নক্ষত্রের অবসর নেই, খুচরো জনতার খড়কুটো আজীবন শাহরুখই
Shah Rukh Khan: শাহরুখের অবিশ্বাস্য সব কেরামতি দেখে আপনা থেকেই হাত জড়ো হয়ে আসছে, অনন্ত দর্শকবৃন্দ দোয়া করছে, “হে নক্ষত্র, সব ঠিক করে দাও"।
আমরা হেরে যাওয়া দেশের খুচরো পয়সা। ফিরতি বাসের পাদানিতে ঝুলে থাকা অতিরিক্ত যাত্রী। বেছে বেছে সস্তা সবজি কেনার ভিড়ে আমাদের শৈশব-যৌবন লাট খেয়ে যায়। যেটুকু খায় না, সেটুকু ছলছল করে। অচেনা শহরে গুঁতো খেতে খেতে, আখাম্বা বাড়ির থেকে ধেয়ে আসা থুতু খেতে খেতে, কোনওদিন ডানা না পাওয়ার গ্লানি নিয়ে হেরে যাওয়া মানুষেরা ইবাদত করেন। সম্ভাবনার মহাকাশ থেকে একটি নক্ষত্র খসে পড়ে। খসে পড়া তারা এই অনুজ্জ্বল এক তৃতীয় বিশ্বের টেলিভিশন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে, সিনেমাহলের পর্দা ছিঁড়ে ঠিকরে আসে। মানুষের মুখোমুখি দাঁড়ায় দু'হাত ছড়িয়ে। আপামর দেশ সেই খোলা হাতে, খোলা বুকে নিজেকে সেঁধিয়ে দিতে চায়। খুচরো পয়সারা জলতরঙ্গ হয়ে বেজে উঠতে চায়। সারা দেশ সেই নক্ষত্রের সিম্ফোনি শুনতে পায়, ইবাদতে সাড়া দিয়ে নেমে আসে এক 'আইকন'। সারা দেশ এক চওড়া নাক, বক্র ভ্রূ, টোল পড়া গালের কাছে হাঁটু মুড়ে নিজের কলিজা বের করে দেয়। এর পর আর কোনও নক্ষত্র নেমে আসে না। আকাশ শূন্য, মাটিতে শাহরুখ খান, দ্য লাস্ট স্টার অব দ্য স্টারস!
ভূগোলের ফাঁকে উঁকি মারা শাহরুখ খান, গলা কাঁপিয়ে অজস্র যুবতীদের কামনা হয়ে ওঠা শাহরুখ খান, বাড়ির বারান্দা থেকে দেশের মানুষদের ভালোবাসা বিলনো শাহরুখ খান নিজেই এক দেশ হয়ে ওঠেন। দিল্লির পাঠান পরিবার, স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবা, ক্যান্সারে মৃত্যু, বাবার পরে মায়ের চলে যাওয়া, বোনের অবসাদ, অভিনয় করতে স্বপ্ননগরীতে আসা- খুচরো পয়সাদের গল্প যেমন হয়, তেমনই। নিজেকে নিজে টস করতে করতে এগোতে হয়। কোন গাড্ডায় হেড পড়ে, কোন গাড্ডায় জীবন লেজ গুটিয়ে পালাতে বলে এসব জানা থাকে না। শুধু জানা থাকে অচল সিক্কা হওয়ার পথ নেই কোনও, লড়ো অথবা মরো। শাহরুখ লড়লেন। ঘরের ছেলের মতোই দেশ ভালোবেসে ফেলল টেলিভিশনের চরিত্রকে। ছোট পর্দার তেলাপিয়া সাগরে চলল। হাঙরে-ঢেউয়ে ডরায় না, কৌশলে বাঁচতে শেখে, শেখায়ও। তেলাপিয়া বহরে ছোট, ভাবে হয়ে উঠল খলনায়ক! তার চোখ কথা বলল, ফুলো ফুলো ঠোঁট রক্তে মাখো মাখো হয়ে গেল, সমুদ্রের প্রজারা দেখল রাজা নয়, নয়া ভিলেন এসেছে। অ্যান্টি-হিরো হয়ে দেশকে ভয় পাইয়ে দিলেন শাহরুখ। হিরো হয়ে কাঁদলেন। নিডর নায়ক নয়, প্রেমে ভেঙে পড়া বিরহী হয়ে উঠলেন শাহরুখ। প্রেমকে বললেন, কাঁদো, পুরুষদের বললেন ব্যথা পাও। আকুল হয়ে উঠল দেশের প্রেমিককুল। সমুদ্রের প্রজারা দেখল, নায়ক নয়, প্রেমিক এসেছে অকূল গহিনে।
আরও পড়ুন- “তুমি নেশাগ্রস্ত, তাই ঝামেলা করেছ”, কেন শাহরুখ খানকে বলেছিলেন বিগ বি?
মধ্যবিত্ত খুচরো পয়সারা যখন রিটায়ারমেন্টের ফাইল গোছাচ্ছেন, সেই তখন, জীবনের ৫৭ টা বছর পার করে শাহরুখ হালে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রোম্যান্স, কমেডি, ফ্যামিলি ড্রামা অনেক হলো। এবার তিনি অ্যাকশনই করবেন। গাঁটের ব্যথা, আলস্য, বার্ধক্যরা রাস্তা ছেড়ে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকেছে রাজাকে। ভারতবর্ষে যে এরপর আর কোনও সুপারস্টার আসবে না, ঠারে ঠারে বুঝিয়ে দিয়েছেন সেই নক্ষত্র। কেন আসবে না? ভারতের আকাশ কি শাহরুখের দুই বাহুর মধ্যে এঁটে যাওয়ার মতোই ছোট? উত্তর দিয়েছে শাহরুখের জীবন। ভারতবর্ষ চিরকালই 'আইডল' মুখী দেশ। রাজনীতিতে, প্রেমে, সমাজে, বিপ্লবে জনগণ একজনকেই খোঁজে। দ্য গ্রেট হিরো আর্কিটাইপ? হবেও বা। গ্রেট হিরো আসলে মুশকিল আসান। গ্রেট হিরো দেশের নাড়ি না টিপেই বুঝে যাবেন পথ্য কী, দাওয়াই কী। প্রবল ঘৃণার মধ্যে সেই গ্রেট হিরো দু' শতাংশ প্রেম মিশিয়ে দেবেন। তীব্র মন খারাপের মাঝে ঝিনচ্যাক সিরাপ খাইয়ে দেবেন। দেশের সবচেয়ে অশান্ত নগরীতে গড়ে তুলবেন আরোগ্য নিকেতন। জনসংখ্যা আস্তে আস্তে নতজানু হবে, প্রণামের মতো থিতু হবে, নমাজের মতো শান্ত। রোজের জীবনের বিরক্তি, হতাশা, ভয়, অনিশ্চয়তা থেকে টান মেরে তুলে নেবে গ্রেট হিরোর হাত। শাহরুখ কি ততটা হিরো হয়েছেন? যদি না হন, চরম অসহিষ্ণুতার মধ্যে কী করে জিতে যান বারবার! দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের বয়কটের ডাককে কী করে এতটা অগ্রাহ্য করতে পারেন? শাহরুখ বলছেন, বয়কটের কথা শুনেছেন তিনি। কিন্তু তিনি তো চারাগাছ নন। চারাগাছ হলে ছাগলে মুড়িয়ে দেওয়ার ভয় থাকে, হাওয়াতে নুয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি যে কে, তা না বলেও বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন। রাজনীতির আসনের মেয়াদ ৫ বছর, নক্ষত্রের কোনও আসন নেই, সমগ্রটাই তাঁর নিজস্ব রচিত বিশ্ব।
শাহরুখের মধ্যে এমন কী দেখল ভারতবর্ষ? ভাঙাচোরা দেশকে এক পাঠান দেখাল মূল্যবোধ, মুম্বইয়ে মাটি খুঁজতে আসা যুবক দেখাল বাস্তববাদ, মুখচোরা দেখাল প্রেম আর দায়িত্ববোধের আখ্যান, একজন সফল মানুষ দেখাল নম্রতা। যা যা দেশ খুঁজেছে তন্ন তন্ন করে, নিজের চারপাশে হারিয়ে যেতে দেখেছে, ঘা খেতে খেতে মলম জোটেনি যে মানুষদের, সকলের সম্মিলিত কামনা একজন নক্ষত্রকে গড়েছে। ভাববাদের নৌকোয় শাহরুখ চড়েননি। বারেবারে বলেছেন, টাকা দরকার। সৎ পথে অর্থ উপার্জন করা দরকার। জীবনে টাকার কীই বা মূল্য জাতীয় ভাববাদের জুতোয় ঘা খাওয়া শাহরুখ পা গলাননি। দেখেছেন টাকা দরকার, যুব সম্প্রদায়কে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, সৎ রোজগারের জ্ঞানই দিয়েছেন। চাকরিপ্রার্থী যুবক-যুবতী সুপারস্টারের মধ্যে সেই কাজ খোঁজা বেকারের সন্ধান পেয়েছে। নিজেকে আয়নায় রেখেছে, তাতে এসে পড়েছে শাহরুখের ছায়া। হাত ছেড়ে চলে যাওয়া প্রেম কান্নায় গলে পড়া জ্যোৎস্নায় শাহরুখের ধুক-পুক শুনেছে। শাহরুখ পর্দায় নিজেকে রোগে মেরেছেন, দেশ কান্নায় ভিজে গেছে। প্রেমে পড়া প্রতি যুবতী শাহরুখের চূড়ান্ত নমনীয়তার মধ্যেই যৌনতার পাঠ বুঝেছে। প্রেমিকের থেকে আগ্রাসন নয়, নরম চুম্বন চেয়েছে, পাগলামি চেয়েছে, নিষ্পাপ স্বীকারোক্তি চেয়েছে, প্রতিটা চাওয়ার মধ্যে শাহরুখ, প্রতিটা কামনার মধ্যে শাহরুখ, প্রতিটা ইচ্ছেপূরণের নাম হয়েছেন শাহরুখ। পর্দায় তিনি এলে আজও দেশ জানে, বাঁচতে হবে। ক্যায়া পাতা, কাল হো না হো!
শাহরুখ খানের 'শিভ্যালরি' বহুশ্রুত। বাড়িতে মেহমান এলে নিজে হাতে দরজা খোলেন, নীচে নেমে গাড়ি অবধি এগিয়ে দেন। যতক্ষণ না গাড়ি চোখের আড়াল হচ্ছে তাকিয়ে থাকেন। মহিলাদের প্রতি তাঁর আচরণকে বিরলতম ধরলেও আজকাল কমই বলা হয়। অথচ এই 'শিভ্যালরি'র মধ্যে কোথাও কোনও 'পুরুষ' নেই। ছেলেকে নিয়ে বিতর্কে যে সুপারস্টার বিনিদ্র রাত কাটান, তিনি নক্ষত্রের খোলস থেকে বেরনো এক প্রাজ্ঞ পিতা। কোনও বাদশা নয়, কিং নয়, পরিবারের পাশে থাকা এক আশ্বাস, দেশকে 'ম্যায় হুঁ না' বলে ভরসা জোগানো এক সনাতন পিতা হয়ে ওঠেন শাহরুখ। একবার এক সাক্ষাৎকারে শাহরুখকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল, এই যে শাহরুখ আর সাধারণের জীবন কখনই কাটাতে পারবেন না, এই যে ভিড় থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে এখন তাঁকে বিদেশেই আসতে হবে, এসব কেমন লাগে তাঁর? শাহরুখ বলেছিলেন, তিনি এটাই চেয়েছিলেন। যা চেয়েছিলেন তাই করেছেন। সাধারণের জীবন চাননি। সেই কোন কালে, ১৯৯৭ সালের ইয়েস বস সিনেমাতেই বলে দিয়েছিলেন, “যো ভি চাঁহু, ওহ ম্যায় পাউ, জিন্দগি মে জিত যাঁউ, বাস ইতনা সা খোয়াব হ্যায়।" তখনও তো স্টার হননি তিনি, ছোট্ট স্বপ্ন বলে যা যা বলেছিলেন আসলে সবটাই উচ্চাকাঙ্খা। বারেবারে শাহরুখ তাঁর মায়ের একটা কথা বলেন। হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে, যতটা চাদর, ততটাই পা মেলো। শাহরুখের মা বলতেন, পা তো কোনওদিনই বাড়বে না, চাদরটাকেই বড় করো। শাহরুখ বড় করলেন, শাহরুখের সেই চাদরতলে আস্ত একটা দেশ আশ্রয় পেল, একাধিক প্রজন্ম মাথার উপর বিশ্বাসযোগ্য শামিয়ানা পেল। আর শাহরুখ, “সারি দৌলত, সারি তাকত, সারি দুনিয়া পর হুকুমত"-এর ইতনা সা বস্তুবাদী খোয়াব পূরণ করে ফেললেন।
আরও পড়ুন- সবাই জানেন ‘আজগুবি’ সিনেমা! তাও কেন ভারতবর্ষে চিরকাল জিতে যান শাহরুখ খান?
৪ বছরের শীতঘুম শেষে যখন নক্ষত্র জেগে উঠছে, ঝড় উঠছে তখন দেশ জুড়ে। নক্ষত্রের আঁচ ও আভায় রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে নেতিয়ে পড়া মানুষদের। উগ্রতার ময়দানে কোণঠাসা হওয়া সংখ্যালঘুদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফেরাচ্ছেন শাহরুখ। কাশ্মীর বা দেশপ্রেমের কথা বলতে হচ্ছে তাঁকে। আসলে যাদের রোজ প্রমাণ দিতে হয় দেশকে তারাও ভালোবাসেন, তাঁদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে এই পথে। অমিতাভের পরে একক জনপ্রিয়তা আর কতজনই বা ধরে রেখেছেন এভাবে? কার সাহস আছে, নিজের বাড়ির নামফলকে লিখে রাখার, 'ল্যান্ডস এন্ড’! এখানে জমি শেষ, এখানে অগাধের শুরু। যে অগাধে একদিন তেলাপিয়া হয়ে এসেছিলেন শাহরুখ। তারপর তারায় তারায় রটিয়ে দিয়েছেন, এই জলরাশি, এই জনরাশি তাঁর। তিনিই নির্জন প্রাণের সখা, প্রেমহীন ম্রিয়মাণ মানুষের শেষ সহায়। একজন তারকাকে দেখতে ঘরদোর ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন বোরখা ঢাকা ইচ্ছারা, সারাদিন খদ্দের না পাওয়া হকার দৌড়ে আসছেন, চাকরি না পাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকারা হেঁটে আসছেন, বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া মুখরা জড়ো হচ্ছে, এমনকী চরম ঘৃণা লালন করা চরিত্ররাও গুটি গুটি এগিয়ে আসছে। সকলে মিলে ক্ষণিকের জন্য গ্লানি-রাগ-বিতৃষ্ণা ভুলে ঠাসা সিনেমা হলে উদ্দাম নাচছে অচেনা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। শাহরুখের অবিশ্বাস্য সব কেরামতি দেখে আপনা থেকেই হাত জড়ো হয়ে আসছে, অনন্ত দর্শকবৃন্দ দোয়া করছে, “হে নক্ষত্র, সব ঠিক করে দাও"। চরম বিপজ্জনক চুড়ায় বসে, পাঠান আর ভাইজান বলছে, বাচ্চারা কিছু পারবে না, যা করার তাঁদেরই করতে হবে।
দেশ কোনও রাজনৈতিক নেতার ৫৬ ইঞ্চি ছাতি চায়নি, এমন একজন মুশকিল আসানই চেয়েছিল।