সেনানায়ক জন্ম দিলেন আস্ত বাংলা শব্দ? যেভাবে এল 'জাঁদরেল' শব্দটি
Bengali Word Origin: শব্দটি হিন্দি সিনেমার সংলাপে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়। জানদার নামক হিন্দি শব্দটি কী করে বাংলায় জাঁদরেল হয়ে গেল, এটাই বিরাট ধাঁধা।
এবারের আলোচ্য শব্দ 'জাঁদরেল'। সমস্ত বাংলা অভিধানে শব্দটি পাওয়া যাবে। প্রায় প্রতিটি শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে অভিধানে অভিধানে ঠোক্কর লাগে। কিন্তু এই শব্দটির ক্ষেত্রে অভিধানগুলির মধ্যে একশো শতাংশ ঐকমত্য আছে। সমস্ত অভিধানই এক বাক্যে বলেছে ইংরেজি 'General' থেকে এসেছে 'জাঁদরেল'। সংসদ বাংলা অভিধান জানাচ্ছে, [বি ১ সেনাপতি; ২ মহাবীর। বিণ ১ মাতব্বর; ২ জবরদস্ত (জাঁদরেল অফিসার); মস্ত, প্রকাণ্ড। (ইং General )]
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ জাঁদরেল এন্ট্রিতে পাচ্ছি, '[ইংরেজি General এর লিপ্যন্তর] বি, সেনাপতি; সেনার অধিনায়ক; বীর। 'জাঁদরেল কালু ঘোষ'। 'শান্তি যে বড় বীর ভারি জাঁদরেল'- আনন্দমঠ। ২ জাঁকাল, জমকাল। ৩ জবরদস্ত।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যাযের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ পাওযা যাচ্ছে , 'বি [E. General] সেনাপতি; (সাদৃশ্যে) লম্বা চওড়া জমকালো চেহারার লোক'। রাজশেখর বসুর চলন্তিকা, সুবলচন্দ্র মিত্রর আদর্শ বাঙ্গালা অভিধান ও সরল বাঙ্গালা অভিধান, বাংলাদেশের বাংলা আকাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান (জামিল চৌধুরী সম্পাদিত), বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান (গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত), সর্বত্র ইংরেজি General থেকে জাঁদরেল-এর আসার কথা বলা হয়েছে। কেউ কোনও বিকল্প ব্যুৎপত্তি দেননি।
সমস্যাটা হল এই যে, যতই আমাদের মাথায় গাঁট্টা মেরে বুঝিয়ে দেওয়া হোক না কেন, সেনাপতিকে (স্থল, জল, বিমানবাহিনী) কেউ 'জাঁদরেল' বলে ডাকি না। জেনারেল মানেকশ বা জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরীকে তো কেউ জাঁদরেল মানেকশ বা জাঁদরেল জয়ন্ত চৌধুরী বলেন না! তাই সেনাপতি অর্থটি আলঙ্কারিক হিসেবেই থেকে গেছে। গৌণ অর্থটিই মুখ্য অর্থ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। জবরদস্ত, জমকালো, বিক্রমশালী, বলবান, অর্থগুলিই প্রধান হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠবেই, কোনও অভিধানরচয়িতাই কেন দ্বিতীয় কোনও ব্যুৎপত্তির খোঁজ না করে অম্লানবদনে 'General' তত্ত্বটি মেনে নিলেন? বাংলা, হিন্দি, বা বিদেশি ভাষাগুলিতে কি কোনও সূত্র লুকিয়ে ছিল না?
আরও পড়ুন- সংক্রামক রোগ থেকে জন্ম আলস্যের? কীভাবে এল ‘কুঁড়ে’ শব্দটি?
জবরদস্ত, মস্ত বড়ো, জাঁকজমকপূর্ণ, প্রভাবশালী বোঝাতে কোনও ভাষায় কি সম-উচ্চারণযুক্ত কোনও শব্দ ছিল না? জাঁদরেল শব্দটির প্রয়োগ দৃষ্টান্তগুলি লক্ষ্য করা যাক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচিত্রা অনলাইন টেগোর ভেরিওরাম থেকে জানতে পারছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'পরমাণুলোক' প্রবন্ধে লিখেছেন, "চীন রিপাবলিকের শান্তি নষ্ট করে কতকগুলি একাধিত্যলোলুপ জাঁদরেল পরস্পর লড়াই করে দেশটাকে ছারখার করে দিচ্ছিল।"
কাজী নজরুল ইসলাম 'বাঁধনহারা'-য় লিখেছেন, "মা গো মা, সে যে যেন সিন্ডিচড়া ধিঙ্গি, এ যে জাঁদরেল জাঁহাবাজ মরদের কাঁধে চড়ে যায় মা"। বাঁধনহারাতেই নজরুল আবার লিখছেন, "খুব একটা জাঁদরেলী গোছের দাপাদাপি দৌরাত্ম্যের চোটে পাড়া মাথায় করে তুলেছেন।" আর এক জায়গায় লিখেছেন, "হাঁ, তারপর ঝড়বৃষ্টির মাতামাতিতে তোর কোন জাঁদরেল তন্বীর বা জাঁহাবাজ কিশোরীর দাপাদাপি মনে পড়েছিল রে!" অন্নদাশঙ্কর রায় এক জায়গায় লিখেছেন, "তাদের প্রধান সম্পদ জাঁদরেলি গোঁফ"।
কোনও কোনও লেখক জাঁদরেলের জায়গায় 'জাঁদার' শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। মীর মোশারফ হোসেন লিখেছেন, "বেগম সাহেব আজকাল ভারী জাঁদার"।
এই 'জাঁদার' শব্দটিই জাঁদরেলে পৌঁছনোর একটি মিসিং লিঙ্ক। ভাবতে ভাবতে 'জানদার' শব্দটি মাথায় খেলে গেল। ফারসি জান আর দার যুক্ত হয়ে জানদার শব্দটি তৈরি হয়েছে। বাংলায় শব্দটি না চললেও হিন্দিতে বিস্তর ব্যবহার করা হয়।
হিন্দিতে জানদার শব্দটির অর্থ, ১ জীবিত, ২ সজীব, ৩ হিম্মতওয়ালা, প্রবল, শক্তিশালী, মহত্বপূর্ণ। তৃতীয় অর্থটিই তো প্রধান জাঁদরেলের আলোচনায়। বাংলায় জাঁদরেল বললে যে অর্থ ভেসে ওঠে মানসপটে, হিন্দিতে জানদার যেন সেই অর্থই বহন করছে। হিন্দি খবর ও হিন্দি কমেন্ট্রিতে জানদার শব্দটি প্রায়ই উচ্চারিত হয়। শব্দটি হিন্দি সিনেমার সংলাপে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়। জানদার নামক হিন্দি শব্দটি কী করে বাংলায় জাঁদরেল হয়ে গেল, এটাই বিরাট ধাঁধা। তবে হিন্দি শব্দকে বাঙালি যেভাবে উচ্চারণ করে, তাতে জানদার থেকে জাঁদার হয়ে জাঁদারাল তথা জাঁদরেল হতে বেশিদিন সময় লাগে না। লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে জানদারই হয়ে গেছে জাঁদরেল।
প্রসঙ্গত হিন্দি থেকে বাংলায় আসা শব্দগুলির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয় বেশিরভাগ সময়ে। সুশীলকুমার দের 'বাংলা প্রবাদ' বইটিতে জাঁদরেল দিয়ে কোনও বাগধারা নেই। জাঁদরেল ভাষাবিদরা অন্তত কোনও প্রবাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। কেন যে প্রবাদ নেই, সেটা চিন্তা করলে একটি সঙ্গত কারণ মনে উদয় হয়। কে আর ইংরেজ সেনাপতিকে নিয়ে রঙতামাশা করে কথা বলে নিজের হাজতবাস সুনিশ্চিত করতে চাইত সে যুগে!
আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় অভিধানপ্রণেতারা কী করে যে ইংরেজি General শব্দটিকে নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিলেন, তা দেবা ন জানন্তি, কুতঃ মনুষ্যা। জেনারেল থেকে জাঁদরেল আসার সম্ভাবনা যে কত কম, তা সহজেই বোঝা যায়। প্রথমত, জেনারেল মানে বাংলায় সাধারণও বোঝায়। শুধু সেনাপতিকে তো বোঝানো হয় না জেনারেল দিয়ে। জাঁদরেল লোক কীভাবে সাধারণ হতে পারে! এটা তো কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই General শব্দটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সেখানে জানদার হিন্দি শব্দটি প্রতিটি হিন্দি শব্দার্থকোষে স্থান পেয়েছে হিম্মতওয়ালা, প্রবল, শক্তিশালী, জাঁকালো অর্থে। তাই অর্থের দিক থেকে জাঁদরেল-এর সঙ্গে সাযুজ্য আছে।
আরও পড়ুন- চোর না পতিতা? ‘ছিনাল’ শব্দের আসল মানে রয়ে গেছে আড়ালেই
মীর মোশারফ হোসেন আরবি-ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন জেনারেল থেকে জাঁদরেল আসাটা কষ্টকল্পিত। তাই তিনি জাঁদার লিখেছিলেন জাঁদরেলের জায়গায়। তাঁর মনে কি তবে ফারসিজাত হিন্দি শব্দ 'জানদার'-ই উঁকি দিচ্ছিল? তাহলে তো হিন্দি জানদার থেকে বাংলায় জাঁদরেল আসার প্রবল সম্ভাবনা। কারও মনে সন্দেহ থাকলে ভার্গব আদর্শ হিন্দি শব্দকোষে 'জানদার' শব্দটির অর্থ দেখে নিতে পারেন। সেখানে হিম্মতওয়ালা, প্রবল, শক্তিশালী লেখা হয়েছে জানদারের অর্থ হিসেবে। হিন্দি জানদারই বাঙালি জিহ্বার কেরামতিতে জাঁদরেল হয়ে গেছে।
জানদার > জাঁদার > জাঁদার + আল > জাঁদারাল > জাঁদরাল > জাঁদরেল।
আমি কোনও জাঁদরেল ভাষাতাত্ত্বিকের লেখায় এসব পাইনি। নিজের সীমিত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার ফলিত প্রয়োগ ঘটিয়ে এসব লিখছি। কেউ যদি ভাবেন 'আপন মনের মাধুরী মিশায়ে' এসব করছি, তিনি তা ভাবতেই পারেন। তবে 'মাধুরী' অতি চঞ্চলা, রীতিমতো ট্যান্টালাইজিং। তাকে বাগে এনে নিজের মগজের গ্রে ম্যাটারে মেশানোটাও একটা শিল্প। যিনি পারেন, তিনিই সার্থক ভাষাবিদ।
আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ODBL-এ লিখে যাননি বলে কোনও ব্যুৎপত্তি-আলোচনা ব্যর্থ হতে পারে না। যাঁরা তাঁর লেখাকে বেদবাক্য বলে মানেন, তাঁদের কোনও দোষ নেই, দোষ আমাদের ভাষাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির। স্বশিক্ষিত গবেষকদের মান্যতা না দিলে কোনও ভাষা-গবেষণা সম্পূর্ণ হতে পারে না।