অশ্লীল বলে অভিধানে নেই, কোথা থেকে এল 'গ্রামভারি' শব্দটি?
কোন পথে গম্ভীর শব্দটি গ্রাম্ভারি হল, সেই বিষয়ে অভিধান নীরব। তৎসম গম্ভীর ও তদ্ভব (?) গ্রামভারি বা গ্রাম্ভারির মধ্যবর্তী কোনও প্রাকৃত-অপভ্রংশ দেখানো হয়নি। এখানেই একটু খটকা লাগে। তাহলে কি ব্যুৎপত্তিটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া?
আজকের শব্দ গ্রাম্ভারি, গ্রামভারি বা গেরামভারি। অনেক নামজাদা সাহিত্যিকের লেখাতেই এই শব্দটির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। 'য়ুরোপপ্রবাসীর পত্র'-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎকালীন বিলেতের গড়পড়তা মহিলাদের গিন্নিপনা নিয়ে গভীর অনুভবের কথা ব্যক্ত করেছেন। একজায়গায় লিখেছেন, "তাঁরা বলেন, 'পলিটিকস্ ও অন্যান্য গ্রাম্ভারি বিষয় নিয়ে পুরুষেরা নাড়াচাড়া করুন; আমাদের কর্তব্য কাজ স্বতন্ত্র'।" কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'বিদেশিনী' কবিতায় লিখেছেন, "প্রশান্ত-সাগর-জলে ঢেউ তুলে চলেছে জাহাজ/ গ্রামভারি-সুগম্ভীর যাত্রী তাহে যুবক ইংরাজ।" শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী, কে না শব্দটি ব্যবহার করেছেন!
এই গ্রাম্ভারি, গ্রামভারি বা গেরামভারি শব্দটি আমরা প্রায়শ ব্যবহার করি লেখায়, কিন্তু এই বঙ্গের কোনও অভিধানে শব্দটি নেই। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ', জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান', সংসদ বাংলা অভিধানে শব্দটি পাইনি। সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গালা অভিধানেও নেই। পাইনি অশোক মুখোপাধ্যায় সংকলিত 'সমার্থ শব্দকোষ'-এও।একমাত্র বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির অভিধানে 'গ্রাম্ভারি' শব্দটি আছে। ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, সংস্কৃত বা তৎসম 'গম্ভীর' থেকে। তবে কোন পথে গম্ভীর শব্দটি গ্রাম্ভারি হল, সেই বিষয়ে অভিধান নীরব। তৎসম গম্ভীর ও তদ্ভব (?) গ্রামভারি বা গ্রাম্ভারির মধ্যবর্তী কোনও প্রাকৃত-অপভ্রংশ দেখানো হয়নি। এখানেই একটু খটকা লাগে। তাহলে কি ব্যুৎপত্তিটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া?
আমাদের সামনে আর কোনও অভিধান-সমাধান নেই। তাই নিজেই একটু কাজে লেগে পড়তে হল। বাংলায় সমধর্মী আর কোনও শব্দের খোঁজ করতে গিয়ে রাশভারি আর পায়াভারি, শব্দদু'টি মনে পড়ল। বলা বাহুল্য, প্রথমটির অর্থ গম্ভীর প্রকৃতির লোক। রাশ শব্দটি সংস্কৃত রাশি থেকে এসেছে। অর্থ হলো, প্রকৃতি।
আরও পড়ুন: বাউল শব্দ কি এসেছে ‘বাউন্ডুলে’ থেকে? অভিধানে যে উত্তর রয়েছে
আর পায়াভারি মানে যে পদমর্যাদায় উঁচুতে থাকার জন্য অহংকারী ও গম্ভীর ব্যাক্তি, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। যদিও কোনও কোনও অভিধানকার ফারসি 'পাইয়াহ্' থেকে পায়া এনেছেন, সংস্কৃত পদ থেকেও পায়া আসতে পারে। ব্যুৎপত্তির জগতে পায়ে পায়ে অনেক পথ পার হওয়া তো যায়ই।
তা না হয় হলো, আসলে গ্রাম্ভারি বা গ্রামভারি তথা গেরামভারি শব্দটি এল কোথা থেকে? ভারী বা ভারি মানে যে গম্ভীর, তা অভিধানেই আছে। চিন্তা শুধু গ্রাম বা গেরাম অংশটি নিয়ে। চিন্তা করতে করতে কয়েকটি সম্ভাবনার হদিশ মেলে। গ্রাম বা গেরাম যে এখানে গঞ্জ নয়, তা বোঝার জন্যে পাণ্ডিত্য লাগে না। তবে সন্দেহের কোনও অবকাশ না রাখাই ভাল। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ চেনা-জানা গ্রাম শব্দটিকে আবার দেখলাম। গ্রাম-এর দুটি ব্যুৎপত্তি দেওয়া আছে।
প্রধান মতটি হলো, [√গম্ + অ (ঘঞ্ )-র্ম্ম,]। অর্থ,
১. লোকের গমনস্থান
২. সমূহ, নিচয়
৩. (সংগীতে) ষড়জ, মধ্যম ও গান্ধার— এই ত্রিবিধ স্বরবিভাগ।
'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ' প্রকাশিত নবদ্বীপ-পরিক্রমা বইয়ে আছে, "ষড়জমধ্যমগান্ধারাস্ত্রয়ো গ্রামা মতা ইহ।" ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচনাবলিতে আছে, 'সপ্ত সুর তিন গ্রাম'। তাহলে এমন অর্থ করাই যায়, ক্রমাগত ষড়জ, মধ্যম আর গান্ধারের রেওয়াজ করে গলা বা কণ্ঠস্বর যার ভারী বা গমগমে হয়ে গেছে, তারই গ্রামভারি বা গেরামভারি গলা। কিংবা, সংগীতের এই বিশেষ বলে বলীয়ান হয়ে গম্ভীর ও দেমাকি হয়েছে যে ব্যক্তি, সেই ব্যক্তিই গ্রাম্ভারি বিশেষণের যোগ্য। প্রথমে হয়তো এই অর্থেই শব্দটি প্রয়োগ করা হত, পরে ব্যাপকার্থে প্রয়োগ শুরু হয় জনসমাজে। কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা তো টাইমমেশিনে চেপে সেই সময়ের ঘটনার সাক্ষী হতে পারছি না, তাই কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা হলফ করে বলা মুশকিল। আন্দাজ বা ইনটুইশনের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে এটা মানতেই হবে, গ্রামভারি শব্দটির প্রথম অংশটিকে নিখাদ 'গ্রাম' ধরেও একটি ব্যাখ্যায় পৌঁছনো যায়, ব্যাখ্যাটি নেহাত জোলো নয়, মৌলিকত্বের দাবি করে।
ভাষাবিজ্ঞানে কোনও কিছুই চোখকান বুজে মেনে নেওয়ার জো নেই। কোন শব্দের পরিবর্তিত রূপ গ্রাম্ভারির এই গ্রাম-অংশ, তা বের করাই আসল কাজ। খুঁজতে খুঁজতে দেখলাম আরও দু'টি সম্ভাব্য শব্দ থেকে আসতে পারে এটি। এক, গরিমা থেকে অপভ্রংশে গেরাম বা গ্রাম। গর্ব বোঝাতে গরিমা শব্দটির প্রয়োগ সাহিত্যে ভূরি ভূরি। হয়তো মূলে গ্রাম্ভারি শব্দটি ছিল গরিমাভারী। ভারী বা ভারি মানে যে গম্ভীর, সেটা অভিধানেই মেলে। ব্যক্তিবিশেষকে যেমন ভারী বা ভারি বলা হয়, গলার আওয়াজকেও ভারি বলা হয়।
গরিমাভারি শব্দটি যে প্রথমে গেরামিভারি হয়ে পরে গেরামভারি হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তা থেকেই বাঙালি শব্দটিকে সাধু করে নিয়েছে, বলা শুরু হয়েছে গ্রাম্ভারি বা গ্রামভারি। গরিমাভারী শব্দটির কোনও প্রয়োগ পাইনি সাহিত্যে। তবে সব শব্দ তো লিখিত আকারে থাকে না, মুখেমুখেই পরিবর্তিত হয় অনেক শব্দ। পরিবর্তিত রূপটিকেই হয়তো আমরা লিখিতভাবে পাই সাহিত্যে।
আর একটি সম্ভাব্য শব্দ হল, গরম। বাংলা গরম শব্দটি আদতে ফারসি থেকে এসেছে। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সংস্কৃত 'ঘর্ম্ম' থেকেও গরম আসতে পারে বলে অনুমান করেছেন। আবহাওয়া যেমন গরম হয়, মানুষের মেজাজও গরম হয়। অনেক বাংলা লব্জ আছে গরম নিয়ে। কথায় কথায় মেজাজ গরম করা অনেকের স্বভাব। টাকার গরমে লোকে ধরাকে সরাজ্ঞান করে। তার এত গরম কীসের ভাবতে ভাবতে অনেক পড়শির দিবারাত্র নিদ্রাহীন কাটে।
গরমভারী বা গরমভারি থেকেও কি আসতে পারে গ্রাম্ভারি বা গ্রামভারি শব্দটি? অসম্ভব নয়। যেহেতু পায়াভারির 'পায়া' অংশটি ফারসি 'পাইয়াহ্' থেকে এসেছে বলে লিখেছেন অনেক অভিধানকার। শব্দে আরবি-ফারসি-বাংলার মেলবন্ধন তো হরদম দেখা যায়। যেমন লজ্জাশরম, বিয়েশাদি, মনমর্জি, ইত্যাদি।
তাহলে দাঁড়াল এই যে, রাশভারি, পায়াভারির মতো গেরামভারি বা গ্রাম্ভারি একটি সমাসবদ্ধ পদ। তার বৈধ ব্যুৎপত্তিও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলায় ঘ্যাম বলে একটি শব্দ আছে। কথ্য বাংলায় ব্যবহারও আছে। মানে দেমাক, দাপট। এই ঘ্যাম শব্দটি কিন্তু হরিচরণ, জ্ঞানেন্দ্রমোহন, সুবল মিত্রে পাওয়া যাবে না, শুধু সংসদ বাংলা অভিধানে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার, প্রয়োগের উদাহরণ দেখানো হয়েছে, অর্থ ও ব্যুৎপত্তি নেই। ঘ্যামভারি বলে কোনও শব্দের কথা শোনা যায় না। যদিও কাউকে কাউকে 'তোর ভারি ঘ্যাম হয়েছে' বলতে শুনেছি। ঘ্যাম শব্দটিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে অভ্র বসুর লেখা 'বাংলা স্ল্যাং, সমীক্ষা ও অভিধান' বইটিতে। ব্যুৎপত্তি নেই, প্রয়োগের উদাহরণ আছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকেও প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। গ্রামভারির সঙ্গে ঘ্যামের কোনও সম্পর্ক আছে কি না, জানি না।
তবে এই বঙ্গের সুশীল অভিধানকারগণ গ্রাম্ভারি বা গেরামভারি শব্দটির এন্ট্রি অভিধানে কেন রাখেননি, তা বোঝা দুষ্কর। একেবারে রাখেননি তা নয়, অভ্র বসুর 'বাংলা স্ল্যাং, সমীক্ষা ও অভিধান', বইটিতে 'গেরামভারি/গেরেমভারি' শব্দের এন্ট্রি আছে। বিশেষণ পদ লিখেও অভ্রবাবু ব্যুৎপত্তিতে (> গাম্ভীর্য) লিখেছেন। গাম্ভীর্য কিন্তু বিশেষ্য পদ। অর্থ লিখেছেন, দেমাকি চালচলন। সমরেশ বসুর 'প্রজাপতি' উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন,
এক-একজনের যেমন থাকে, পাড়ার মধ্যে একটু গেরামভারি চাল, একটু হিড়িক মেরে চলা, সেরকম কিছু না,...।
তাহলে কি আমাদের অভিধানপ্রণেতারা 'গ্রাম্ভারি' শব্দটিকে অশ্লীলতাগন্ধী ভেবে পরিহার করেছেন? না, শব্দটিকে অকুলীন ভেবেছেন? না কি ব্যুৎপত্তি না জেনে অভিধানে রাখতে সাহস করেননি? কে জানে!
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি যেটা করতে পারে, আমাদের বাংলা আকাদেমি তা কেন করছে না, তা বোঝা শক্ত।