গ্রিক না সংস্কৃত? 'কেন্দ্র' শব্দের উৎস নিয়ে যে ঝগড়া লেগেই আছে
Bengali Vocabulary: কেন্দ্র-র ব্যুৎপত্তি নিয়ে স্পষ্টতই দু'টি মত দেখা যাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিধান গ্রিক Kentron-এর পক্ষ নিলেও, কয়েকটি প্রামাণ্য অভিধান সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির পক্ষে।
এবারের শব্দ 'কেন্দ্র'। বাংলা পাঠ্যপুস্তকে গ্রিক থেকে বাংলায় আসা শব্দের মধ্যে কেন্দ্র, সুড়ঙ্গ আর দাম থাকবেই। এটা যেন এক রেটোরিক, টেরাকোটা বললেই ল্যাটিন ব্যুৎপত্তি মনে আসার মতো, অন্য কোনও ব্যুৎপত্তি হতে পারে কি না, কারও ভাবনাতেই আসে না। এটা অভিধানের প্রভাব, না অভিধান নিজেই প্রভাবিত, তা বোঝা দায়।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ যেমন কেন্দ্র-র ব্যুৎপত্তিতে গ্রিক Kentron, ল্যাটিন ও ফরাসি Centrum-কে টেনে আনা হয়েছে। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই আবার সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, 'কিং কুর্ব্বন্তি গ্রহা সর্বে যস্য কেন্দ্রী বৃহস্পতিঃ'। অর্থাৎ যার কেন্দ্রে বৃহস্পতি অবস্থান করছে, অন্য গ্রহে তার কী ক্ষতি করবে! তাহলে সংস্কৃতের ন্যায্য দাবিকে স্বীকৃতি না দিয়ে হরিচরণবাবু গ্রিকের দাবি মেনে নিলেন কেন? ওই যে বললাম, বহুযুগলালিত ভাষাতাত্ত্বিক ধারণা!
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস প্রণীত 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ কেন্দ্রর ব্যুৎপত্তিতে পরিষ্কার লেখা হয়েছে 'সংস্কৃত'। জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যায় কেন্দ্র শব্দটির গুরুত্ব আলোচনা-সহকারে বোঝানো হয়েছে। কেন্দ্র থেকে উদ্ভূত শব্দগুলিও সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। কেন্দ্রগত, কেন্দ্রবিমুখ, কেন্দ্রবিমুখ বল, কেন্দ্রস্রোত, কেন্দ্রাতিগ, কেন্দ্রাতিগক্রিয়া, কেন্দ্রাতিগাকর্ষণ, কেন্দ্রাপসারী বল, কেন্দ্রাভিকর্ষী বল, কেন্দ্রাভিমুখ বল, কেন্দ্রাপসারিণী শক্তি, কেন্দ্রাভিকর্ষিণী শক্তি। পদার্থবিদ্যার ছাত্ররা উপকৃত হতে পারেন।
আরও পড়ুন: ‘চিনি’-র দখল চিনের? স্বাদে মিষ্টি, কিন্তু শব্দের ভেতর লুকিয়ে জটিল রহস্য
সংসদ বাংলা অভিধানে 'কেন্দ্র' গ্রিক Kentron থেকে সংস্কৃত হয়ে বাংলায় এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসু বিশ্বকোষে নির্দ্বিধায় জানাচ্ছেন, গ্রিক Kentron থেকেই বাংলায় কেন্দ্র এসেছে। যদিও তিনিও সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। যেমন, 'বৃত্তস্য মধ্যং কিল কেন্দ্রযুক্তং কেন্দ্রং গ্রহোচ্চান্তরমুচ্যতে হ'তঃ। যতোহ'ন্তরে ভাবতি তুঙ্গাদেশায়ীচোচ্চবৃত্তস্য সদৈব কেন্দ্রম্।' আরও লিখেছেন, 'কেন্দ্রং চতুষ্টয়ং কণ্টকঞ্চ লগ্নান্তদশচতুর্থানাং সংজ্ঞা।' তবু তিনিও কেন যে কেন্দ্রের প্রতি সংস্কৃত ভাষাবিদদের বঞ্চনাটি ধরতে পারলেন না!
সুবলচন্দ্র মিত্র, আদর্শ বাঙ্গালা অভিধানে কিন্তু কেন্দ্র-র পরিষ্কার সংস্কৃত ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন। লিখেছেন, 'ক-মধ্যে ইন্দ্র, সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস। বিশেষ্য, ক্লীব।' 'চলন্তিকা'-য় রাজশেখর বসু কেন্দ্র-র ব্যুৎপত্তিতে লিখেছেন, 'গ্রিক Kentron হইতে সংস্কৃতে'। চলন্তিকা-ও চলতি হাওয়ার পন্থী এখানে।
সুবলচন্দ্র মিত্রই আবার সরল বাঙ্গালা অভিধানে 'কেন্দ্র' ব্যাপারটি নিয়ে গোলগাল ভাষায় লিখেছেন,
বৃত্তাদি গোল বস্তুর ঠিক মধ্যস্থল; সূর্য হইতে গ্রহাদির দূরত্ব; লগ্ন; লগ্ন হইতে চতুর্থ, সপ্তম ও দশম স্থান; মেরু,পৃথিবীর প্রান্ত; মূল বা প্রধান জায়গা, আড়ং। বি; ক্লীব।।
বলা বাহুল্য, ব্যুৎপত্তি দেননি।
জামিল চৌধুরী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা অভিধানে কেন্দ্র-র ব্যুৎপত্তি গতানুগতিক। লেখা হয়েছে, [গ্রি.kentron > ]। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত (সহসম্পাদক- স্বরোচিষ সরকার) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে কেন্দ্র-কে পুরোপুরি সংস্কৃতজাত শব্দ বলে দাবি করা হয়েছে। প্রয়োগদৃষ্টান্তও দেওয়া হয়েছে। যথা, 'আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিঃশ্বাস দাও পুরে', লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯১৬ সালে। ১৮৪১-এ অক্ষয়কুমার দত্ত যেমন লেখেন, নাভির শেষ ভাগকে কেন্দ্র কহা যায়।
তাহলে, কেন্দ্র-র ব্যুৎপত্তি নিয়ে স্পষ্টতই দু'টি মত দেখা যাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিধান গ্রিক Kentron-এর পক্ষ নিলেও, কয়েকটি প্রামাণ্য অভিধান সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির পক্ষে। সংস্কৃত অভিধানে কিন্তু কেন্দ্র শব্দটি স্বমহিমায় বিরাজ করছে। সেখানে কেন্দ্রকে নিজস্ব ভাষাভাণ্ডারের শব্দ বলেই দাবি করা হয়েছে, বিজাতীয় প্রভাবের উল্লেখ নেই।
বামন শিবরাম আপ্তের The Practical Sanskrit -English Dictionary-তে পাচ্ছি কেন্দ্র শব্দটি। অর্থ, Centre of a circle। রাধাকান্ত দেব বিরচিত সংস্কৃত অভিধান 'শব্দকল্পদ্রুম'-এও 'কেন্দ্র' শব্দটি পাচ্ছি। অর্থ, 'গোলস্য মধ্যস্থানম্'। বুঝতে পারছি না, কেন্দ্র-র ব্যুৎপত্তিতে অহেতুক গ্রিককে টেনে আনা হলো কেন? তাহলে তো আর্মেনিয়ানকেও টেনে আনতে হয়! এই ভাষাতেও তো কেন্দ্রর ট্রান্সলেশন করলে Kentron--ই পাওয়া যাচ্ছে। সংস্কৃত থেকেই যে অন্য ভাষায় যায়নি, সেটা কীভাবে নির্ণয় করা যাবে? কেন্দ্র-র তৎসম ব্যুৎপত্তির সূত্র সুবলচন্দ্র মিত্র ধরিয়ে দিয়েছেন আদর্শ বাঙ্গালা অভিধানে। কিন্তু ব্যাখ্যাটি দেননি। মিসিং লিঙ্কটি ধরতে পারেননি।
আমার নিজস্ব ব্যাখ্যাটি দিই এবার। সুবলবাবু 'ক-মধ্যে ইন্দ্র' লিখেছেন ব্যুৎপত্তিতে। এভাবেও বলা যায়, 'ক+ইন্দ্র = কেন্দ্র'। 'ক' শব্দের অর্থ ব্রহ্মা, সূর্য। ইন্দ্র যেমন দেবরাজকে বোঝায়, তেমনই ইন্দ্র দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম। দ্বাদশ আদিত্য সূর্যেরই এক-একটি রূপ। অন্য এগারোটি রূপ হল, ধাতা, অর্য্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান, পূষা, পর্জ্জন্য, ত্বষ্টা ও বিষ্ণু।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সূর্য ও আদিত্যবিশেষ ইন্দ্রকে নিয়েই কেন্দ্র। বাস্তবিকই সূর্যকে কেন্দ্র করেই গ্রহগুলি প্রদক্ষিণ করছে। সৃষ্টির পুরোধাদেবতা ব্রহ্মা। 'ক' মানে তাঁকেও বোঝায়। সৃষ্টির কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস হয়ে তিনিও বিরাজ করেন। অর্থ, ব্রহ্মা ও সূর্যের একত্রিত তেজ সৃষ্টিকেন্দ্রে বিরাজিত।
কেন্দ্র নিয়ে লিখতে বসে বহুদিন আগে পড়া W.B. Yeats-এর Second Coming-এর একটি পঙক্তির উদ্ধৃতি দিতেই হয়, 'Things fall apart, the centre can not hold.' Yeats-এর কথা যখন উঠল, তখন তাঁর বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার অংশ বলতেই হচ্ছে। Yeats-ই তো কবিগুরুকৃত গীতাঞ্জলির ইংরেজি তরজমা একটু দেখেটেখে দিয়েছেলেন নোবেলপ্রাপ্তির আগে।
'সেঁজুতি' কাব্যগ্রন্থের 'চলতি ছবি' কবিতার একটি অংশ–
আলোক তাহার, দাহন তাহার, তাহার প্রদক্ষিণ
যে অদৃশ্য কেন্দ্র ঘিরে চলছে রাত্রিদিন
তাহা মর্তজনের কাছে
শান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে।
যেমন শান্ত যেমন স্তব্ধ দেখায় মুগ্ধ চোখে
বিরামহীন জ্যোতির ঝঞ্ঝা নক্ষত্র-আলোকে।
কিংবা 'স্ফুলিঙ্গ'-র ১৭২ নং কবিতা–
...লক্ষকোটি আলোকবছর-পারে
সৃষ্টি করার যে বেদনা
মাতায় বিধাতারে
হয়তো তারি কেন্দ্র-মাঝে
যাত্রা আমার হবে–
অস্তবেলার আলোতে কি
আভাস কিছু রবে?
রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা শেষ না হলে রাজ্যগুলি ওভারড্রাফ্ট নেয়, কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু কেন্দ্রর ব্যুৎপত্তি নিয়ে অভিধানে অভিধানে যুদ্ধ চললে, কেন্দ্রকেই শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়। কেন্দ্র যে আমাদের ভাষাচেতনাকে কতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেটা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার নামকরণেই স্পষ্ট। জেলা শিল্পকেন্দ্র, বাংলা সহায়তা কেন্দ্র, পাসপোর্ট সেবাকেন্দ্র, জাতীয় তথ্যকেন্দ্র, অগ্নিনির্বাপণ কেন্দ্র, সাইবার স্বচ্ছতা কেন্দ্র, কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র, ভূমিপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আধার সেবাকেন্দ্র, গ্রাহক সেবাকেন্দ্র, শিল্প কারিগরি সহায়তাকেন্দ্র, জাতীয় সূচনাবিজ্ঞান কেন্দ্র– ইত্যাকার হরেক রকমের কেন্দ্র আমাদের সেবা-সহায়তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
ভূমিকম্পের এপিসেন্টার, ঘূর্ণিঝড়ের আই, এগুলোও তো এক ধরনের কেন্দ্র। তার ওপর কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত, রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা, কেন্দ্রের প্রতি রাজ্যের বিষোদ্গার– এসব তো চলছেই। আসলে কেন্দ্রকে আমরা ছাড়তে চাইলে কী হয়, কেন্দ্র আমাদের সহজে ছাড়ে না।