলিউডের ‘বাদশাহ’-এর ভেতর থেকে সেই ছোট্ট ‘মাইলা’ বোধহয় এখনও মরে যায়নি…

শাহরুখ খানের ছোটবেলার এমন গল্প, বড় বয়সের লড়াই – এসব কাহিনি তো গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু শাহরুখের শরীর থেকে একটা জিনিস বোধহয় এখনও মোছেনি। তাঁর পদবি যে ‘খান’, তিনি মুসলিম। তাই খুব সহজেই তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে ফেলা যায় ‘পাকিস্তানের দালাল’ শব্দটি। খুব বেশি পিছনে যেতে হবে না। ‘পাঠান’ সিনেমাটি মুক্তির আগেই শাহরুখ খানকে একের পর এক বঁড়শিতে বিদ্ধ করছিল ভারতের এক বিশেষ অংশ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির রোষে পড়েছিলেন তিনি। দীপিকা পাড়ুকোন কেন গেরুয়া বিকিনি পরেছেন? শাহরুখ খানও কেন ওরকম মাখোমাখো ব্যবহার করলেন? তাহলে এটাই রীতি?

‘বয়কট বলিউড’ – এই স্লোগান অবশ্য আজকের নয়; বারবার নানা ইস্যুতে ‘বয়কট’ই ভরসা দেশের একটা অংশের। সিনেমার পোস্টার ছিঁড়ে আগুনে পোড়ানো হয়, পোস্টারে শাহরুখের মুখে কালি লেপা হয়। দিনের শেষে নিট ফল? ‘পাঠান’ দেখার জন্য সিনেমাহলের বাইরে সারারাত ধরে অপেক্ষা করছেন ভক্তরা। সিনেমাহলের বাইরেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভোর হতে না হতেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সবাই। সেই লাইনের কোনও হিন্দুত্ব নেই, কোনও ইসলামি ছায়া নেই। সেখানে ধর্মের নাম একটাই – ‘শাহরুখ খান’। বাদশাহী ধর্মের ‘রাজ’ সেখানে। হাওয়ায় হাওয়ায় কেবল ‘বয়কট’ ঘুরতে থাকলে মাত্র দু’দিনেই ২০০ কোটির অঙ্ক পার করত না ‘পাঠান’।

শাহরুখ খানের সিনে কেরিয়ারের দিকে একটু তাকানো যাক। তাঁর নিজস্ব একটি ধরন রয়েছে। সেই ধরনে ঢুকে পড়েছে দেশভক্তিও। কিন্তু সেই দেশভক্তিকে কখনও জাহির করতে হয়নি, সেখানে কোনও অতিশয়োক্তি নেই। ব্যানার নিয়ে বলতে হয়নি, হ্যাঁ দেখুন, আমিই ‘সাচ্চা দেশভক্ত’। ‘স্বদেশ’-এর বার্তা, ট্রেনের বাইরে মাটির ভাঁড়ে জল বিক্রি করা বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে শাহরুখের চোখ ছলছল, সেগুলোকে ঠিক কী বলে অভিহিত করবেন? কিংবা ‘মাই নেম ইজ খান’… মুসলিম পদবি মানেই বাঁকা চোখে তাকানো, সবসময় সন্দেহ, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে থাপ্পড় ছিল শাহরুখের ডায়লগ। ‘মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আই অ্যাম নট আ টেররিস্ট’। ‘চক দে ইন্ডিয়া’ থেকে আজকের ‘পাঠান’ – কোথাও জাহির করে বলতে হয়নি দেশভক্তির কথা। প্রতিটা জায়গায় ভেতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে সেই ঢেউ… স্বতঃস্ফূর্ত সেই আবেগ।

‘রইস’-এর সেই ডায়লগ মনে আছে? ‘কোই ধান্দা ছোটা নহি হোতা, অউর ধান্দে সে বঢ়া কোই ধরম নহি হোতা’। আচ্ছা, এটাকেই যদি একটু উল্টে দেওয়া যায়? ধরম সে বঢ়া কোই ধান্দা নহি হোতা! রে রে করে উঠবে বর্তমান ভারত। অসহিষ্ণুতা… একজন সচেতন শিল্পী হিসেবে বারবার এর প্রতিবাদ করেছেন শাহরুখ খান। ‘আজ তক’-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন কিং খান। “আমরা সবাই দেশভক্ত। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে, দেশের প্রতিটা প্রান্তের মানুষ এই দেশকে ভালোবাসেন। যারা সত্যিকারের দেশভক্ত, তাঁরা কখনও নিজেকে জাহির করেন না। উঁচু গলায় বলে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় না। আমরা ভাগ্যবান যে, এই দেশে জন্মেছি। এখানে বেড়ে উঠেছি। আমরা এতটাই ‘সাচ্চা দেশভক্ত’ যে, কোনও সমস্যা, কোনও শক্তি আমাদের মাঝে আসতে পারবে না।”

হ্যাঁ, এটাই শাহরুখ খান। যিনি ছোটবেলা থেকে দেখেছেন, তাঁর মা ফাতিমা লতিফ রামজানের উপোসও করছেন; পাশাপাশি বাড়িতে থাকা জগন্নাথ দেবের ছবির সামনে ভক্তিভরে পুজো করছেন। ঈদের সময় পটকা ফাটাচ্ছেন, আবার দীপাবলির সময় সিমুই রেঁধে বাড়ি বাড়ি দিচ্ছেন। সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাইকে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে শাহরুখ বলছেন, তিনি সেন্ট কলম্বাস স্কুলে পড়েছেন। সেটি একজন খ্রিস্টান ক্যাথলিক চালান। তিনি সেইসময় কোরানও পড়েছেন, বাইবেলও পড়েছেন। পাশাপাশি ছোট থেকেই বেড়ে উঠেছেন রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের গল্প পড়ে। সাংবাদিক রাজদীপ তখন বলেন, আপনাদের পরিবার তো গোটা ভারতের অনুপ্রেরণা। শাহরুখের সটান জবাব, “অনুপ্রেরণা কেন? ভারতের মতো দেশে এটাই তো স্বাভাবিক!”

হ্যাঁ, ঠিকই। এটাই স্বাভাবিক। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ভারতের সংস্কৃতি সেই কথাই বলে। চৈতন্যদেবের শিষ্য হন যবন হরিদাস, মুঘল দরবারে পালন করা হয় হোলি, দীপাবলি। শাহরুখ খানের বাবা, তাজ মহম্মদ নিজে ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আব্দুল গফফর খানকে অনুসরণ করতেন তিনি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলও খেটেছেন তাজ মহম্মদ। আর তাঁর তুতো ভাই ছিলেন শাহনওয়াজ খান, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিশ্বস্ত সহচর। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সেনা জেনারেল। উল্লেখ্য, আজাদ হিন্দ ফৌজের পতনের পর তাদের তিন জেনারেলের বিচারসভা বসেছিল লাল কেল্লায়। সেই ঐতিহাসিক বিচারের তিন সেনানায়কের একজন ছিলেন এই শাহনওয়াজ খান। দেশভাগের পর খোদ তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কালো তালিকায় চলে গিয়েছিল শাহরুখের পরিবার। পূর্বপুরুষের ভিটে পেশোয়ার থেকে চলে আসতে হয় অনেককে।

‘রইস’ মুক্তির পর সেই শাহরুখ খানকেই শুনতে হয় ‘পাকিস্তানের দালাল’ তকমা। সেই সময় উরিতে জঙ্গি হামলা হয়। এদিকে ‘রইস’ ছবিতে শাহরুখের সঙ্গে কাজ করেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী মাহিরা খান। সেটা নিয়েই শুরু হয় বিক্ষোভ। পাকিস্তানের জঙ্গিরা হামলা চালাবে, আর আমরা সেখানকার শিল্পীদের কাজ দেব? এই ভিড়ে রোষের মুখে পড়েন শাহরুখ খানও। মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার বিক্ষোভের জেরে রাজ থাকরের বাড়ি গিয়ে তিনি কথা দিয়ে আসেন, মাহিরা সিনেমার কোনও প্রচারে থাকবেন না।

নিজের ৫০ তম জন্মদিনে ‘ইন্ডিয়া টুডে’র অনুষ্ঠানে রাজদীপ সারদেশাইয়ের মুখোমুখি হন শাহরুখ খান। তখন উঠে আসে এই অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ। সেখানে শাহরুখ সরাসরি বলেন, ‘চারিদিকে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। কেউ কিছু বলার আগে এক মুহূর্তও ভাবে না। এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এসব সমর্থন করে না… তুমি যদি সত্যিকারের দেশভক্ত হও, তাহলে তোমায় সেক্যুলার হতেই হবে। ভারত সবসময় ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী শেখায়।’ এনডিটিভিকে দেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক বরখা দত্তকে শাহরুখ বলেন, “আমরা যত ধর্ম নিয়ে কথা বলব, তত অন্ধকারের দিকে যাব। আমরা যদি নিজেদের না বদলাই, তাহলে সামনে বিপদ আসতে চলেছে… যে সত্যিই ভারতকে ভালোবাসে, সে গোটা দেশটাকে একসঙ্গে নিয়ে ভালোবাসে। সমগ্র দেশটাকেই বুকে আগলে রাখে। দেশকে টুকরো করে, দেশের আলাদা আলাদা অংশকে ভালোবেসে নয়।”

আরেকটি সাক্ষাৎকারে শাহরুখ খান তুলে ধরেছিলেন তাঁর নিজের ভারতের ছবিটা। তিনি বলছিলেন, "ভারত দেশটা নিজেই একটি শিল্প, দেশটা নিজেই একজন শিল্পী। এই দেশে কিছুতেই এমন কিছু থাকতে পারে না, যা সবাইকে আলাদা করে। কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদ, কোনও ধর্ম এই দেশটাকে আলাদা করতে পারবে না। It Cannot have any Dividing Religion... শিল্পের কোনও ধর্ম থাকে না। আমাদের দেশেরও কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম নেই। সমস্তকিছু একসঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। আমরা সবাই অহিংস, আমরা মনুষ্যত্বে বিশ্বাসী। আমরা, ভারতীয়রা কখনও হিংসায় বিশ্বাস করি না। আমরা লড়াই করি না।" এই কথাগুলো বলার সময় শাহরুখের চোখে মুখে এক অদ্ভুত হাসি, আলো ফুটে উঠেছিল। একেবারে মনেপ্রাণে বিশ্বাস না করলে এই কথাগুলো এভাবে বলা যায়? 

এরপর শাহরুখ খানকে কী শুনতে হয়? ‘গো টু পাকিস্তান’, ‘সবাই ওর সিনেমা বয়কট করবে, সাধারণ মুসলিমের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে’। এমনকী এও শুনতে হয় যে, তিনি নাকি হাফিজ সইদের মতো কথা বলছেন’। জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তইবার সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হল শাহরুখ খানের নাম। যে শাহরুখ বারবার ধর্মের ঊর্ধ্বে শিল্পকে, মানুষকে বেছেছেন। তাঁর ফ্যানেরা তাঁকে সবসময় আগলে রেখেছেন। মুসলিম না হিন্দু, না খ্রিস্টান – এই ভেবে সিনেমা করেননি তিনি। ঈদের পাশাপাশি তাঁর বাড়ি ‘মন্নত’ সেজে ওঠে দীপাবলি, গণেশ পুজোর দিনেও। তিনি বড় হয়েছেন এমন একটি পরিবারে, যারা সবসময় দেশকে আগে প্রাধান্য দিয়েছে, ধর্মকে নয়। যে পরিবারের সদস্যরা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ে গিয়েছেন। যে মুসলিম ছেলেটি কৃষ্ণ সাজতে ভালোবাসে, জগন্নাথের পুজো করে। শাহরুখ খানের মতো মানুষরাই তো আসলে ভারতের আসল মুখ, ভারতের আসল সংস্কৃতি সামনে আনেন। নিজের জীবন, কাজ, পরিশ্রম দিয়ে দেশকে মাতিয়ে রাখেন। বয়কট গ্যাংয়ের ঝড় উঠলেও তাঁর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন আট থেকে আশি। পর্দায় তাঁকে দেখলে সিটি পড়ে, চিৎকার আর হাততালির ঝড় ওঠে। সেখানে কোনও ধর্মের নাম লেখা থাকে না। সেখানে কোনও জাতপাতের রং লেগে থাকে না। গেরুয়া না সবুজ – জিজ্ঞেস করে না কেউ। সেখানে একটাই নাম, একটাই ধর্ম – শাহরুখ খান। আর সবকিছুর পেছনে উড়তে থাকে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা।

More Articles